ছুটিরঘণ্টা I নববর্ষে আয়ুথায়া শহরে জলবর্ষণ
আয়ুথায়া, শহরটি চতুর্দশ শতকে স্থাপন করেন যে রাজা, তার উপাধি বা পোশাকি নাম ছিল রামাতিবোধি। রাম রাজাটির রাজধানীর নাম অযোধ্যা হবে, তাতে আর বিচিত্র কী? লিখেছেন মঈনুস সুলতান
তেবোলাজ হোটেল— যা আমাদের নিজস্ব জবানে হবে দেবরাজ হোটেল; এর জানালাটি আকারে মস্ত এবং প্রকারে নাট্যমঞ্চবিশেষ। পর্দা টেনে দিতেই চোখে পড়ে একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি সেতু। পুলটির নিচ দিয়ে অতি ধীরে পার হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা চার-চারটি বার্জ। বার্জগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটি টাগবোট। নদীতে মৃদু-মন্দ দোলে ছনে ছাওয়া চার চালা ঘরের আকৃতির একটি নৌকা। একটু নজর করে তাকাতেই বুঝতে পারি, নৌকাটি মূলত কোনো নৌযান নয়, বরং ভাসমান একটি রেস্তোরাঁ। জানালা দিয়ে প্রায় পুতুলাকৃতির যুগলকে কফি পান করতে দেখা যায়। একটি বাহু জানালার বাইরে দৃশ্যমান হয়। হাতটিতে চেইনযুক্ত ঘড়ি বা বালার ধাতব মসৃণতা সূর্যালোকে ঝিকিয়ে ওঠে। মনে হয়, হাত থেকে কিছু একটা শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো। একটি পাখি দ্রুত উড়ে এসে বস্তুটি জলে পড়ার আগেই চঞ্চুতে তুলে নেয়। নিক্ষেপ কর্মের আরও বার কয়েক পুনরাবৃত্তি হয়। পাখিটি চক্রাকারে ওড়ে, নিক্ষেপের গতির সঙ্গে তার ডানার ছন্দময়তা মাছের সঙ্গে বড়শির সম্পর্কের মতো ক্রিয়া করে।
দেখতে দেখতে আমার চোখ ক্লান্ত হয়ে আসে। আমি নদীর পাড়ে সড়কটির দিকে তাকাই। ঢ্যাঙ্গা মতো এক সারি গাছের নিচে খানকতক টুকটুক নামের একটু বড় আকারের টেম্পো। একজন পা-হীন পথচারী হাত-প্যাডেল মেরে মেরে হুইলচেয়ারে করে চলে যায়। সহসা হুইল চেয়ারের গতি এলোমেলো বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে। মনে হয়, রঙধনু রঙের তরল কিছু তীব্র গতিতে এসে পা-হীন পথচারীর চোখে-মুখে পড়ছে। তরলটি আবার নিক্ষিপ্ত হতেই বুঝতে পারি, এটি জলের ধারা। আমি ধারাটির উৎস সন্ধান করি। পথের পাশে একটি দোতলা নজরে আসে। ব্যালকনিতে জনাতিনেক কিশোর ও একটি কিশোরী। সড়ক দিয়ে ছুটে আসে একটি মোটরসাইকেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যালকনি থেকে দীর্ঘ পাইপ যোগে নিক্ষিপ্ত হয় তীব্র জলধারা। বাইকটি যেন হোঁচট খেয়ে দুমড়েমুচড়ে পড়ে যায়। খানিক দূরে ছিটকে পড়ে গোলাপি বর্ণের বৃহৎ একটি পার্স। একজন তরুণী অতিকষ্টে বাইকটি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। সাইকেলের কিছু একটায় তার স্কার্ট আটকে গেছে। ঠিক তখনই তার উপর আবার বর্ষিত হয় চারদিক থেকে রঙধনুর বর্ণিল জলধারা।
গতকাল আমি, হলেন ও আমাদের কন্যা কাজরি আয়ুথায়া (যা আমাদের ভাষায় উচ্চারিত হবে অযোধ্যা) শহরের তেবোলাজ বা দেবরাজ হোটেলে এসে উঠেছি। এ মুহূর্তে হলেন পোলারয়েড ক্যামেরায় তোলা বিশাল একটি অশ্বত্থ-বটবৃক্ষের ছবির দিকে ধুন ধরে চেয়ে আছে। গতকাল বিকেলে আমরা শহরটিতে খানিক ঘুরে বেড়াই। তখন ঝুরি-নামা বিপুল আকারের বৃক্ষটির শিকড়ে গৌতম বুদ্ধের মস্তকের মূর্তি দেখে দারুণভাবে আশ্চর্য হয়েছিলাম! থাইল্যান্ডের এ শহরে আমাদের আগমনের হেতু হচ্ছে নববর্ষের জল উৎসবে শরিক হওয়া। আমার স্ত্রী-কন্যা বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর এ সুযোগে আমি জানালায় দাঁড়িয়ে জলকেলির যে রূপ দেখি, তাতে উৎসব গমনের হিম্মত উবে যায়। তো খানিক ভেবেচিন্তে কাজরি ও হলেনকে উদ্দেশ করে বলি, ‘যেভাবে জল ছোড়াছুড়ি হচ্ছে তাতে মনে হয় বাইরে আজ না যাওয়াই সংগত।’ তার মুখভঙ্গিতে বুঝতে পারি, হলেন আমার মন্তব্যে স্পষ্টত বিরক্ত হচ্ছে। কাজরিও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলে, ‘নো প্রবলেম বাপি, আই হ্যাভ আ লিটল আমব্রেলা ফর শান্তিবালা, শি উইল নট গেট ওয়েট।’ শান্তিবালা আমাদের কোনো আত্মীয়া নয়। সে হচ্ছে ডাগর চোখের কৃষ্ণাঙ্গী একটি পুতুল। আমাদের কন্যাটির মনে হলো বাস্তব বুদ্ধি পুরোমাত্রায় আছে। জল উৎসবে বর্ষণের সম্ভাবনার কথা ভেবে সে শান্তিবালার জন্য একটি ছাতার ব্যবস্থা করে রেখেছে। কন্যার মা—যাকে আমি কখনো ঠিক বুদ্ধিমতী বিবেচনা করি না, তার হাতে একটি বর্ষাতি দেখে মুহূর্তে আমার মতামত পাল্টে যায়। সে হাতব্যাগ থেকে বের করে আরেকটি শিশুতোষ বর্ষাতি আমাকে দেখায়। বুঝতে পারি, মা, মেয়ে, ও পুতুল সকলেরই জলবর্ষণ থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে। সুতরাং, বাবা হয়ে আমি না হয় খানিক ভিজলামই। অতঃপর আমরা সকলে বেরিয়ে পড়ি। রাজপথে আসতেই দেখি, ছোট্ট একটি শিশুকে জল ছুড়ে প্রচন্ডভাবে ভেজানো হচ্ছে, বাচ্চাটিও একটি জলবন্দুক হাতে খুশিমনে সিক্ত হচ্ছে। এসে আমি কোনো রিস্ক না নিয়ে জানালার কাচতোলা একটি এয়ারকন ট্যাক্সিতে সপরিবার চাপি।
আয়ুথায়া— যাকে আমি অযোধ্যা বলতে ভালোবাসি, শহরটি চতুর্দশ শতকে স্থাপন করেন যে রাজা, তার উপাধি বা পোশাকি নাম ছিল রামাতিবোধি। রাম রাজাটির রাজধানীর নাম অযোধ্যা হবে, তাতে আর বিচিত্র কী? আমরা সপরিবার চলি তার ছাইভস্ম যে স্তূপাতে রাখা হয়েছে—তা দেখতে। পথে বার কয়েক আমাদের ট্যাক্সিতে জল বর্ষিত হয়। একবার নববর্ষে বিভোর যুবক-যুবতীরা আমাদের দিকে ছুড়ে দেয় চালের গুঁড়ায় তৈরি লেই জাতীয় তরল। জানালায় কাচ তাতে যেন বসন্ত রোগে গুটিময় হয়ে ওঠে। আমাদের ট্যাক্সিকে বারবার অতিক্রম করে যায় অনেকগুলো পিকআপ ট্রাক। তাদের পেছনে রাখা জল-পূর্ণ মস্ত মস্ত পিপা। জলের মটকা ঘিরে দাঁড়ানো ভেজা কাপড়ে কিশোর-কিশোরী। সবারই হাতে পিচকারি জাতীয় জলবন্দুক। পিকআপগুলোর মধ্যে বার কয়েক জল-যুদ্ধ হয়ে যায়।
অবশেষে আমরা ওয়াট প্রাসি-সানপেটের কাছাকাছি একটি বাজারে এসে নামি। ওয়াট প্রাসি-সানপেট এলাকায় একসময় রাজা রামাতিবোধির প্রাসাদ ও মন্দির ছিল। বর্তমানে এই এলাকা ভগ্নস্তূপবিশেষ। পাশের বাজারে প্রচুর খেলনা, শুকনো ফল, নকশা করা তাঁতের কাপড় ও ঝিনুকের ঝুলন্ত বাজনা ইত্যাদি ডাই করে রাখা। একটি দোকানে বিক্রেতা তরুণী চেয়ারে বসে মগ্ন হয়ে পত্রিকায় ক্রসওয়ার্ড পাজল খেলছে। এখানে পর্যটকের সমাবেশ হয়েছে প্রচুর। আমাদের উদ্দেশ্য প্রাসাদের ভগ্নস্তূপের দিকে যাওয়া। কিন্তু কাজরি আমাদের সঙ্গে একমত হয় না। তার ধারণা, মৃত পুরাকীর্তির চেয়ে জীবন্ত খেলনা অনেক বেশি আনন্দদায়ক। তাই আমাদের বাজারের দিকে মনোযোগী হতে হয়। আমরা কন্যাকে অনুসরণ করে নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র ও কাচের জন্তু-জানোয়ারে পূর্ণ একটি দোকানের দিকে আগাই। ঐতিহ্যবাহী থাই তাঁতের নকশাময় বর্ণাঢ্য পোষাকপরা এক যুবতী, কাঁখে তার রঙিন মৃৎপাত্র নিয়ে দর্শকদের চোখে যেন তার শরীর খোদাই করে চলে যায়। পর্যটকদের মধ্যে ছবি তোলার খানিক তরঙ্গ ওঠে। এক জাপানি পর্যটক তার ক্যামেরার লেন্স বদলায়। যুবতীটি তাকে ক্লোজআপে পোজ দিচ্ছে— এমন ভঙ্গিতে তার কাছাকাছি যায়। তারপরই ঘটনাটি ঘটে। জলপূর্ণ ঘটটি উপুড় হয় পর্যটকের অর্ধেক টাক, অর্ধেক চুলে ছাওয়া মস্তকে! বেচারা জাপানি নিজস্ব ভাষায় কাউমাউ করে। আমরা সবাই এই আচরণে আঁতকে উঠি। আমাদের চারপাশে আরও জনা তিনেক মৃৎপাত্র হাতে যুবতীর আবির্ভাব হয়। তাদের চলনের ভঙ্গি লাস্যময়। কিন্তু আমরা সে ছলনায় ভোলার মতো বেকুব নই। তাই কাজরিকে চটজলদি কোলে তুলে দৌড়াতে শুরু করি। দেখি, পথের পাশে কপালে আলপনা আঁকা একটি হাতির দিকে হল্লা করে জল ছোড়া হচ্ছে। আমাদের পিঠে এসেও লাগে পানির ছিটা। অবশেষে ছুটতে ছুটতে আমরা ভগ্ন প্রাসাদ ও মন্দিরের দেউড়িতে এসে পৌঁছাই।
প্রায় ছয় শ বছরের পুরোনো প্রাসাদ ও মন্দিরের চত্বরে ঘরবাড়ির কিছু আর অবশিষ্ট নেই। আপাতত সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, খান কতক ভাঙা দেয়াল, একটি সর্পিল হ্রদ ও এক সারি বৌদ্ধস্তূপা। স্তূপাগুলো ইটে গড়া বিশাল সব প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্মিত। তাদের নিম্নদেশ মোরাদাবাদী গোলাপপাশের মতো গোলাকার, তবে ওপরের অংশটুকু কুমারের চাকের মতো চক্রে চক্রে স্পাইরাল হয়ে উঠে গেছে আকাশ পানে। কাজরি একটি স্তূপার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। হলেন হাতব্যাগ থেকে খান তিনেক বই বের করে পাতা উল্টায়। আমি তাকে আয়ুথায়ার স্তূপাগুলোর আকৃতির ভিন্নতার কথা বলি। সে আমাকে একটি ছবি দেখিয়ে জানায়, এ স্মৃতিসৌধগুলো ‘চেডী’ নামে খ্যাত। হলেন কৈশোর ও যৌবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছে মার্কিন দেশের গোটা তিনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে একটি উপসর্গ যোগ হয়েছে যে, সে যেখানে যাবে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া চাই ওই এলাকার ওপর গোটা কতক গ্রন্থ। এতে ইতিহাস ও তত্ত্ব নিয়ে না ভেবে কেবল চাক্ষুষভাবে কিছু দেখে যাওয়া মুশকিল। থেকে থেকে বই ঘাঁটাঘাঁটি সহজাত ভ্রমণের অন্তরায় বটে। তবে এতে ফায়দাও আছে। আমি কেবল দেখেই যাই। একটু গভীরভাবে জানতে ইচ্ছা হলে পাঠিকাটির শরণাপন্ন হই। আমি জানি যে, পাঠ করার পর সে তা বলার জন্য অধীর হয়ে আছে। কাজরি একটি চেডীর আড়াল থেকে কু-ধ্বনি দেয়। আমরা দুজনে প্ল্যাটফর্মে উঠে লুকোচুরিতে শামিল হই।
ছোটাছুটির উত্তেজনা একটু প্রশমিত হতেই দেখি, হলেন আরেকটি চেডীর ছায়ায় প্রকান্ড এক পুস্তক খুলে প্রাসাদ প্রাঙ্গণের মানচিত্র পর্যবেক্ষণে বিভোর হয়েছে। সে স্বগতোক্তির মতো বলে, ‘ওই চেডীগুলোর একটিতে রাজা রামাতিবোধির দেহভস্ম রক্ষিত আছে, কিন্তু কোন চেডীটি রাজভস্ম ধারণ করে আছে, তা নির্দিষ্টভাবে কোথাও উল্লেখিত হয়নি।’ আমি সবচেয়ে উঁচু ও বৃহৎ চেডীর দিকে নির্দেশ করি। আমার মতামতের মূলে তত্ত্বগত কোনো ভিত্তি নেই, আছে কেবল আন্দাজ। হলেন মানচিত্রের উপর আঙুল রেখে আমাকে বলে, ‘এককালে এ চত্বরে সাতটি ‘মহাপ্রাছাৎ’ নামের রাজকীয় দালান ছিল। আমরা দালানগুলোর ভগ্নাবশেষের সন্ধানে চারদিকে তাকাই। এককালের পূজা-পার্বণ, আদেশ-ফরমানে ভরপুর রাজগৃহগুলো বিলুপ্ত হয়ে চত্বরটি টিকিট উপড়ে ফেলা মলিন ঈষৎ ছিন্ন খোলা খামের মতো পড়ে আছে। হলেনের মতো তত্ত্ব আমাকে তেমন ভাবায় না, তবে কিছু পোশাকি শব্দ মুহূর্তের জন্য ভাবনাকে আন্দোলিত করে। ভাবি থাই ভাষায় ‘মহাপ্রাছাৎ’ শব্দটি কি আমাদের চেনা ‘মহাপ্রাসাদ’ থেকে জাত।
কাজরির লুকোচুরি শেষ হয়েছে। সে চত্বরের দিকে হাঁটে। আমরা তাকে অনুসরণ করি। পুরোনো দিনের হ্রদটি আকারে সর্পিল। স্থানে স্থানে গোলাকার হয়ে নানা প্রাঙ্গণকে পৃথক করে রেখেছে। আমরা প্রথম বন্ধনীর মতো বাঁকা কাঠের সেতুর ওপর দিয়ে একটি আঙিনায় ঢুকি। ইটের কেয়ারি করা নকশা দেখে আঙিনাটি যে একসময় বাগান ছিল, তা বেশ বোঝা যায়। হলেন আবার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বলে, ‘এ প্যালেস ক্যাম্পাসে দুটি বাগান ছিল, একটি সোয়ান-আংগুন বা আঙুরের বাগান, এবং অন্যটি সোয়ান ক্রেতাই বা খরগোশের বাগান।’ সোয়ান আংগুন শব্দটির সঙ্গে আমাদের আংগুর শব্দের সাযুজ্যের কথা তাকে বলি। কিন্তু সে শব্দের চেয়ে তত্ত্ব ও মানচিত্রে অধিক আগ্রহী। আরও গোটা দুই পাতা উল্টিয়ে বলে, ‘এখানে কোথাও রাজকুমারের খরগোশ বাগানটি ছিল।’ কাজরি আমাদের আলোচনায় যোগ দিয়ে জানায়, ‘আই থিংক রাবিট গার্ডেন ওয়াজ হিয়ার, বাট আই ডোন্ট সি এনি রাবিট।’ আমরা একটি কাল্পনিক খরগোশের খোঁজে রাজকীয় বাগিচার সর্বত্র হাঁটি। কাজরি হাতি চড়ার জন্য নির্মিত একটি মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আসে। আমরা হ্রদের পাড় ধরে আস্তে আস্তে দেউড়ির দিকে হাঁটি। হ্রদের ওপারে ইটে গড়া একটি তোরণ আমাদের দৃষ্টিতে নবতর প্রেক্ষিত যোগ করে। হ্রদের ঢালু পাড়ে দীর্ঘ লিকলিকে ঘাস। দুটি বক অতি ধীর পায়ে হাঁটে। বক দুটো পরস্পরের দিকে তাকায়, তারপর হেঁটে যায় দুই বিপরীত দিকে। ঘাসের একটি সবুজ গুচ্ছে কাজরি কম্পন নজর করে। সে উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘মে বি এ খরগোশ ইজ্ হাইডিং দেয়ার।’ আমরা পিতাপুত্রী খরগোশের খোঁজে একটু ঝুঁকে ঘাসের দিকে তাকাই। ঝটপট করে নীলাভ ডানা মেলে একটি নাম না জানা পাখি উড়াল দেয়। বেশ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করলে আমাদের চলার গতি হয় দ্রুততর।
আমরা আধভেজা হয়ে ইটে গড়া সুড়ঙ্গ-টানেলের কাছে এসে দাঁড়াই। হলেন হাতব্যাগটি বুকের কাছে চেপে ধরে ভ্রমণ-পুস্তকগুলোকে বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কাজরি উবু হয়ে টানেলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা, সাম পিপল আর হাইডিং দেয়ার।’ বলেই সে টানেলে ঢুকে যায়। বাইরে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। সুড়ঙ্গটি শুকনো। তার এক কোনায় বসে আছেন গৈরিক পরা মুন্ডিত-মস্তক এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। ভিক্ষু হাসিমুখে একটু সরে আমাদের বসার জায়গা করে দেন। একটু দূরে জড়সড় হয়ে বসেছে রঙিন লুঙ্গি পরা দুই যুবতী। হলেন তাদের লুঙ্গির নকশার দিকে তাকিয়ে আমাকে ফিসফিসিয়ে বলে, এ ডিজাইন বার্মিজ। একটি যুবতী পরিষ্কার ইংরেজিতে জানায়, ‘উই আর ফ্রম বার্মা।’ ভিক্ষু তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলেন, ‘উই আর মন পিপল। উই আর মন নেশন।’ আমরা বুঝতে পারি, তারা বার্মার মন সম্প্রদায়ের লোক। আমি জিজ্ঞেস করি, তারা থাইল্যান্ডে কত দিন হয় আছেন? ভিক্ষু জবাব দেন, ‘এলেভেন ইয়ারস। উই আর রিফিউজিস।’ তরুণী দুটির মধ্যে ‘মন’ ভাষায় কথা চালাচালি হয়। তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝতে পারি, আমিই তাদের আলোচ্য। হুড়মুড় করে এক বয়স্ক পর্যটক দম্পতি সুড়ঙ্গে ঢোকেন। আমরা সকলে সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দিই। মহিলা তার সঙ্গীকে একটি শুকনো রুমাল দেন। পুরুষটি তার গা-গতর ও ক্যামেরার লেন্স মুছে সুড়ঙ্গের ছাদের দিকে এবং পরে সবার দিকে তাকান। মহিলাও আমাদের দিকে তাকান, যেন ঠিক বুঝতে পারছেন না কী করা তার কর্তব্য। হলেন—এনারা কোথা থেকে এসেছেন তা জানতে চায়। জবাব আসে, বেলজিয়াম। মহিলা আমরা লাওস থাকি শুনে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। জিজ্ঞেস করেন, লাওসের ভিয়েনচান শহরে ফরাসি খাবার পাওয়া যায় কি না? হলেন গোটা কয়েক রেস্তোরাঁর নাম করতেই উনি ছোট্ট একটি নোটবুকে তা টুকে নেন।
বাইরে বর্ষণের বিরাম হয় না। আমরা সুড়ঙ্গে বসে পরস্পরের সঙ্গে টুকটাক কথা চালাচালি করি। কাজরির পুতুল শান্তিবালা এক কোণে প্লাস্টিকের খেলনা স্টোভ, ডেগ-ডেকচি, পিরিচ-পেয়ালা নিয়ে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে শান্তিবালা ও কাজরি সকল সুড়ঙ্গবাসীকে পরিবেশন করে ছোট্ট ছোট্ট পিরিচে করে কৃত্রিম আহার। খাওয়া শেষ হতেই বেলজিয়ামের দম্পতি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে শান্তিবালার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে ধন্যবাদ জানান। ঠিক তখন সুড়ঙ্গে এসে ঢোকে ভিজে কাপড়ে জলবন্দুক হাতে এক থাই কিশোরী। মেয়েটির বসন সম্পূর্ণরূপে সিক্ত। সে জড়সড় হয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। মনে হয়, সে তার ভিজে শরীর নিয়ে বড়ই বিব্রত। তার চুল থেকে টুপটাপ ঝরে বিন্দু বিন্দু জল। কাজরি তার জলবন্দুকের দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকায়। সে বলে, ‘ক্যান আই হ্যাভ আ ওয়াটারগান?’ থাই কিশোরী যেন তার প্রশ্নটি বুঝতে পারে। সে মেঝেতে হাঁটু ঘষতে এগিয়ে এসে কাজরির হাতে তুলে দেয় তার জলবন্দুকটি। আমি বৌদ্ধ ভিক্ষু বা বেলজিয়ামের দম্পতির জলসিক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা ভেবে আঁতকে উঠি। কিন্তু কাজরি আমাদের অবাক করে দিয়ে পুতুল শান্তিবালার ওপর বর্ষণ করে বন্দুকের তরল গোলা। এ সুড়ঙ্গবাসের আধো-অন্ধকারের মধ্যেও হলেন ভ্রমণপুস্তকের পৃষ্ঠা ওল্টায়। তার দৃষ্টি চকচকে হয়ে ওঠে। সে বলে, ‘এ টানেলটি একসময় ছিল রাজার পলায়ন পথ!’ আমরাও এখান থেকে আজ পলায়নের উপায় খুঁজি।
ছবি: লেখক