ঘরেবাইরে I শিল্পিত অন্দর
শিল্পকর্মের সঙ্গে বসবাস ভ্রমণপিপাসু এই দম্পতির। মানে দেশ-বিদেশের চিত্রকর্ম, সরা, মৃৎশিল্প, নকশিকাঁথায় সাজানো অন্দরের বর্ণনা দিয়েছেন পীযুষ কান্তি সরকার
বিশ্বজিৎ গোস্বামী আর বৃষ্টি তানিয়া। দুজনই চিত্রশিল্পী। লালন করেন বাংলার সংস্কৃতি। ভ্রমণ তাদের শখ। বেড়িয়ে আসা সেই সব জায়গার স্মারক দিয়েই সাজান নিজেদের অন্দর। তবে তাতে প্রাধান্য পায় বাংলার লোকশিল্প। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে— যেখানেই যান না কেন, কোনো দেশের লোকজ জিনিসপত্র তাদের সংগ্রহের প্রথম তালিকায় থাকে। বাড়ির প্রধান ফটক পার হয়ে ঢুকতেই মনে হবে এ এক অন্য জগৎ। নজর কাড়বে ভেতরে ব্যবহৃত কালার স্কিম। দেয়ালে মাটি আর অ্যারাবিক গামের প্রলেপ। ফলে মাটির ঘরের আবহ তৈরি হয়েছে।
এক পাশে বসার ঘর, অন্য পাশে ডাইনিং এরিয়া— দুই পাশে একই রঙের ব্যবহার। বসার ঘরটিতে হালকা আলো। পেইন্টিং বলতে শিল্পীর নিজে আঁকা বেশ বড় একটা ফিগারেটিভ পেইন্টিং। সাদা-কালো আর দুপাশে ভারতের শিল্পী কে জি সুব্রামানিয়ামের আঁকা দুটি পেইন্টিং। বসার জন্য বিশেষভাবে তৈরি সোফা। দুই পাশে রেখেছেন নানা রকমের বইপত্র। বেশির ভাগই শিল্পকলা-সম্পর্কিত। বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে রেখেছেন মাটির তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম। এগুলোর অধিকাংশ বিভিন্ন মেলা থেকে সংগৃহীত। আরও রেখেছেন বিভিন্ন সময়ে তার কাজের অর্জিত পুরস্কারগুলো।
ঘর সাজাতে দুজনই পছন্দ করেন, তাতে শিল্প-সংস্কৃতি কিংবা বাংলার প্রতি ভালোবাসা পরিস্ফুট। পেইন্টিং সংগ্রহের নেশাটা তাদের বেশ পুরোনো। বিভিন্ন প্রদর্শনী অথবা শিল্পীর স্টুডিও থেকে শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছেন। ড্রইংরুমে ঢুকলেই সেটা বেশ টের পাওয়া যায়। নিজেদের পেইন্টিং তো আছেই, ভারত, চীন, জাপান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বাংলাদেশেন রফিকুন নবী, শিশির ভট্টাচার্য্য, কনকচাঁপা ও অন্য শিল্পীদের পেইন্টিংও আছে তাদের সংগ্রহে। আনন্দ কিংবা সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যই হোক, তারা ঘরের ভেতরের পেইন্টিংগুলো মাঝেমধ্যে পরিবর্তন করেন। ছবিগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বসার ঘরটি করে রেখেছেন বেশ ছিমছাম। ফ্লোরটা বাঁশের তৈরি, কার্পেট হিসেবে ব্যবহার করেছেন রংপুরের শতরঞ্জি; তবে মাঝে মাঝে চীনের ও রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী কার্পেটেও ঢেকে দেন মেঝে।
আগেই বলা হয়েছে, শিল্পী দম্পতি ঘুরতে ভালোবাসেন। যেখানেই যান না কেন, সেখান থেকে তারা সংগ্রহ করেন ওই অঞ্চলের আদি কোনো শিল্পকর্ম। আর সেগুলো দিয়ে তারা নিজেদের শিল্পভুবনকে আলোকিত করেন।
পড়াশোনার সুবাদে দুজনেই থেকেছেন শান্তিনিকেতনে। সেখান থেকে সংগ্রহ করেছেন ডোক্রা। মৃৎশিল্পের প্রতি ভীষণ আগ্রহ বৃষ্টির। শান্তিনিকেতনে কিছুদিনের জন্য মৃৎশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাই তাদের ডাইনিং এরিয়াটা অন্য রকম। যদিও কাঁসা-পিতলের থালাবাসন এ দম্পতির প্রথম পছন্দ। নিজের দেশ তো বটেই, অন্য দেশ থেকেও তারা নানা তৈজসপত্র সংগ্রহ করেছেন। টেবিলে প্রতি সপ্তাহে তাজা ফুল রাখতে পছন্দ করেন তারা।
ঘর সাজানোয় তাদের আরেকটা উপাদান হচ্ছে সরা। লক্ষ্মী, দুর্গাসহ ভারত ও মিয়ানমারের বিভিন্ন রকম সরা তাদের বসার ঘর আর ডাইনিং এরিয়ায় শোভা পাচ্ছে। শোবার ঘরটি কিন্তু মিনিম্যালিস্টিক। বাড়তি কোনো জিনিসপত্র নেই, একটা খাটই পুরো ঘরকে শিল্পময় করে রেখেছে। এটি বেশ পুরোনো। এর উপর আছে নকশিকাঁথা, একটি এ দেশের, অন্যটি চীনের। হাতে তৈরি।
এ দম্পতির ভুবনে আরেকজন শিল্পী— নাম বরিষধরা। পুরো বাড়িতে তার শিল্পকর্ম। দেয়াল, আসবাব— কিছুই বাদ যায়নি। এই শিল্পকর্মগুলোয় আরও সুন্দর হয়েছে তাদের অন্দর।
লেখক: শিক্ষক, চিত্রশিল্পী
ছবি: লেখক