ফিচার I রসনার স্বাধীনতা-পরাধীনতা
খনা থেকে বন্ধুপত্নীর ডায়াবেটিসের ডায়েট নিয়ে রান্নার বই। কল্পনা আর বাস্তবতার জলছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কলকাতার রসনা লিখিয়ে পাঞ্চালি দত্ত
এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো অচেনা এই বিদুষী নারী, যিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের সময়ে এবং তদানীন্তন পুরুষশাসিত সমাজে তাঁর জ্ঞান ও প্রতিভা দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষিবিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রে তিনি ছিলেন কৃতবিদ্য। কৃষিবিদ্যায় তাঁর পাণ্ডিত্য এতটাই ছিল যে কবিতা বা ছড়ার মাধ্যমে বাংলার কৃষিব্যবস্থাকে নতুনভাবে লালন করতে শিখিয়েছিলেন। এই নারীই আমরা বাংলার প্রথম আবহাওয়াবিদ; যাকে আমরা লীলাবতী বা খনা নামে চিনি। তিনি সহজ-সরল পদ্যের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে কৃষিবিদ্যাকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে আজও তা আমাদের দুই বাংলার চাষিদের মনে গেঁথে আছে। আর সেই সময়ে বলার অপেক্ষা রাখে না, ঋতু অনুযায়ী বীজ বপন করা তাদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়। অথচ এসব তথ্য আবিষ্কার করতে কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রয়োজন পড়েছে দিনের পর দিন গবেষণার। এখানে একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়াই যেতে পারে:
‘শীষ দেখে বিশ দিন
কাটতে নাড়তে দশ দিন।’
চাষি যখন ধানের শীষ দেখতে পাবে, তার ঠিক কুড়ি দিন পরেই সেই ধান কাটতে হবে। কারণ, ধান কাটা ও মাড়াই করার তখনই উপযুক্ত সময়।
‘ষোলো চাষে মুলা, তার অর্ধেক তুলা,
তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।’
অর্থাৎ মুলা চাষ করতে হলে লাঙল দিয়ে জমি চষতে হবে ষোলোবার। তুলা চাষে আটবার এবং ধান চাষে চারবার। আর পান চাষে লাঙল না দিলেও চলবে।
‘বারো মাসে বারো ফল
না খেলে যায় রসাতল।’
এভাবেই অত্যন্ত সোজাভাবে বুঝিয়ে দিতেন শরীর ভালো রাখার গোপন চাবিকাঠি। কিন্তু অগাধ জ্ঞানের জন্য তাকে হারাতে হয়েছিল জিভ। এখনো পৃথিবীতে ভালো কাজের জন্য ঈর্ষার শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হয়। এই ঈর্ষার রাজনীতিতে অনেক সময় মনোবল হারিয়ে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা হারিয়ে যান অন্তরালে। আমরা স্বাধীন নাগরিক বলে যে গর্ব করি, আদৌ কি স্বাধীন আমরা!
আজ সাধুচরণের মন ভালো নেই। খনার জিভ কেটে দিয়ে বাক্স্বাধীনতার মৃত্যু ঘটেছিল, আর সাধুচরণের জিভে লাগাম দিয়ে ভোজ স্বাধীনতার মৃত্যু! সারা রাত ছটফানিতে কেটেছে। ভোরবেলা ঘুম হালকা এলেও, অগোচর মনে একদলা কষ্ট থেকে থেকেই বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। পাশবালিশ জাপটে জোর করে আবারও ঘুমের চেষ্টা করতেই হু-হু করে কেঁপে ওঠে শরীর। লেপ উধাও বিছানা থেকে। বোঝা গেল মর্নিংওয়াকের প্রথম সকাল বিফল হওয়ার ফল কপালে জুটেছে। কাল ডাক্তারের দুচোখের মণিতে অবিশ্বাসের ছাপ দেখেছিল সাধুচরণ। এরা তো কোম্পানির শুধু ওষুধ গেলাবে এই তক্কে তক্কে থাকে। তাই ভরসা করতেও ভয়। মনে হচ্ছিল দুটো গুলি ছুটে আসছে ওই চোখ দুটো থেকে।
শীতের অলস সকাল। দূর থেকে টুকরো আওয়াজ ভেসে আসছে; তাতে স্পষ্ট স্বাধীনতার গান। এ মাস তো স্বাধীনতারই মাস। কদিন পরেই শুরু হবে অনুষ্ঠান। কিন্তু সাধুচরণ আজ অব্দি বুঝে উঠতে পারে না স্বাধীনতা শব্দের অর্থ। রসনায় রশি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধায় এমনিতেই সে পরাধীন তার প্রিয়তমার কাছে। এভাবে বাঁচার কোনো অর্থ হয়! খনার টিকটিকিটা ঠিক এমন সময়ে টিকটিক করে ওঠে-
‘উনা ভাতে দুনা বল
অতি ভাতে রসাতল।’
পদ্যের মর্ম এখন পদে পদে মালুম হচ্ছে। আগে থেকে এই সাবধানতা অবলম্বন করা গেলে এই ডিগ্রিগুলো (মধুমেহ, চর্বি, রক্তচাপ, থাইরয়েড) হয়তোবা ডিগ্রিধারী ডাক্তারটি জুড়ে দেবার সুযোগ পেত না। ট্যালট্যালে লাল চায়ের কাপটি ধড়াস করে টেবিলের ওপর রেখে গিন্নি এমন চাহনি দিলেন যেন পরকীয়ায় জড়িয়েছি আমি। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের নিয়মে চলো, তারপর স্কুলের নিয়ম, তারপর বউ; উফ্! জীবনটা পোড়া কয়লা। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হোস্টেলে গিয়ে যে একটু স্বাধীনতার হাওয়া খাব, এ সুখও কপালে জুটলো না। ধেড়ধেড়ে গ্রামে আধভাঙা সাইকেল নিয়ে কোনোমতে কলেজে পৌঁছানো, ফের বাড়ি। সবার কি আর সৌভাগ্য হয় রে সাধু। ছুটিতে হোস্টেল থেকে গ্রামে বন্ধুগুলো এলে দেখে মনে হতো সুখের ভেলা। আর আমি! ভেলা তো নয়; না যায় গেলা, না যায় বলা। সন্ধ্যেবেলা আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরলে মার নাসিকা কুঞ্চনে বুঝতাম যে তিনি গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছেন; যদি কোনো গন্ধের সন্ধান পান। স্বাধীনতার এ্যায়সি কি ত্যায়সি। সেবার বন্ধুপত্নী কোলের বাচ্চাকে নিয়ে সাত দিনের ছুটি কাটাতে যাবে বাপের বাড়ি। বন্ধু ওদিক থেকে চোখ টিপে আমায় ইশারা করলো। বুঝলাম, ফিস্ট প্ল্যানিং করছে। শনি ও রবিবারের অতিথি হবো তার বাড়িতে। সক্কালবেলা বাজার থেকে কিনলাম ইয়া সাইজের ইলিশ, ডিম ভরা গাদা; পিসগুলোতে যেন মাখন মাখানো। সঙ্গে কুচো চিংড়ির বড়া, ফুলুরি। প্রায় পৌঁছাব, দেখি জগা ওই রাস্তা ধরে আসছে দু’হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে। বোঝা যাচ্ছে দুপুর আজ জমে যাবে। মায়ের আঁচলের ছায়ায় বড় হয়েছি, তাই নো আইডিয়া অ্যাবাউট রান্নাবান্না। বন্ধুর ঘাড়ে কাজ চাপিয়ে চলে এলাম ম্যাচ দেখতে। ভারত বনাম ইংল্যান্ড। ক্লান্ত শরীর; একে একে হাত-পা ছড়িয়ে দিলাম বিছানায়। চোখে মোলায়েম ঘুম। আহা! এমন অপূর্ব ম্যাচ ভারত কি খেলেছে আগে কখনো? ঠেকায় কে আজ ভারতের জিত। ওঘর থেকে ভেসে আসছে ইলিশ ভাজার গন্ধ। আকাশটা যেন আজ বড্ড নীল। পাহাড়ের চূড়া থেকে মোমের মতো একটি মেয়ে নেমে আসছে। বরফকুচি লেগে গাল চকচক করছে। কী নাম গো তোমার?
-সাধু, এই সাধু, ওঠ। খাবার রেডি।
দারুণ সাজিয়েছে। মাটন কষা, ইলিশ ভাজা, মসলা চিংড়ি, কুচো চিংড়ির বড়া, শীতের ছোট আলুর দম আর কাচের গ্লাসে টলটল করছে খয়েরি পানীয়। নাম জানি না। কোনো দিন দেখা বা ছোঁয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আজ শুধু দুচোখ ভরা ঢুলঢুলু ঘুম। স্বপ্নগুলো আকাশপথে নেমে আসছে ঘরে। রোদ, বরফকুচি, সবুজ পাহাড়, ক্রিকেট, মাংস, ইলিশ, পানীয়, আলুর দম- সব নেশায় টইটুম্বুর।
নেশা, নেশা; আগুন আগুন…
দু চুমুক দিতেই ভ্রু-নাসিকা কুঞ্চিত। ছ্যাঃ এ আবার কেমন পানীয়। স্বাদ তো দূর কি বাত, তেতোয় মুখ তিতকুটে হয়ে গেল। জগা পিঠ চাপড়ে বললো, ‘বস, এ খাবারের রহস্য হলো যত খাবি, স্বাদ তত বাড়ে।’
পাঁচ চুমুক, ছ চুমুক…। বন্ধু একেবারে ঠিক। মনটা তুলোর মতো হালকা হয়ে হাওয়ার তালে নেচে বেড়াচ্ছে। সূর্যটা কেমন যেন ঘোলাটে। বোধ হয় আমার মতো আজ সে ক্লান্ত-সুখী। কাঁঠালপাতাগুলো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে উঠোন থেকে। পাল্টা দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিলাম, তোমার দাদাগিরি এখানে চলবে না হে। চড়–ইপাখিগুলো বড্ড সেয়ানা। ঘুরে ঘুরেই এসে দেখে যাচ্ছে। ডাকপিয়নের কাজ করলে ভায়া তোরও অবস্থা হবে প্লেটে রাখা ওই মাটনের মতো। উঠোনে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা কয়লার উনুনটাও যেন দীর্ঘকালের ক্লান্তি মুছে নেশাধরা চোখে দেখছে আমায়। মা আগে মাটির উনুনে কত ধরনের খাবার পুড়িয়ে তৈরি করতেন। কী দারুণ ছিল সেই পোড়া মিষ্টিআলু, মকই, কাঁঠালের বীজ, টমেটো। গ্যাসের উনুন আসায় এখন আর ওগুলো খাওয়া হয় না। ঘরময় দুধসাদা রঙ, সাদা ধবধবে বিছানার চাদর, বালিশ, ঘড়ি, ফ্যান, আলো…উঠোন থেকে চম্পার গন্ধ হাওয়ার ঝাপটায় ঘরে এসে আরও নেশাচ্ছন্ন করে তুলেছে। ঘড়ি, আজ তুই টিকটিকানি বন্ধ করে দে কয়েক ঘণ্টার জন্য। তোকে তার বদলে দেব উপহার- ‘ভালো সময়’। বেজে উঠলো- টিং টং, টিং টং। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। তুই ঘুরতে থাক তোর কাঁটা দিবানিশি, আমি এবারে ঘুমোই।
-সাধু, সাধু, শিগগিরই ওঠ।
-ডাকিস না জগা। আজ পৃথিবী ঘুমোচ্ছে। দেখ চারপাশে কত শান্তি। লড়াই নেই, বিবাদ নেই, শব্দ নেই।
-সাধু, তুই এক্ষুনি ওঠ আর বাড়ি পালা।
আমার বউ ফিরে এসেছে। কিছু সমস্যা হয়েছে ট্রেন লাইনে। তুই আর দেরি করিস না।
সারা দিন গাঁয়ের এক কোনের বটগাছের তলায় শুয়ে কাটলো দুপুর। সেখানে লোক সচরাচর আসে না। কিন্তু সন্ধের মশার অগুনতি ভিড়ে আমি কোণঠাসা। এখনো চোখে হালকা দুলুনি। এই নিয়ে বাড়ি যাওয়া চলে না। গাঁয়ে সরাইখানা একটি আছে বটে, কিন্তু লোক জানাজানি হলে মুশকিল। ডাবুর দোকানে দু কাপ চা খেয়ে ঘোর কিছুটা কেটেছে। ঘোরাঘুরি করে রাতের খাবার খেয়ে যথারীতি হাজির বাড়ি। মায়ের প্রশ্ন। আমার শরীর খারাপের বাহানা। দরজা টেনে শুয়ে পড়লাম। ঘুমের ঘোরে কে যেন হেসে উঠল, স্বাধীনতা-স্বাদ-স্বপ্ন।
গিন্নি সামনে এক গ্লাস করলার রস রেখে গেলেন। মধুমেহকে বাগে আনতে, চব্য, চোষ্য খাবার তাড়াতাড়ি শুরু করতে হলে খেতেই হবে ওই সব ছাইপাঁশ। ভোজ নিয়ে সাধুচরণের পক্ষে সাধু হয়ে থাকাটা বড্ড মুশকিল।
মোবাইলে মেয়ের নম্বর ভাসছে। বাবা, শুনলাম তোমার হাই ডায়াবেটিস, প্রেশার। নো আলু, নো চায়ে চিনি, শুধু দিনে এক কাপ ভাত, দুটো রুটি, বেশি সবজি। মাছ কম, নো মাটন…ক্ষীণ হয়ে আসছে ওপারের গলা। মনে পড়ছে, বহু বছর আগে এক বন্ধুপত্নীর লেখা ডায়াবেটিসের ডায়েট রান্না বইটি উপহার দিয়েছিল। তাচ্ছিল্যভরে কোনো এক তাকে নির্বাসন দিয়েছিলাম। আজ তাকে খুঁজতে হবে। গিন্নি ওদিকে দাঁড়িয়ে পরবর্তী টোটকা নিয়ে। কেন জানি আজ মনে হচ্ছে, এ পরাধীনতাটাই-বা কজনের কপালে জোটে!
লেখক: কলকাতার হ্যাংলা হেঁশেলের সাংবাদিক