ইভেন্ট I বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক
প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক। এর পূর্ণ বিবরণসহ সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার নানা দিকে আলো ফেলেছেন আবদুল্লাহ আল কেমী
ইউনিলিভার হেয়ার ব্র্যান্ড ট্রেসেমের উদ্যোগে এবং আয়োজনে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো তিন দিনের ‘ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০১৯’। সহযোগী ছিল ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি)। এ উপলক্ষে বসুন্ধরার আন্তর্জাতিক মিলনায়তন ফ্যাশন ডিজাইনার, ফ্যাশনবোদ্ধা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন ফ্যাশন কৌতূহলীদের পদচারণে ছিল সরগরম। দেশের সবচেয়ে বড় এই ফ্যাশন ইভেন্ট থেকে কিছু প্রাপ্তি ঘটেছে। খুঁটিনাটি ভ্রান্তি-জয়ের অনুশীলন, দিকনির্দেশনা ও নতুন দিক উন্মোচনের বার্তা মিলেছে এখানে।
তিন দিনে উনত্রিশ ডিজাইনার
তিন দিনে প্রদর্শিত হয় মোট ১৯ জন বাংলাদেশি এবং ১০ জন বিদেশি ডিজাইনারের নিজস্ব সংগ্রহ। এগুলোর মধ্যে প্রথম সন্ধ্যায় উপস্থাপিত হয় দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ১০ ডিজাইনারের সংগ্রহ। ডিজাইনাররা হলেন বাংলাদেশের হুমায়রা খান, লিপি খন্দকার, রিফাত রেজা রাখা, সারাহ করিম, সাদিয়া মিশু, ইজমাত নাজ, মুশাররাত রহমান; ভারতের পারমিতা ব্যানার্জি; মালদ্বীপের আয়শাত সামলা ও নেপালের অণু শ্রেষ্ঠা। দ্বিতীয় সন্ধ্যায় হাজির ছিলেন বাংলাদেশের আফসানা ফেরদৌসি, ফারাহ আনজুম বারি, শাহরুখ আমিন, ফাইজা রহমান, রুপো শামস, তাশফিয়া আহমেদ, শৈবাল সাহা; থাইল্যান্ডের সুকাজিত দাংচাই; ভুটানের কেনচো ওয়াংমো ও ভারতের স্বাতী কালসি। শেষ দিনে ৯ জনের তালিকায় ছিলেন বাংলাদেশের মাহিন খান, এমদাদ হক, কুহু প্লামন্দন, চন্দনা দেওয়ান, মারিয়া সুলতানা, রিফাত রহমান; শ্রীলঙ্কার কাঞ্চনা থালপাওইলা ব্রাউন; পাকিস্তানের ফাইজা সামি; মালয়েশিয়ার এড্রিক অং ও ইন্দোনেশিয়ার মারডি সিহোমবিং। আর প্রতিদিন শুরুতেই রানওয়েতে উঠেছে তিনজন মেকওভার আর্টিস্টের করা বিভিন্ন হেয়ারস্টাইল। এঁরা হলেন আফরোজা পারভিন, কানিজ আলমাস খান ও ফারজানা শাকিল।
কৌতূহলী সূচনা
ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০১৯-এর শুরু ছিল রোমাঞ্চকর। ফ্যাশন কৌতূহলী অতিথিদের জন্য ছিল অপেক্ষার পালা শেষ হবার মুহূর্ত। শুরুতেই হেয়ারস্টাইলিং নিয়ে আসেন মেকওভার আর্টিস্ট আফরোজা পারভিন। এরপরেই আসে ডিজাইনারদের পালা। প্রথম দিনে জমকালো আলোকসজ্জায় রকমারি ডিজাইনের ঝাঁজ খুব বেশি বৈশ্বিক আভাস না ফেললেও ভালো মানের কিছু ডিজাইন দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেপালি ডিজাইনার অণু শ্রেষ্ঠার সংগ্রহ। গালিচায় শোভা পায় শ্রেষ্ঠার হাতে বোনা নেপালি সিল্ক ও হ্যান্ড পেইন্টের মার্জিত ও অসাধারণ কিছু ডিজাইন। শুরুর দিনে এই জায়ান্ট ইভেন্ট থেকে দেশীয় ডিজাইনে বেশ কিছু প্রাপ্তি ঘটেছে। দেশি-বিদেশি দশ ডিজাইনারের বদৌলতে আমরা পেয়েছি কিছু অসাধারণ রঙবৈচিত্র্য। মিলেছে ট্রেন্ডি প্যাটার্নের অনিয়মিত ব্যবহারও। বাকি থাকেনি পশ্চিমা ও দেশি মিশ্রণের দিকনির্দেশনা।
দ্বিতীয় দিনের উজ্জ্বলতা
প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনেও একঝাঁক ফ্যাশন বোদ্ধা ও কৌতূহলীদের উপস্থিতিতে সফলভাবে গালিচায় উপস্থাপন করা হয় বিভিন্ন সংগ্রহ। শুরু হয় মেকওভার এক্সপার্ট কানিজ আলমাস খানের হেয়ারস্টাইলিং প্রদর্শনী দিয়ে। এরপরেই আসে একেক করে ডিজাইনারদের সংগ্রহ। প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনেও প্রায় সব ডিজাইনেই ছিল পশ্চিমাপ্রধান প্যাটার্নের ধারা। সুন্দর কিছু ডিজাইন দেখা যায় বরাবরের মতোই। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতের স্বাতী কালসির ডিজাইন। এদিনের প্রাপ্তি সাধারণ প্যাটার্নে কিছু অসাধারণ কাটওয়ার্ক এবং ডার্ট-গ্যাদারের ব্যবহার। রিসাইক্লিংয়ের উদ্দীপনা মেলে ফাইজা আহমেদের ডিজাইনে। আফসানা ফেরদৌসির শৈশব ছিল চিত্তগ্রাহী।
সমাপ্তির মনোহর গালিচা
খুব সাধারণ উপলব্ধি থেকে বলতে গেলে, শেষ দিনের সংগ্রহ ছিল ভালোর মধ্যেও ভালো। আর সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ছিল অন্যদিন থেকে বেশি পেশাদার। শেষ সন্ধ্যার শুরুতে হেয়ারস্টাইল নিয়ে হাজির হন মেকওভার আর্টিস্ট ফারজানা শাকিল। বরাবরের মতো এরই পরে গালিচায় ওঠে ডিজাইনারদের সংগ্রহ। অনেক ভালো ডিজাইনের ভিড়ে অবশ্যই বলতে হয় মালয়েশিয়ান এড্রিক অংয়ের ডিজাইনের কথা, মাহিন খানের সংগ্রহের কথা ও মারডি সিহোমবিংয়ের সেলিব্রিটি গাউনটির কথা। ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রিতে এই দিনের সংগ্রহ থেকে যোগ হতে পারে অনেক নতুনত্ব। ট্র্যাডিশনাল অচেনা মোটিফ, প্যাটার্ন, কালার প্লেয়িং সেসবের কয়েকটি উদাহরণ।
বৈশ্বিক প্রাপ্তি
বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০১৯-এর সমাপ্তির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে কিছু ভালো ডিজাইন। বিশ্ব অঙ্গনে প্রদর্শিত হয়েছে আমাদের ডিজাইন ও ফ্যাশন প্রোডাক্টের বৈচিত্র্য। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর ডিজাইন ও ফ্যাশন প্রোডাক্ট সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। জেনেছি তাদের সঙ্গে আমাদের চিন্তাধারা ও কাজের মিল-অমিল নিয়ে। সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে বৈশ্বিক সেতুবন্ধ। যার শুরু প্রতিবেশীদের হাত ধরেই। কাছের ও দূরের দেশ একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে বড় হতে থাকে কোনো আয়োজন। এভাবেই প্রসারিত হবে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক। বেড়ে চলবে আমাদের বৈশ্বিক প্রাপ্তি। যা হয়তো একদিন বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে ডিজাইনারের দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে। তৈরি পোশাকের মতো আমাদের ডিজাইনের চাহিদাও উপচে পড়বে। তৈরি হবে নতুন দিগন্ত।
কিছু ভ্রান্তির জয়
দেশের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন শো বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক, যাতে আমাদের অভ্যস্ত হতে এখনো বাকি কিছু পথ। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কাঁচা ডিজাইন ছাপ ফেলেছে। কাঁচা ডিজাইন বলা এই কারণে যে, এতে নতুনত্বের দেখা কম পাওয়া গেছে, বরং চলতি সময়ের জনপ্রিয় ফ্যাশনধারা বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। ফ্যাশন উইক তো নতুন স্টাইল এনে দেয়, যা আগাম ফ্যাশনের বার্তাবাহক।
আমাদের মডেলদের জন্য খুব দারুণ একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০১৯। এত বড় শোতে সাধারণত কাজ করা হয় না তাদের। তাই কোনো কোনো জায়গায় ভ্রান্তি পোহানো লাগলেও তা ছিল তাদের জন্য বড় অভিজ্ঞতা। যা কাজে লাগিয়ে তারা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক স্তরে পৌঁছতে পারেন। বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০১৯তে বিদেশি ডিজাইনারদের মধ্যে একটি বিষয় লক্ষণীয় ছিল। তা হচ্ছে, নিজের সংস্কৃতিতে অটল থাকা এবং তাতে পূর্ণতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তাদের ডিজাইনে বারবারই খুঁজে পাওয়া গেছে নিজেদের আঞ্চলিক মোটিফ, প্যাটার্ন, প্রথা ও ঐতিহ্যের নমুনাগুলো। তবে আমাদের অনেকের ডিজাইনেই পুরোপুরি পশ্চিমাকেন্দ্রিক চলমান ফ্যাশনধারা পরিলক্ষিত হয়। যা বৈশ্বিক ফ্যাশনধারার সঙ্গে সাধারণের পরিচয় ঘটালেও বহির্বিশ্বে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় না। একটি ফ্যাশন উইকের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে একেও ধরা হয়। আর বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হলে এই ভূখন্ডের ট্র্যাডিশনকে সঠিকভাবেই উপস্থাপন করতে হবে। বিদেশিদের কাজে এমনটাই দেখা গেছে। তবে, বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক আমাদের নতুন উদ্যোগ, দেশের মাটিতে ফ্যাশন নিয়ে সবচেয়ে বড় আয়োজন।
আমাদের ডিজাইন ও ডিজাইনাররা এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। আর, তাদের মতো পরিবর্তন প্রয়োজন দর্শকদেরও। একটি আন্তর্জাতিক মানের ফ্যাশন ইভেন্ট দেখতে আসা, আসন গ্রহণ করা বা আসন সংরক্ষণ করার মার্জিত কায়দা আছে। সেসব না করলে বা না মানলে হয়তো অনেকেরই কিছু যায় আসবে না। তবু তাতে এসব বড় ইভেন্ট এগিয়ে যেতে পারে না। বৈশ্বিক যাত্রায় এমন অসচেতন আচরণ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের বৈশ্বিক ফ্যাশনযাত্রার এই শুরু মাত্র। চলতে হবে বহু পথ। একদিন কার্ল লেগারফেল্ড জন্মাবে এই মাটিতেও। আমাদের ডিজাইন চাহিদাও থাকবে তুঙ্গে। কিন্তু সে চলার পথ গতিময় রাখা জরুরি। তাই নিয়মিত হওয়া জরুরি বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের মতো এমন জায়ান্ট ফ্যাশন ইভেন্ট। যা আমাদের আরও পেশাদার করবে, বৈশ্বিক প্রাপ্তির একেকটি দরজা খুলে দেবে।
ছবি: সৈয়দ অয়ন