বিশেষ ফিচার I পাতায় ভোজ
খাওয়ার পাত্র হিসেবে পাতার ব্যবহার সুপ্রাচীন। আজও তা টিকে আছে। স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশের অনুকূল বলেই
মানুষ কবে থেকে ভোজনপাত্র ব্যবহার শুরু করেছে, তা অজানা। খাওয়ার জন্য এ পর্যন্ত মানুষ ব্যবহার করেছে গাছের পাতা, মাটি কিংবা ধাতুর পাত্র। এখন চলছে কাচ, মেলামাইন, প্লাস্টিকের যুগ।
খ্রিস্টজন্মের ১০ হাজার বছরের বেশি আগে শুরু হওয়া নব্য প্রস্তর যুগেও মৃৎপাত্রের প্রচলন ছিল। সুমেরীয়, ব্যাবিলন ও হরপ্পা সভ্যতা থেকে পাওয়া গেছে বাটির নিদর্শন। তবে গাছের পাতা ঠিক কবে থেকে পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, আজও অজানা। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতীয় কুজিনে খাবার পরিবেশন ও রান্নায় পাতার প্রচলন হাজার বছরের পুরোনো।
একসময় বাংলাদেশের উৎসব-পার্বণে খাবার পরিবেশন করা হতো পাতায়। বিশেষ করে কলাপাতা ও পদ্মপাতায়। একেকটি কাঁঠালপাতা জোড়া দিয়েও পাত্র তৈরি করা হতো। শুধু যে বাংলাদেশেই এমনটা ছিল তা নয়, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিচিত্র সব কুজিনের কোনো-কোনোটিতে পাতার ব্যবহার দেখা যায়। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন ও মধ্য আমেরিকার খাবারের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাতার ব্যবহার। তবে ‘আছে’ বলার চেয়ে ‘ছিল’ বলাই সঙ্গত। সভ্যতার বিবর্তনসূত্রে বদলেছে মানুষের রুচি। প্রাচীনকালে উৎসব কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানে কলাপাতায় খাবার পরিবেশনের ঐতিহ্য ছিল। এর সঙ্গে ছিল মূলত ধর্মীয় শুদ্ধাচার ও সংস্কৃতির সম্পর্ক। দেব-দেবীর এবং ভক্তদের প্রসাদ পরিবেশনে সতেজ-সুন্দর পাতা ব্যবহার করা হতো। এখনো তা কোথাও কোথাও অব্যাহত।
ইন্দোনেশিয়ান কুজিনে এখনো কলাপাতার চল দেখা যায়। পাতায় মুড়ে খাবার পরিবেশনের এ পদ্ধতিকে স্থানীয়ভাবে প্যাপেজ বলা হয়। দেশটির জাভা দ্বীপে নারকেল দিয়ে তৈরি বোটোক নামে একটি বিশেষ পদ রয়েছে। কলাপাতায় মুড়ে ভাপে বানানো হয় এই খাবার। এ ছাড়া ফল ও সবজি দিয়ে তৈরি রুজাক নামের একটি স্যালাড এখনো কলাপাতায় পরিবেশন করা হয় সেখানে। কলাপাতাকে কোনাকৃতিতে মুড়ে একটি কাঠি দিয়ে আটকে দেওয়া এই পাত্রকে তারা ‘পিনকুক’ বলে। সাতে নামের খাবারও পিনকুকে পরিবেশন করে ইন্দোনেশিয়ানরা। সাতে হলো কাবাব।
মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের কুজিনেও রয়েছে কলাপাতার ব্যবহার। মালয়েশিয়ান ডেজার্ট কুয়িহ কলাপাতায় মুড়ে পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া মাছের কিমায় তৈরি পদ ‘ওটাক-ওটাক’ কলাপাতায় মুড়ে রান্না করা হয়। নারকেল ও চাল দিয়ে বানানো ফিলিপাইনের পিঠা সুমান। কলাপাতায় মুড়ে ভাপে এটি তৈরি হয়। চালের আরও একটি পিঠা বিবিংকাও এ-পাতায় পরিবেশন করা হয়। মধ্য আমেরিকায়ও আছে কলাপাতার ব্যবহার। কুচানো বাঁধাকপি, টমেটো, পেঁয়াজ ও গোলমরিচ সহযোগে তৈরি পদ ভিগোরন এই অঞ্চলের অধিবাসীরা কলাপাতায় মুড়ে পরিবেশন করে থাকে। এটা কলাপাতায় রেখেই খাওয়া হয়, কেননা আলাদা কোনো পাত্র এতে দেওয়ার রীতি নেই।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে কলাপাতা ছাড়াও শালপাতা দিয়ে তৈরি পাত্রে খাবার পরিবেশনের চল রয়েছে।
আমাদের দেশে একসময় পাতায় খাওয়ার প্রচলন ছিল। বিশেষ করে কলাপাতা ও পদ্মপাতায়। এখন সে দৃশ্য দুর্লভ। তবে প্রত্যন্ত কিছু এলাকায় মৃদুভাবে টিকে আছে পাতায় খাওয়ার রীতি। মেহেরপুর জেলায় এখনো এক ব্যক্তি পদ্মপাতা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। নাম খোরশেদ আলী। তিনি শোলমারি উপজেলার বাসিন্দা। বর্তমানে বিয়ে কিংবা অন্যান্য অনুষ্ঠানে না থাকলেও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের ঐতিহ্যের শেষ আলোটুকু জ্বালিয়ে রাখতে এখনো পদ্মপাতায় প্রসাদ বিতরণ করেন। ওরস, বাউল অনুষ্ঠান, দরগাহ বা মাজার কিংবা বিভিন্ন ধর্মের তীর্থস্থানে এখনো ভক্তদের মাঝে এর প্রচলন লক্ষণীয়। তা ছাড়া রাজশাহী অঞ্চলের আদিবাসীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে পদ্মপাতায় খাবার পরিবেশন করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশে পাতার পাত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার হাজি মোহাম্মদ হোসেনের নাম অনস্বীকার্য। যিনি হাজি বিরিয়ানির প্রচলক। প্রয়াত হলেও সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তাঁর উত্তরসূরিরা। বাণিজ্যিক প্রয়োজনে কাঁঠালপাতা উৎপাদন করেন তাঁরা। তাতে তৈরি পাত্রে এই বিরিয়ানি আজও পরিবেশন করা হয়। এই পাত্র পুরান ঢাকায় দাউনা নামে পরিচিত। মতিঝিল, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার- হাজি বিরিয়ানির এ তিন ব্রাঞ্চে প্রতিদিন ছয় শর বেশি দাউনা লাগে। একেকটি তৈরিতে ১২ থেকে ১৩টি পাতা ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, দৈনিক ৮ থেকে ৯ হাজার পাতার প্রয়োজন পড়ে। পাতাগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত থাকে বাঁশের তৈরি কাঠির মাধ্যমে। এগুলোর জোগান দেওয়ার জন্য কাশিমপুরে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল কাঁঠালবাগান। বেশ কয়েকজন নারী কাজ করছেন সেখানে। তারাই দাউনা বানিয়ে সরবরাহ করেন প্রতিদিন। তবে কেবল পার্সেলেই এই পাত্র প্রযোজ্য। হাজি তাওহীদ জানালেন, দাউনায় করে নিয়ে গিয়ে পরেরদিন সকালবেলায় খেলেও, বিরিয়ানি ঠান্ডা হবে ঠিকই কিন্তু নষ্ট হবে না।
কাগজে-কলমে হাজি বিরিয়ানির শুরু ১৯৩৯ সালে। তখন থেকেই পিতামহ হাজি মোহাম্মদ হোসেনের হাতে দাউনায় করে বিরিয়ানি পরিবেশনের প্রচলন। এরপর তার সন্তান ও দৌহিত্ররা একই পদ্ধতি অবলম্বন করছেন।
মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের ‘পাতক্ষীর’-এর কথা অনেকের জানা। গনগনে আগুনে বসানো হয় দুধভর্তি পাতিল। তাতে মেশানো হয় খানিকটা চিনি ও হলুদগুঁড়া। নাড়তে নাড়তে দুধ ঘন হয়ে এলে মাটির পাত্রে অল্প অল্প করে উঠিয়ে রাখা হয়। ঘণ্টাখানেক পর ঠান্ডা হলে পাতক্ষীর পেঁচানো হয় কলাপাতায়। এভাবেই পরিবেশন করা হয়। প্রায় একই দৃশ্য চোখে পড়ে খুলনার হেলাতলা রোডের ইন্দ্রমোহন সুইটসে। ১৩০ বছর ধরে কলাপাতায় মিষ্টি পরিবেশন করে আসছেন এর মালিকরা। দোকানে বসার জন্য নেই কোনো চেয়ার-টেবিল। মিষ্টি খাওয়ার কোনো চামচও দেওয়া হয় না। কলাপাতায় মিষ্টি রেখে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রমোহনের দৌহিত্র সঞ্জয় দে আজও সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
যারা এখনো পাতায় খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছেন, তারা সঠিকভাবে বলতে পারেন না, কেন পাতার পাত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ধারণা করা হয়, প্রশস্ততা ও সহজলভ্যতার কারণে খাবার পরিবেশনে কলাপাতা কিংবা পদ্মপাতা ব্যবহার করা হতো। বিজ্ঞানের বদৌলতে এখন আমরা জানতে পারি, পাতায় দেয়া খাবার স্বাস্থ্যসম্মত।
কলাপাতায় পলিফেনল নামে একধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। এটি প্রাকৃতিকভাবেই অক্সিডাইটেশন প্রতিরোধী। কোনো খাবার যখন কলাপাতায় পরিবেশন করা হয়, তখন ওই খাবার পাতার পলিফেনল শোষণ করে। এটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কলাপাতার এ উপাদান ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী এবং খাদ্যের জীবাণুকে মেরে ফেলতে সক্ষম। এ ছাড়া পলিফেনল ডিটক্সিফাইয়ার হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি ক্যানসার কোষ জন্ম নেওয়ার আশঙ্কাও কমিয়ে দেয়।
কলাপাতায় লিগনিন হেমিসেলুলোজ, প্রোটিন ও অ্যালোয়েনটাইন নামের উপাদান রয়েছে। এগুলো আমাদের শরীরের জন্য উপকারী। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যাসট্র্রিনজেন্ট খাবারের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করার পর অভ্যন্তরীণ প্রদাহ কমায়। পাশাপাশি জ্বরের উৎস যে ভাইরাস, তা মেরে ফেলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জ্বরের যন্ত্রণা কমে। যেকোনো পাতা পাত্র হিসেবে ব্যবহারের পর ফেলে দিলে তা দ্রুত মাটির সঙ্গে মিশে যায় পরিবেশের ক্ষতি না করেই। ওয়ান টাইম প্লেট হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাতার পাত্র উৎপাদন করা হচ্ছে। পিকনিক কিংবা বারবিকিউ পার্টিতে এ ধরনের পাত্রের কদর বাড়ছে। প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, গ্লু কিংবা রঙ ব্যবহার করা হয় না বলে এসব স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব।
শিবলী আহমেদ
ছবি: সজীব রহমান