কথোপকথন I বাংলা ব্যান্ড সংগীতে গীতিকবির পরিক্রমা
লতিফুল ইসলাম শিবলী ও আফতাব মাহমুদ খুরশিদ। নব্বইয়ের দশকে বাংলা ব্যান্ডের গানে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, এই দুই গীতিকবি তাতে রেখেছেন সৃষ্টিশীল অবদান। তাদের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে এই রচনা
ক্যাসেট প্লেয়ারের যুগে সংগীত শ্রোতাদের আবেগ অন্য রকমই ছিল বলা যায়। তখনকার দিনে প্রিয় শিল্পী বা প্রিয় ব্যান্ডের নতুন অ্যালবাম যখন বের হতো, তা কিনে গান শোনার অভিজ্ঞতা ওয়াই জেনারেশন পর্যন্ত টিকে ছিল। ক্যাসেট প্লেয়ারে বারবার ফিতা টেনে ফিতা গান শোনার মাদকতাও ভিন্ন ছিল। বাংলা ব্যান্ড সংগীতের সেই স্বর্ণযুগের আজম খান, ফিলিংস, সোলস, এলআরবি, মাইলস, নগর বাউল কিংবা ওয়ারফেজের গান ছিল আজকের বাংলা মেলো রক, রক, হার্ড রক কিংবা মেটাল গানের প্রেরণাস্থল। ‘সেই তুমি’, ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘জেল থেকে বলছি’, বা ‘নীলা’ গানগুলো আজও মানুষের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। নব্বইয়ের দশকের এই গানগুলোর পেছনের কারিগর যারা ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুজন গীতিকবি হলেন লতিফুল ইসলাম শিবলী ও আফতাব মাহমুদ খুরশিদ। তাদের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিল ক্যানভাস। দুজনের জবানিতে উঠে এসেছে বাংলা গানের হালচাল, লিরিক ও বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের টাইমলাইন।
একদম শুরুতে এই ধারার গানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। তারপর যখন থেকে বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ব্যান্ড গানের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেছিল, তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর বেশির ভাগই এসেছে লতিফুল ইসলাম শিবলী ও আফতাব মাহমুদ খুরশিদের হাত ধরে। আজম খানের ‘বাংলাদেশ’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’ থেকে শুরু করে আজকের নেমেসিস কিংবা আর্বোভাইরাসের গান পর্যন্ত বেশ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজকের বাংলা ব্যান্ড গানের অবস্থান।
লতিফুল ইসলাম শিবলী বলেন, ‘বাংলা গানের অনেক বড় একটা পরিবর্তন আসে নব্বইয়ের দশকে। সেই সময়টাতে মানুষ মূলত তিন ধরনের গান শুনত। একটা বড় অংশের তালিকায় ছিল হিন্দি গান। আর যারা একটু শহরঘেঁষা, তারা শুনত ইংরেজি গান। মাঝামাঝি কিছু মানুষ ছিল যারা শুনত বাংলা সিনেমার গান কিংবা তখনকার আধুনিক বাংলা গান। সেই সময় এলেন আজম খানরা। চট্টগ্রামে সোলস কিংবা শাফিন আহমেদদের কিছু গান। সময়ের প্রেক্ষাপটে গানগুলো ছিল কর্কশধর্মী। কারণ, মানুষ দীর্ঘদিন ধরে রোমান্টিক বাংলা কিংবা হিন্দি গান শুনে অভ্যস্ত ছিল। তখনকার লিরিকগুলো বাস্তবধর্মী কথা বলত। গানগুলো ঠিক লিরিক্যাল বা গীতিকবিতাধর্মী ছিল না। ফলে সহজ ভাষায় বাস্তবধর্মী কথাগুলো অন্য রকম শোনাত। মানুষ ভাবত, এ রকম গান আবার হয় নাকি! তখনকার সময়ে গানের পঞ্চপান্ডব বলা হতো আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ ও ফকির আলমগীরকে। তাদের হাত ধরে বাংলাদেশের মানুষ পরিচিত হলো গণসংগীত, পপসংগীত কিংবা সুফি পপ মিক্সের সঙ্গে।
আমি কখনো গীতিকবি হবো, ভাবিনি। শুরুতে কবিতা লিখতাম আর পিংক ফ্লয়েড শুনতাম। পিংক ফ্লয়েডের গানগুলো আমাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে। তার গানের কথাগুলো পলিটিক্যাল কিংবা স্যাটায়ার। গানে তারা কত কিছু বলে দিত। তখন ভাবলাম, বাংলা গানে কেন এ কাজ করা সম্ভব নয়? এই ভাবনা থেকেই লিখে ফেলি ‘জেল থেকে বলছি’। ওই অ্যালবামে আরও ছিল ‘পেশাদার খুনি’।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে তিনি লিখে ফেলেন ‘মাকে বলিস’ গানটি। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে আসা একটি ছেলের জবানিতে তিনি লিখেছেন,
ইট পাথরে সত্যগুলো গোপন রেখে,
কল্পনাতে মনগড়া এক শহর এঁকে,
মাছে ভাতে তাঁর ছেলেটা এখন ভালোই আছে।
বাড়ি ফিরে বন্ধুরে তুই মাকে বলিস।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন শিবলী। তার নামে ৮-৯টা মামলা। এমনকি এসব কারণে তার জেলের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এমন অবস্থায় ঢাকায় আসার পর তার ভেতর সেই উত্তাপ রয়ে গিয়েছিল। তিনি লিখে ফেললেন,
দিন রাত এখানে থমকে গেছে
কনডেম সেলের পাথর দেয়ালে
প্রতি নিঃশ্বাসে মৃত্যুর দিন আমি গুনছি।।
শোনো, জেল থেকে আমি বলছি
জীবনের এই ক্ষণে ইচ্ছেগুলো
ডানা মেলে হয়ে গেছে অন্ধ
অবুঝ মনটা শুধু চায় যে নিতে
তোমার চুলের মৃদু গন্ধ
তোমার মুখখানি বুকে ধরে
জীবন-মৃত্যুর মাঝে দুলছি
শোনো, জেল থেকে আমি বলছি।
প্রথাগত বাংলা গানের লিরিককে ভেঙে নতুন কিছু তৈরি করার একটা তাগিদ কাজ করেছে তার ভেতরে। ফলে ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘সুখেরই পৃথিবী’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘প্রিয় আকাশী’ গানগুলোর জন্ম হয়েছে। তিনি গান লেখার সময় সাবজেক্টকে প্রাধান্য দিতেন সবচেয়ে বেশি।
আফতাব মাহমুদ খুরশিদ গীতিকবি হিসেবে তার নিজের গল্পটা বললেন; আমি লিখতাম ছড়া। স্কুল জীবন থেকেই আমার লেখা ছড়াগুলো ছাপানো হতো জাতীয় দৈনিক, শিশু একাডেমীর নিয়মিত প্রকাশনায়, নবারুণে, দাদা ভাইয়ের কচি-কাঁচার আসরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের বড় ভাইদের একটা ব্যান্ড ছিল যার নাম অকটেভ। তখন উনারা একটা গান লিখে দিতে বলেছিলেন। ‘স্বপ্নভঙ্গ’ নামে লেখা সেই গানটি ১৯৮৯ সালের। এটি দিয়েই গান লেখা শুরু। যদিও গানটি তাদের পছন্দ না হওয়ায় বাদ পড়ে যায়। তাদের ওই অ্যালবামে আরও ৭টি গান লিখেছিলাম। ‘ডন’ থেকে প্রকাশিত ক্যাসেটটির গানগুলো বেশ হিট হয়েছিল। একই সময়ে মাইলস ব্যান্ডের একটি অ্যালবামের কাজ চলছিল। মানাম আহমেদের সঙ্গে পরিচয় থাকার সুবাদে তিনি তখন আমাকে বললেন, ‘আমাদের একটা গান বাকি আছে। তুমি যদি একটা গান লিখে দিতে পারো।’ তাদের জন্য লিখলাম, ‘সেই মিষ্টি হাসি ভুলতে পারিনি’। আর ‘স্বপ্নভঙ্গ’ গানটি মাইলসের দ্বিতীয় অ্যালবামে বের হয়। এরপর ওয়ারফেইজের প্রথম অ্যালবামে ‘আশা’, পরের অ্যালবামে ‘ধূপছায়া’, ‘মৌনতা’ আমার লেখা। এই গানগুলোও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
গান লেখার সময় আফতাব মাহমুদ খুরশিদ খেয়াল রাখতেন শ্রোতার চাহিদার দিকে। এ ছাড়া মার্কেটিং জগতের একজন মানুষ হওয়ার ফলে তিনি বুঝেছিলেন, কোন শব্দটা মানুষকে হিট করতে পারে। তিনি গানের কথাকে একধরনের সাউন্ড ব্র্যান্ডিং মনে করেন। গানের কথাগুলো সাধারণ হলেও সেখানে কিছু ব্যাপার থাকত, যা সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে যেত। ‘ফিরিয়ে দাও’ গানের মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার একটা প্রভাব।
সেই ভাবনা থেকেই আসে ‘পেয়ে হারানোর বেদনায়, পুড়ে চলেছি সারাক্ষণ’ লাইনগুলো। আগেকার গানগুলোতে অনেক নরম সুরে কোনো কথা বলা হতো। কিন্তু তাদের সময় থেকে গানের কথাগুলোর অ্যাপ্রোচ ছিল সরাসরি। খুব সাধারণ এবং প্রচলিত ভাষায় নিজের কথাটা বলতে পারাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এখানেই নতুনত্ব আনার চেষ্টাটা ছিল গীতিকারদের ভেতরে। তার মতে, গান গানই থেকে যায়; শুধু ফর্মটা বদলে যায়।
মাহমুদ খুরশিদ আরও যোগ করেন, ‘একটা গান যদি ত্রিশ বছর অর্থাৎ তিনটা জেনারেশন শোনে, তাহলে তাকে ক্ল্যাসিক বলা যায়। ‘ভুলব না’ গানটি কোনো লিরিক্যাল প্যাটার্নের গান নয়। মুখরা কিংবা অন্তরা না থেকেও একটা কবিতা থেকে এই গান তৈরি হয়েছে এবং সম্পূর্ণ একটা গল্পকে ধারণ করেছে। রিমেক গানগুলোর ক্ষেত্রে যিনি কাজটি করছেন, তার অতটুকু ধারণা থাকা দরকার, তিনি যা করছেন তা সেই গানের মোটিফের বাইরে যেন না যায়।’
বাংলা ব্যান্ড গানে প্রথম ‘তুই’ শব্দটা ব্যবহৃত হয় মাইলসের ‘ধিকিধিকি’ গানে। এর আগে ব্যাপারটিকে ধৃষ্টতা বা বেমানান মনে করা হতো। পল্লিগীতি কিংবা সুফিবাদী ঘরানার গানে অবশ্য বিষয়টি আগে থেকেই ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লিরিক তার নিজের সীমানা ভেঙেছে। কাঠামোবদ্ধ হিসেবের বাইরে এসে নতুনভাবে গান তৈরি হয়েছে। ফলে, আর্টসেল যখন অনিকেত প্রান্তর গানটি রিলিজ করে, তখন সবাই অবাক হয়ে দেখছিল যে একটা গান ১৬-১৭ মিনিটের হতে পারে! হালের বাংলা গানের কথায় এখন সাইকেডেলিক রক পর্যন্ত চলে এসেছে। নব্বইয়ের দশকের পর হঠাৎ করে ব্যান্ড গানের একটা শীতল সময় চলে আসে। নতুন গানও তৈরি হয়েছে সে সময়, কিন্তু কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়েছে। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, শাফিন আহমেদ কিংবা ফেরদৌস ওয়াহিদদের সেই গানগুলো যে রকম সবার মুখে মুখে ঘুরে ফিরছিল, নতুন গানগুলো ঠিক সে রকম হচ্ছিল না। নতুন কিছু বা চমকপ্রদ কিছুর অপেক্ষায় ছিলেন শ্রোতারা। এর কারণ ছিল, বিখ্যাত গানগুলোর গীতিকার যারা ছিলেন তাদের অনেকেই চলে যান দেশের বাইরে। ফলে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। কিংবা বলা যেতে পারে, ওই সময়টাতে হয়তো নতুনতর কিছু তৈরির প্রস্তুতি চলছিল।
নব্বইয়ের দশকের গানের সঙ্গে বর্তমান সময়ের গানের তুলনা প্রসঙ্গে কথা বলেন লতিফুল ইসলাম শিবলী। তার মতে, ‘সে সময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, দেশের আর্থসামাজিক চিত্র কিংবা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের যে একটা মিশ্র সময় ছিল, সেগুলোর কারণেই ট্রেডমার্ক কিছু সৃষ্টি হয়েছে। এরপর ব্যান্ড জগতে একটা স্থবিরতা চলে আসে। ২০০০ সালের পর নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। নতুন কথা নেই কিংবা নতুন আওয়াজ নেই। আর বর্তমান সময়ে এসে এই তাগিদের অভাবগ্রস্ততার কারণ হিসেবে তিনি খুঁজে পেয়েছেন আরামপ্রিয়তা এবং অপশনের আধিক্যকে। ফলে জনমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো গান তেমন একটা বের হচ্ছে না। খুব অল্প পরিশ্রমে সেলিব্রিটি হওয়ার একটা প্রবণতা কাজ করছে সবার ভেতর। একটা ভালো কাজের জন্য প্রয়োজন হয় ভালো দৃশ্যকল্পের। যদি কেউ সেই কাজকে ভিজ্যুয়ালাইজ না করতে পারে, তাহলে ক্রিয়েটিভিটি প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।’
লতিফুল ইসলাম শিবলী ও আফতাব মাহমুদ খুরশিদ— দুজনেই কথা বললেন রিমেক নিয়ে। পুরোনো বিখ্যাত গানগুলোর কম্পোজিশন করা হয়েছিল সেই সময়ের চাহিদা ও প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে। গানগুলোকে নতুনভাবে করা হলে এখনকার শ্রোতাদের কাছে হয়তো নতুন আবেদন তৈরি করতে পারবে বলে তারা মনে করেন। অনেকেই এখন এই কাজ করছেন, কতটুকু মানসম্মত হচ্ছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদ খুরশিদ গুরুত্ব দিলেন কম্পোজারের রুচিবোধ ও মুনশিয়ানার ওপর। তিনি মনে করেন, একটা গানের নতুন কাঠামোর ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আধুনিক ব্লেন্ডিং করলেই যে অনেক ভালো কিছু হবে এমনটি নয়। এ ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধটা থাকতে হবে।
গীতিকারদের একটা অভিমানের জায়গা আছে। সে সময় কোনো ব্যান্ড বা শিল্পী একটা বিখ্যাত গানের জন্য জনপ্রিয় হতো। ভক্ত-শ্রোতাদের কাছে শুধু শিল্পীদের নামটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত। কিন্তু এই গানগুলোর জনক যারা, তারাই থেকে যেতেন আড়ালে। হাতে গোনা মানুষ হয়তো চিনত তাদেরকে। লতিফুল ইসলাম শিবলী বলেন, ‘একটা গান মানে আমি বলছি আমার কথা। শিল্পী সেটি গাইছেন। একজন গীতিকার যে চোখে দেখে কিছু লেখেন, শিল্পীর দেখার চোখও যদি একই হয়, তাহলে গানটি সার্থক হয়ে উঠবে এবং শিল্পীর সার্থকতাও সেখানেই।’
বর্তমানে গান লেখার ব্যাপারটি অনেকটাই ব্যান্ডকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এ সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলো কাজ করছে নিজস্ব ভাবধারা নিয়ে। ফলে গীতিকারদের ক্ষেত্রে চলে এসেছে একধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা। বাংলা ব্যান্ড গানের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নানা ঘটনা, নানা স্মৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছে একটা পথ। নতুনদের কাছে নতুন কিছুরই আশা করছেন এই দুই গীতিকার।
তাওসিফ আহমেদ
ছবি: সৈয়দ অয়ন