এডিটরস কলাম I নারী মানে প্রকৃতি
পরিবেশ ধ্বংস আর নারীর ওপর নিপীড়নের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। এটা হলো প্রকৃতি থেকে নারীকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ও কৌশল, যাতে তারা বিপন্নতার মুখে পড়ে এবং এর ফলে নারীকে অধস্তন করে রাখার আরেকটি কার্যকর ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। এটা নারীর স্বাভাবিক বিকাশের মস্ত এক বাধা
পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন চলছে বিশ্বজুড়ে। এই সচেতনতা থেকে যে, মানুষ ও নিসর্গ আলাদা কিছু নয়, বরং এই দুয়ের মধ্যে আস্তিত্বিক বন্ধন ও অভিন্নতা সৃষ্টিকাল থেকে অনপনেয় হয়ে আছে। মানুষ প্রকৃতির অংশ, ফলে একটি বিপন্ন হলে অন্যটির নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে না। এই বাস্তবতা বেশ আগে থেকে অগ্রাহ্য করে আসছে পশ্চিমের দুনিয়া। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের অব্যবহিত সময়ে যে যান্ত্রিক ও কৃত্রিম রাসায়নিক জগতে মানুষ প্রবেশ করেছে, তাই এখন তার সুস্থ জীবনের প্রতিকূল হয়ে দেখা দিয়েছে। পানি-বাতাস, এমনকি খাদ্যশৃঙ্খলা পর্যন্ত যা কিছু- সব আজ নষ্ট হওয়ার পথে। মানুষ বুঝতে পেরেছে, এই অবস্থা থেকে মুক্তি দরকার। ফলে আজকাল গ্রিন লাইফস্টাইল, ইকো-ফ্যাশন, ইকো-ফ্রেন্ডলি কসমেটিকস ইত্যাদির কথা বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। প্রকৃতিনিবিড় ও স্বাস্থ্যবান্ধব অর্গানিক পণ্যের কদর বেড়ে চলেছে।
আর নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা বলছেন, শিল্পবিপ্লবসৃষ্ট যন্ত্রসভ্যতা নারীকে বিচ্ছিন্ন করেছে প্রকৃতি থেকে। এই প্রবণতা বিশ শতকে বেড়েছে ভয়ংকরভাবে- তার নিত্যব্যবহার্য প্রায় সবকিছুই বিপজ্জনক কৃত্রিম রাসায়নিকে ভরা। এগুলোর প্রভাবজনিত ক্ষতি এত বিপুল ও সুদূরপ্রসারী যে নারীর ত্বক থেকে শুরু করে প্রজননস্বাস্থ্য পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের কবলে পড়ে। নারীবাদীদের অনেকেই একে নারীর বিরুদ্ধে পরিচালিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাদের কেউ কেউ বলছেন, পরিবেশ ধ্বংস আর নারীর ওপর নিপীড়নের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। এটা হলো প্রকৃতি থেকে নারীকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ও কৌশল, যাতে তারা বিপন্নতার মুখে পড়ে এবং এর ফলে নারীকে অধস্তন করে রাখার আরেকটি কার্যকর ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। এটা নারীর স্বাভাবিক বিকাশে মস্ত এক বাধা। এই অচলায়তন থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় গড়ে উঠেছে ইকো-ফেমিনিজম নামের নতুন এক চেতনা ও তত্ত্ব- যাতে নারীকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে দেখার কথা বলা হয়েছে। একে কেন্দ্র করে নারীবাদীরা নির্মাণ করেছেন জ্ঞান ও শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা। এগুলোর মূল বিবেচ্য প্রকৃতির অংশ হিসেবে নারীর জীবনধারার রূপায়ণ, তাতে লৈঙ্গিক আচরণ, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, যৌনতা, গর্ভধারণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ইকো-ফেমিনিজমেও নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও উত্তরণের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
নারী আর প্রকৃতি যে আলাদা কিছু নয়- একটু আগেই তা বলা হয়েছে। উভয়ের রূপও তাই একই। একজন সৌন্দর্যসচেতন মানুষ হিসেবে আমি মনে করি, প্রকৃতি নারীকে যে সৌন্দর্য দিয়েছে, তা রক্ষা ও বিকাশের অধিকার তার রয়েছে। সে জন্য প্রথমে এটা আমাদের বোঝা দরকার, কোন কোন খাবার (বিশেষত প্যাকেটজাত) ও সৌন্দর্যপণ্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর। প্রসাধনীর লেবেলে যেসব উপাদানের নাম ও মাত্রার উল্লেখ থাকে, সেগুলোর মন্দ দিক বা প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও সম্যক ধারণা থাকা জরুরি। তাহলেই আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে- কোনটি ভালো কিংবা মন্দ, কোনটি ব্যবহারযোগ্য বা তা নয়। পোশাকের ক্ষেত্রেও জানা চাই- কোন ফ্যাব্রিক ত্বকের অনুকূল, কোন কাপড়ের রঙে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে। খাদ্যে যে বিষাক্ত রাসায়নিক ও প্রিজারভেটিভ প্রয়োগ করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে সাবধান থাকা দরকার। আর এখনকার সচেতন মানুষের সঙ্গে স্বর মিলিয়ে আমিও বলি, নারীর পক্ষে নিজের জন্য সব সিদ্ধান্ত নেওয়া তখনই সম্ভব, যখন তার অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে, শিরদাঁড়া সোজা রেখে যখন সে চলতে পারবে।
তবে যে কথাটি আমার সবচেয়ে বেশি মনে হয়- প্রকৃতিকে রক্ষা করা সমগ্র মানবসভ্যতার অস্তিত্বের জন্য বেশি জরুরি। অন্যদিকে, নারী সুস্থ না থাকলে তার পক্ষে সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দেওয়া অসম্ভব। অসুস্থ মানবসন্তান নিজেকেই রক্ষা করতে পারবে না। আর নিজেকে বাঁচাতে না পারলে প্রকৃতির জন্য সে কী করবে? পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থতা দরকার।
আমার কথা হলো, পরিবেশ বিপন্ন হলে পুরো পৃথিবীই তো ভয়াবহ দুর্দশা ও ধ্বংসের মুখে পড়বে। মানুষ কেন, প্রাণিজগতের কিছুই রক্ষা পাবে না। এমনিতেই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য দিন দিন নষ্ট হয়ে চলেছে। তাই সময় থাকতেই নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার উচিত প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হওয়া। মরমি গীতিকবি লালন সাঁইয়ের গানেই তো একথা আছে, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’।