skip to Main Content

স্মরণ I সোনালি প্রতিভার কবি

কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক আল মাহমুদ [জন্ম: ১৯৩৬, মৃত্যু: ২০১৯] অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ব্যাপী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করে গেছেন। জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতার জগৎ যে কজনের হাতে বিকশিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আল মাহমুদ অগ্রগণ্য। তাঁর নামের সঙ্গে উচ্চারিত হয় শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরীর নাম। বাংলা কবিতার কেন্দ্রকে কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের ক্ষেত্রে এঁদের ভূমিকা অভিভাবকতুল্য। শুধু তা-ই নয়, কবিতা সম্পর্কে বাঙালি মুসলমানের ধারণার উন্নয়নও এঁরা ঘটিয়েছেন। যে তিন কবির নামোল্লেখ করা হলো, তাঁদের প্রত্যেকেই গড়ে তুলেছেন নিজস্বপৃথক চিন্তনপরিধি ও ভাষাজগৎ। তাহলে বাংলা কবিতায় আল মাহমুদের স্বতন্ত্র স্বর ও পরিসরটি কীভাবে গড়ে উঠেছে? তিনটি ধাপে তা সম্পন্ন হতে দেখা যায়। প্রথমত, মার্ক্সবাদী চেতনার সঙ্গে লোকজীবন ও জৈবিক আগ্রহের মিশ্রণ; দ্বিতীয়ত, সময়চেতনার সঙ্গে লোকজ অভিজ্ঞানের মিশেল; তৃতীয়ত, মরমিপনায় আত্মসমর্পণ।
এই তিন পর্বে তাঁর কবিতা-পরিক্রমা লক্ষ্যযোগ্য হলেও যে ছক প্রায় সব বাঙালি কবির মতোই তাঁকেও অধিকার করেছে, তা হলো: শুরুতে রোম্যান্টিক ও পরিণতিতে মিস্টিক। তবে রূপটি ভিন্ন। এই দিক থেকে যে, রোম্যান্টিক সংবেদনশীলতা প্রকাশের জন্য তিনি দ্বারস্থ হয়েছিলেন ক্ল্যাসিক আঙ্গিকের, যেমনটি দেখা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তর বেলায়। [যদিও তা আংশিকতায় পর্যবসিত- কেবল মিথের পুনর্মূল্যায়নেই রোম্যান্টিকের দায় সম্পন্ন করা হয়েছে মেঘনাদবধ কাব্যে (১৮৬১)। প্রকাশরীতিতে এটি নির্ভেজাল ক্ল্যাসিক।] রোম্যান্টিকদের মতোই, মার্ক্সবাদী চেতনার পুনর্মূল্যায়ন তিনি করেছেন কৃষিনির্ভর বাঙালির জৈবিক আগ্রহ ও অনুশীলনের মধ্যে সাম্যের আবেগ যুক্ত করে; অন্যদিকে লিপিকৌশলে তিনি বেছে নিয়েছেন ক্ল্যাসিক রীতি। জীবনানন্দ-পরবর্তী খুব কম কবির বিকাশ আমরা এভাবে ঘটতে দেখি। এমনকি শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরীও এই পথে হাঁটেননি। তাঁদের এবং অপরাপর কবিদের মধ্যে এই সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে কবিতায় নাগরিক বিষয়-আশয় থাকা জরুরি, ভাষায় ভদ্রলোকি শহুরেপনা থাকা চাই। এই টেনশন রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতা র দান। কবিতা-সম্পর্কিত সে-সময়ের সংস্কারের শিকল থেকে আল মাহমুদ নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। এর প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন সম্ভবত জসীমউদ্দীন ও ফররুখ আহমদ- এই দুজন কবির কাছ থেকে। কিন্তু এঁদের থেকেও তাঁর কবিতা বিষয় ও প্রকরণগত স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল।
২.
আল মাহমুদের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সোনালি কাবিন (১৯৭৩) প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কারণ অনেক। তবে প্রধান একটি কারণ হলো, গ্রন্থটি শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাব্যিক ইশতেহার। যে চারটি মূলনীতির ওপর এই রাষ্ট্রের সংবিধান রচিত হয়েছে- সবই এতে ঠাঁই করে নিয়েছে। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির আকাক্সক্ষা এতে একাকার হয়েছে। বা, বলা যেতে পারে এই গ্রন্থে ব্যক্তির চাহিদার মধ্যে বিরাজ করেছে রাষ্ট্রের স্বপ্ন। কিন্তু এতেই এর মর্ম নিঃশেষিত নয়; এই ভূখন্ডের মানুষের জীবনধর্ম ও ধারায় ওতপ্রোত বিষয়-অনুষঙ্গরাশি বিচিত্রমুখী ও গভীর রূপক-প্রতীক-সংকেতে সংশ্লেষিত। অধিকন্তু, এর প্রকাশ ঘটেছে এখানকার নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক অভিজ্ঞান এবং উপযোগের ভাষায়। আমরা জানি, সমষ্টির মধ্যে লীন বা অভিযোজিত ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, বিচ্ছিন্নভাবে দেখা কঠিন। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় আলোচ্য গ্রন্থে ব্যক্তি নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে থেকে থেকে। কে সে? সে স্বাপ্নিক, তার স্বপ্নের মধ্যে জীবনের মৌলিক আগ্রহটাই বড়। সে নেহাতই জৈবিক, কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বাংলার লোকসংস্কৃতির টুকরো-টাকরা স্পন্দিত হয়ে চলে। ব্যক্তি ও সমষ্টির এই সম্পর্ক, পৃথকত্ব আর মিথস্ক্রিয়া বাংলা কবিতায় বিরল। যেখানে ব্যক্তি সামাজিক বিনিময়-সম্পর্কের মধ্যে যৌনতা নিয়েও হাজির হয়ে যায় এবং তা বৈধ করে ফেলে। ফসলের সুষম বণ্টন সেখানে কাম্য হলে দেহ দিলে দেহ পাবে কথাটাও নৈয়ায়িক পরম্পরায় চলে আসে। এই রকম উচ্চারণ যত সরল হোক, এর মধ্যে একটি নতুন রাষ্ট্রের মানুষের আকাঙ্ক্ষার সৌন্দর্য গভীরভাবে পরিব্যাপ্ত।
৩.
কেবল কবিতায় নয়, কথাসাহিত্যেও আল মাহমুদের অবদান অসামান্য। পানকৌড়ির রক্ত , সৌরভের কাছে পরাজিত , গন্ধবণিক তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। কবিতার মতোই, গল্পেও তিনি নির্মাণ করেছেন নিজস্বপৃথক স্বর ও পরিসর। তাতে প্রকাশ পেয়েছে প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষের গভীরজটিল অন্তর্জগৎ। কিন্তু তাতে উপেক্ষিত হয়নি এই ভূখন্ডের সামাজিক বাস্তবতার প্রান্তগুলো, শ্রেণিবিন্যাসগত সংকটের বিভিন্ন রূপ। তবে এখানকার জীবনের পটভূমিতে তিনি বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন মানুষের জৈবিক উন্মোচনের ওপর। সেদিক থেকে কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদ একই সঙ্গে বাস্তবতাবাদী ও ন্যাচারালিস্ট। রিয়েলিজমের সঙ্গে আলংকারিক ভাষার বিরোধ থাকলেও আল মাহমুদ রফা করে নিয়েছেন এই দুয়ের সঙ্গে। ফলে তাঁর গল্পভাষায় আলংকারিকতা মান্য হলেও তা পর্যবেক্ষিত বাস্তবের ওপর চাপ সৃষ্টি করে না। কথাসাহিত্যের এই প্রকরণধর্ম তাঁর বিশেষ ও স্বতন্ত্র অর্জন।
শিশু-কিশোর সাহিত্যেও তাঁর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছড়া, কবিতা, গল্প, স্মৃতিকথা- সবই তিনি লিখেছেন। শৈশবকে উপভোগ করিয়েছেন শিশুর অনুভূতির সহজ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। তাতে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি ইত্যাদি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। কেবল বিনোদনের উদ্দেশ্যে তিনি শিশুসাহিত্য রচনা করেননি, তাতে সঞ্চার করতে চেয়েছেন রূপকার্থ, যা থেকে শেখার মতো বিষয়-আশয় রয়েছে।

I চঞ্চল আশরাফ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top