আলাপন I বি-উপনিবেশায়নের ভাষা-রাজনীতিও আমার গানের উপাদান: অরূপ রাহী
অরূপ রাহী। তাঁকে একজন সংগীতশিল্পী বললে কম বলা হয়। বাংলার লোকজীবনের গানকে কেন্দ্র করেই তাঁর জীবনাচার ও জীবনযাপন। একক সংগীত পরিবেশনার পাশাপাশি গানের দল ‘লীলা’র কণ্ঠশিল্পী ও সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়া তিনি একজন কবি, সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবী। চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশ তথা নিখিল বাংলায় জ্ঞানতত্ত্বের বি-উপনিবেশায়নের লক্ষ্যে লেখালেখি ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন অতনু সিংহ
ক্যানভাস: ‘লীলা’ ব্যান্ড তৈরির আগে আপনি ৫-৬ বছর একক শিল্পী হিসেবেই সংগীত পরিবেশন করেছেন। এখনো মাঝেমধ্যে ‘লীলা’র বাইরে আপনাকে আগের রূপে দেখা যায়। আমরা আলাপের সূচনা করি সংগীতে আপনার শুরুটা দিয়ে। কিছু বলুন।
অরূপ রাহী: গান শিখে পেশাদার সংগীতশিল্পী হয়ে উঠবো এমন ভাবনা ছোটবেলায় ছিল না। এমনকি আমি প্রথম হারমোনিয়ামটা কিনি আমার বয়স তিরিশ বছর পার হওয়ার পরে। তার আগে শৈশব-কৈশোরে কখনো হারমোনিয়াম বাজাইনি তা নয়। সুর, ছন্দ আমার ভালো লাগতো। আর ভালো লাগতো কবিতা। আমি মন দিয়ে সুর শুনতাম। আর গানের কথাগুলো শুনতাম। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর লালন সাঁইয়ের গান শুনতাম। শৈশব-কৈশোরের বড় সময় গ্রামবাংলায় কেটেছে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি ফকিরদের সুর, তাদের দোতারা-একতারার সুর আমি শুনতাম। ওইগুলোই আমাকে ধরে রেখেছে। আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ওগুলো থেকে আমি কোনো দিন বেরোইনি। শৈশবের কোনো এক রাতে দূর থেকে ভেসে আসা ফকিরের কণ্ঠ আর দোতারার সুর সেই যে আমি শুনেছিলাম, তা আমার জীবন থেকে কোনো দিন হারায়নি। বরং ওগুলোই আমাকে আগলে রেখেছে। প্রভাবিত করেছে। বুঝে নিতে চেষ্টা করছিলাম যে ওই প্রভাবটা আসলে কী! এরপরেই আমি চিন্তা করতে থাকি, এই প্রভাবটা নিয়ে আমি কী করবো, সংগীত বিষয়ে আমার কী করণীয়, লোকে শিল্পী বলতে যা বোঝায়, আমি তেমন কেউ হবো নাকি আমার অন্য কিছু করণীয় রয়েছে, এই নিয়ে ভাবা শুরু করলাম। কিন্তু সুর ও কথা আমাকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে সেটা দিয়ে আমি বুঝলাম. সংগীত হলো উপলব্ধি ও প্রকাশের মাধ্যম। ফলত সংগীতকে আমার জীবনাচার, জীবনবোধ ও অনুশীলনের জায়গা থেকে দেখা শুরু করি। এ কারণে সংগীত আমার কাছে অ্যাকাডেমিক জার্নি হয়ে থাকেনি, পেশার জায়গা হয়ে থাকেনি, বরং এটি হয়ে উঠলো সামগ্রিক জীবনযাপনের অংশ। জীবনকে উপলব্ধি করা, প্রকাশ করা- এটার একটা ফর্ম হিসেবে সংগীত আমার কাছে হাজির হলো।
ক্যানভাস: আমরা এবার লিরিক প্রসঙ্গে আসি। আপনার গানের লিরিক ও সুর আপনার নিজের। আপনি কবিতাও লেখেন। তো লিরিক লেখার ব্যাপারটি কি ছোটবেলা থেকেই? কবিতা লেখার মতো করে? নাকি এটা সাধুসঙ্গ করতে করতে মহাজনদের প্রভাব? যেভাবে বাউল-ফকিররা পদ রচনা করেন…
রাহী: কৈশোরে সংগীতশিল্পী হওয়ার কোনো ইচ্ছা না থাকলেও কবি হতে চেয়েছিলাম। এবং সেই ইচ্ছা ভালোই প্রভাব ফেলেছিল আমার ওপর। তখন বেশ কিছু কবিতা লিখেওছি। পরে গিয়ে কবিতা সম্পর্কেও আমার ধ্যানধারণার বদল ঘটে। প্রথম পর্বে যেভাবে কবিতাকে দেখেছি, সেই সংক্রান্ত ধ্যানধারণায় বদল আসে। যখন গান ও কবিতা নিয়ে একই সঙ্গে ভাবনাচিন্তা করেছি, তখন মধ্যযুগের বাউল-ফকির মহাজনদের মতো ভণিতাসহ বেশ কিছু পদ রচনা করি। সংগীত এবং কবিতার মধ্যে যে দূরত্ব খুব প্রভাবের সঙ্গে বহাল আছে, আমি সেই দূরত্বের মধ্যে কখনো এ দুটোকে রাখতে চাইনি। বরং বাউল-ফকিরদের ধারা এই অঞ্চলের কবিতার ধারণা আমাকে প্রভাবিত করেছে। ফলে কবিতা ও গানের বিভাজনের বিষয়টা আমার ক্ষেত্রে কাজ করেনি। আমার প্রথম কবিতার বই ‘রূপপুর’-এর বেশির ভাগই গান। সুর সংযোজনে সেই সব পদ বা কবিতার কিছু কিছু পরে রেকর্ডও হয়েছে। কিছুদিন আগে ওই বই থেকে ‘বেগুনী ফুল’ কবিতাটিকে গান হিসেবে রেকর্ড করলাম। কবিতা ও গানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পার্থক্যরেখা সম্পর্কে আরও কিছু বলার থাকে। সেটা হচ্ছে, শিল্প ও শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তা আমরা যেভাবে বর্ণনা করি, তার ওপরে পশ্চিমা আধুনিকতার বিপুল প্রভাব হয়েছে। আমার বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া, আমার নিজেকে ও জগৎকে বোঝার প্রক্রিয়ার মধ্যে এই পশ্চিমা আধুনিকতার যে রাস্তা এবং তার যে ফ্রেমওয়ার্ক, কাঠামো, ভঙ্গি- এসবের সঙ্গে আমার কখনো কখনো দ্বন্দ্বের, কখনো ক্রিটিক্যাল, আবার কখনো বিরোধিতার সম্পর্ক রয়েছে। কলোনিয়াল-মডার্ন অভিজ্ঞতার জায়গায় নিজেকে সঁপে দিতে চাইনি। বরং বাইরের জগতের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে চেয়েছি এবং এই চাওয়াটার সংগ্রামই এখন আমি করি। আমার জীবনযাপনের মধ্যেও কলোনিয়াল-মডার্নিটির সঙ্গে একটা সংঘর্ষের অবস্থা তৈরি হয় প্রতিনিয়তই। আর এটার প্রভাবই আমার গানের মধ্যে পড়েছে।
ক্যানভাস: ইন্ডিভিজুয়ালিজম নয়, বরং আপনার গানের মধ্যে বৃহৎ গণসমাজের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার একটা প্রবণতা দেখা যায়। তো এ ব্যাপারে বাংলার লোকঐতিহ্য, বাউল-ফকিরি ধারা কি আপনাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে?
রাহী: সাধুসঙ্গ আমার জীবনে বড় প্রভাব বিস্তার করেছে। আবার একই সঙ্গে মার্ক্সীয় চিন্তাভাবনাও আমার ওপর প্রভাব ফেলেছে। শৈশবেই আমি লালন সাঁইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আবার কার্ল মার্ক্সের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছি। এই দুটি বিষয়ই আমাকে টেনেছে। উভয়ের মধ্যে কোথাও কোনো মিলের জায়গা আছে কি না, তা বোঝার চেষ্টা করেছি। মোদ্দা কথা হচ্ছে, নিজেকে কোথায় আবিষ্কার করি সেটা বোঝার চেষ্টা। আমরা ‘অপর’ বলতে যা বুঝি, সেই ‘অপর’-এর মধ্যে তো সমাজও রয়েছে। ‘অপর’ ছাড়া তো আমার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এটা বলেও রাখা দরকার, পশ্চিমে প্রচলিত বস্তুবাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির কিছু ফারাক আছে, তেমনই পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে আমাদের এখানকার কলোনিয়াল হিস্ট্রির আগের জ্ঞানতত্ত্ব ও বোঝাপড়ার মৌলিক ফারাক রয়েছে। এখানের চিন্তাকাঠামোয় ভাব ও বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করা যায় না।
ক্যানভাস: আপনার গানে এবং আপনাদের ব্যান্ড ‘লীলা’র গানে সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে খুব সাবলীলভাবেই উঠে আসে। কিন্তু এগুলোকে আপনি বা আপনারা গণসংগীত বলছেন না। কেন?
রাহী: আমি কখনোই নিজেকে গণসংগীতশিল্পী বলি না। আমি গান করি। সেই গানটা যা প্রকাশ করে তাকে হয়তো কেউ কেউ গণসংগীত বলে থাকবেন। আমি বা আমরা মনে করি ‘গণ’ কথাটার যে ধারণা, সেই ব্যাপারে আমি বা আমাদের ‘লীলা’র মতামতের কথা যদি বলি, তাহলে বলবো, ‘গণ’ শব্দটিকে আমরা কোনো আভিজাত্যবাদী রাজনৈতিক প্রকল্প থেকে মূল্যায়ন করি না। আমি নিজেই গণর অংশ যেহেতু, আমার প্রেমও গণের অংশ। তাই আমার গানকে আলাদা করে ‘গণসংগীত’ বলতে হয় না। ‘গণ’, ‘লোক’ ইত্যাদি এলিটিস্ট ডিভিশনের মধ্যে আমি বা আমরা নেই। এই যে একটা ধারণা রয়েছে ‘গণ’ যাতে বোঝে, তার জন্য খুব সহজভাবে লিখবো- এই রকম ধারণাকে আমার খুবই এলিটিস্ট ধারণা বলে মনে হয়। মানুষের জন্য গান করি। কারণ, আমরা নিজেরাও এই সমাজের মানুষ। কিন্তু যদি বলি যে আমরা গণের জন্য কাজ করছি, তাহলে বোঝায় ‘গণ’ বুঝি আলাদা আর আমি গণ’র উদ্ধারকর্তা। এই রকম ধারণা আমরা পোষণ করি না।
ক্যানভাস: হ্যাঁ, স্লোগানধর্মী বা পোস্টারধর্মী কবিতা যেভাবে লেখা হয় কিংবা সমাজতান্ত্রিক দল অথবা কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কালচারাল ফ্রন্ট যেভাবে স্লোগানধর্মী সংগীত পরিবেশন করে, এগুলো কোথাও একটা পার্টিজান শিল্পসাহিত্য তৈরি করে। এটাও কি একধরনের হেজিমনি তৈরি করে না? কী বলেন?
রাহী: হ্যাঁ, একটা গানে বা কবিতায় কটা রাজনৈতিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এটা দিয়ে যদি রাজনৈতিক শিল্পের মাপকাঠি বিচার করা হয়, তাহলে সেই পার্টি কালচার আসলে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিরই অংশ। এটা দেখে মনে হয়, নন্দনতাত্ত্বিক জায়গা থেকে তারা ঔপনিবেশিক, কিন্তু কিছু শব্দের মাধ্যমে নিজেদের র্যাডিক্যাল প্রমাণ করছে।
ক্যানভাস: এই পার্টি সংস্কৃতি ‘গণ’র কথা বলার পরেও এক্সপ্রেশনের জায়গায় প্রমিত ভাষা বা মান ভাষার ব্যবহার করছে। আপনি কি এর থেকে বেরোনোর জন্যই, সাধারণ মানুষের জীবনের প্রসঙ্গ ও শব্দ হাজির করেন গানে? যেমন ধরুন, ‘রাজায় কইছে চুদির ভাই’, ‘দুপুর বেলা মুরগী রাইন্ধো না’ ইত্যাদি।
রাহী: ছোটলোকের ভাষা এবং অ-ঔপনিবেশিক সৌন্দর্যভাবনা ও জীবনদর্শনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখার জন্যই আমরা সমাজের মধ্যে ব্যবহার হতে থাকা শব্দগুলোকে গানে হাজির করি। এটা একই সঙ্গে নন্দনতাত্ত্বিক ও ভাষা-রাজনীতি। সংগীত ও শিল্পের শুদ্ধতার নামে আমরা যদি উপনিবেশবাদী নন্দনতাত্ত্বিক ধারণার দাসত্ব করে যাই, তাহলে আর ‘গণ’র বা ‘লোক’মানুষের হয়ে উঠলাম কীভাবে? বি-উপনিবেশায়নের এই নন্দনতাত্ত্বিক ভাষা-রাজনীতিও আমাদের গানের উপাদান।
ক্যানভাস: বারবার আপনাদের বাংলা ব্যান্ড ‘লীলা’র প্রসঙ্গ উঠছে। বাংলা গানের আর পাঁচটা ব্যান্ডের মধ্যে ‘লীলা’র বিশেষত্ব কী?
রাহী: বাংলা গানের যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের মধ্যেই ‘লীলা’ জন্ম নিয়েছে। কিন্তু এটা বলে নেওয়া ভালো যে চলতি ভাষায় আমাদের ‘ব্যান্ড’ বলা হলেও, সাধারণত আমরা নিজেদের ‘ব্যান্ড’ বলি না। আমরা বলি গানের দল। কিন্তু সামাজিকভাবে শিল্পের প্রচলিত পরিচিতি কাঠামোর মধ্যে থাকা মানুষের সুবিধার্থে মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে ব্যান্ড শব্দটিকে ব্যবহার করি। পশ্চিমা সংগীতের ইতিহাসে এই ব্যান্ড কালচার একটি বিশেষ ঘটনা। এগুলো ইউরোপের জন্যই নির্দিষ্ট। আমি মনে করি না, আমাদের সমাজে পশ্চিমা অর্থে কোনো ব্যান্ড হতে পারে। আমরা গানের দল, কিন্তু বোঝানোর সুবিধার্থে কখনো কখনো ‘ব্যান্ড’ শব্দটিকে ব্যবহার করি। কিন্তু আমাদের কাজের মধ্যে গানের দলের বিষয়টিই থাকে। এবং আমাদের কাজও কিছুটা ভিন্ন। সংগীত একটি পারফর্মিং আর্ট ফর্ম। তো শিল্পের এই বিশেষ মাধ্যমে আমাদের কাজটা কী হবে, সেই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা সচেতন। আমরা মনে করি, আমাদের জীবন, অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য যে ছন্দ ও সুর লাগবে, সেই সুরটাই প্রকাশ করবো। এর ভিত্তিতেই আমাদের সংগীতকে সামনে রেখে আমরা এক প্রকার সৌন্দর্য-রাজনীতির জন্ম দিয়েছি। আমাদের গানের মধ্য দিয়ে নানা অঞ্চলের সুর কখনো কখনো প্রকাশ পেলেও, মূলত বাংলা সুর, বাংলার ছন্দ, বাংলার কাব্য, বাংলার গীতিকবিতা ও সংগীতের ব্যাপারে এই অঞ্চলের ভাবনাকে বেশি গুরুত্ব দিই।
ক্যানভাস: গানের দলের নাম ‘লীলা’ কেন?
রাহী: এই যে আমাদের সমাজের লোকঐতিহ্য ও লোকসংগ্রামের যে ধারা ও পরম্পরা, তা আসলে মানুষের একপ্রকার লীলা। তা উপনিবেশবাদী চিন্তাপ্রকল্পের বাইরের জিনিস। এর সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতেই দলের নাম ‘লীলা’।
ছবি: ফয়সাল সুমন