বিশেষ ফিচার I রোজা ও ঈদে স্বাদসুখের কলকাতা
বৈচিত্র্যময় স্বাদে ভরে ওঠে কলকাতা, রোজার মাসে আর ঈদের উৎসবে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের দোকান, মসজিদ প্রাঙ্গণ, বাড়ির ডাইনিং—সবখানেই উদরপূর্তির আয়োজন। লিখেছেন পাঞ্চালি দত্ত
রমজানের সময় সারা দিন সিয়াম সাধনার পরে খাবার খাওয়ার আকুলতা কার থাকবে না, বলুন তো! আফটার অল পেট কা সওয়াল। পেটের এই খিদে মেটানোর জন্য লোকের দিনরাত ছোটা। খিদে এমনই একটা বিষয়, যাকে নিবৃত্তির জন্য মানুষ অনেক সময় অসৎ পথেও পা দিয়ে ফেলে। তবে সিয়ামের মাহাত্ম্য এমনই যে, এটা থেকে আমরা শিখতে পারি যেকোনো ক্ষুধায় সংযমের দরকার। জীবনের কোনো জিনিস যাতে লাগামহীন না হয়। ধর্মীয় উৎসব এভাবেই প্রথাগুলোর মাধ্যমে আমাদের সামাজিক বা মানসিক বোধে চালিত করে।
যেহেতু খাবার নিয়েই আমার চর্চা, তাই এপার বাংলা থেকে আমি কলকাতার ঈদের বিভিন্ন খাবার নিয়ে আজ গল্প করব। হোক না রমজানের সংযম, কলকাতার আনাচে-কানাচে যে রকমারি খাদ্যসম্ভারে ভরে যায় রেস্তোরাঁ বা ফুটপাত, সেই খাবারের ডাকে সাড়া না দিয়ে কি থাকা যায়? রোজা ভাঙার ঘণ্টাখানেক আগ থেকেই দোকানগুলোয় ভাজাভুজির প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বেগুনি, পেঁয়াজি, আলুর বড়া, আলুর চপ, ঘুগনি, হালিম, পরোটা, আলু পরোটা, সেমাই, মাংসের নানা রকম কাবাব আর নানা রকম পদে সেজে ওঠে ছোট দোকানই বলুন কিংবা নামকরা রেস্তোরাঁ। ফলের দোকানে গ্রীষ্মকালীন রঙবেরঙের নানা রকম ফল। আনারস, পেঁপে, খেজুর, কলা, তরমুজ, জামরুল, মৌসাম্বি ইত্যাদি ফল কেটে সুন্দর করে শালপাতায় বিক্রি করা হয়, যা দিনমান অভুক্ত থাকার পর খুব জরুরি। বড় হাঁড়িতে করে হালিম বিক্রি হয় শহরের বিভিন্ন জায়গায় এই রমজান মাসে। নানা রকম ডাল, মাংস, ডালিয়া, চাল ও সুগন্ধিযুক্ত মসলায় এই হালিম খুবই উপকারী, ফুল মিল হিসেবে। কলকাতায় হালিম শুধু ছোটখাটো দোকানেই নয়, নামকরা রেস্তোরাঁগুলোয়ও পাওয়া যায়।
বড়বাজারের জাকারিয়া স্ট্রিট এবং রবীন্দ্র সরণির ক্রসিংয়ে অবস্থিত প্রসিদ্ধ মসজিদ হলো নাখোদা। ১৯২৬ সালে এটি তৈরি হয়। এখানে একসঙ্গে দশ হাজার লোক প্রার্থনায় শামিল হতে পারেন। গ্রানাইট পাথরে তৈরি এই মসজিদের প্রবেশদ্বার সম্রাট আকবরের ফতেহপুর সিক্রির ‘বুলন্দ দরওয়াজা’র ধাঁচে বানানো; এবং মসজিদের অন্যান্য কারুকার্যও দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। জাকারিয়া স্ট্রিটকে উপভোগ করার সবচেয়ে ভালো সময় হলো রমজান মাস। চারপাশে জামাকাপড়ের দোকান, সাজগোজের জিনিসপত্রের ফুটপাত স্টল, নানা রকম খাবারের দোকান। সেমাই, পরোটা, জিলাপি, হালিম, কাবাব ইত্যাদি নিয়ে হাজির থাকে সেগুলো। রমজান স্পেশাল ‘আমিনিয়া’র হালিম কলকাতায় বিখ্যাত। সন্ধেবেলা এই হালিম চাখার জন্য লাইন পড়ে যায় দোকানের সামনে। নাখোদা মসজিদের উত্তরে জাকারিয়া স্ট্রিটের আরেকটি অত্যন্ত পছন্দের রেস্তোরাঁ হলো রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল। এক শ বছরের পুরোনো এই রেস্তোরাঁয় পাবেন মোগলাই খাবার, যেমন—মসলাদার নানা রকম বিরিয়ানি, চপ ও কাবাব। প্রসিদ্ধ সুতলি কাবাব খেতে চাইলে গন্তব্য হতে পারে সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের কাছে আলম’স। এর কাবাবের স্বাদ একবার চাখলে বারবার ওখানে আপনার পা পড়বে—গ্যারান্টি দিয়ে এটুকু বলতে পারি। রমজানের সময় কলুটোলার ছোট মসজিদের বাইরেও পাওয়া যায় রোস্টেড চিকেন, বিরিয়ানি, নানা রকম ফ্লেভারযুক্ত কাবাবের বাহার। ধর্মতলা স্ট্রিটের বিখ্যাত টিপু সুলতান শাহি মসজিদের পাশে হগ মার্কেটের এবানের ইউপি বিহার রেস্তোরাঁয় রমজানের খাবার অবশ্যই চাখতে যাবেন এ সময়। বিরি কাবাব, স্টু, চিকেন, মাটন রোল আর ফিরনির স্বাদে রয়েছে আলাদা ‘স্পর্শ’, যা দেয় অনন্য অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া ট্র্যাডিশনাল মোগলাই খাবারের আস্বাদে নিজের রসনাতৃপ্তি করতে চাইলে চলে যেতে পারেন বউবাজারের প্রিন্সেস স্ট্রিটের সাবির’স হোটেলে। এই দোকানের অত্যন্ত জনপ্রিয় পদ হলো চিকেন/ল্যাম্ব/মাটন রেজালা।
রোজা পেরিয়ে ঈদ। নজরুলের গান ধরে বলা যায়, রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ। আর পশ্চিমবঙ্গের ঈদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ফিরে যেতে হয় স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ের কিছু কথায়। ১৯৪৬-৪৭-এর রাজনৈতিক অস্থিরতায় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাঙন ধরার ফলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একে অপরের আনন্দে শামিল হওয়ার মধ্যে দ্বিধা যোগ হতে থাকে। কলকাতার অনেক মুসলিম পরিবারের ছিন্নমূল হয়ে পূর্ববঙ্গে চলে যাওয়া এবং পূর্ববঙ্গের কিছু পরিবারের এপারে আসার ফলে উভয়ের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, সামাজিক বিভেদ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর বেঁচে থাকার লড়াই—এ সবকিছু মিলিয়ে বিপন্ন অস্তিত্বকে ফিরিয়ে আনার জন্য চূড়ান্ত জীবনযুদ্ধে শামিল সবাই। যেন উত্তাল সমুদ্রে সাঁতরানো। কূল নেই, লক্ষ্য নেই, দিক নেই, শুধু খড়কুটো আঁকড়ে ভাসতে ভাসতে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু অর্জন করাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল মূল উদ্দেশ্য। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার বেশ কিছু এলাকার বাসিন্দারা ওপারে না গিয়ে এখানেই মাটি আঁকড়ে পড়ে রইলেন। কারণ কৃষিজমি, রেশমশিল্প। গ্রামগুলোতে তখন রোজা বা ঈদ উদযাপিত হলেও পশ্চিমবঙ্গে সর্বজনীনভাবে তখনো প্রকাশ ঘটেনি এই ধর্মীয় উৎসবের। কালক্রমে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর উদ্বাস্তুদের আর্থসামাজিক পুনর্বাসনজনিত বেশ কিছুটা সমস্যা সমাধানের পর পারস্পরিক সাম্য আবারও একে অপরকে কাছে আনতে সাহায্য করে। মুসলিমরা হিন্দুদের পূজার নান্দনিকতার আনন্দে যেমন শরিক হতে থাকে, তেমনি হিন্দুরাও ইফতার অনুষ্ঠানে নানা রকম স্বাদের খাবার চাখা থেকে ঈদে কোলাকুলি করে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধকে আবারও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। দেশজুড়ে ঈদে আলোর রোশনাই, ভেসে আসা কাওয়ালির সুর, নানা রকম খানাপিনা, পোশাকের দোকানে উপচে পড়া ভিড়, মসজিদ সাজিয়ে তোলা ইত্যাদি দেখে মনে হয় যে ধর্মীয় উৎসব শুধু ধর্মকেই কেন্দ্র করে না, এর মধ্যে থাকে পারস্পরিক বন্ধনের সৌন্দর্য।
যা হোক, ঈদের দিন খিদিরপুরের মদিনা মসজিদ, ওয়াটগঞ্জের বড় মসজিদে ভিড় উপচে পড়ে। এখানের ফ্যান্সি মার্কেটের বহু পুরোনো ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্টের খাবার চাখতে হলে আগে থেকে সিট বুক করে রাখতে হয়। সারা বছর প্রচন্ড ভিড় তো থাকেই, রমজান বা ঈদের সময় আগে থেকে বুক করা না থাকলে আপনার কপালে ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্টের খাবারের আস্বাদ না-ও জুটতে পারে। এই দোকানের কাচ্চি বিরিয়ানির সুঘ্রাণের প্রেমে পড়তে বাধ্য হবেন আপনি। এ ছাড়া তন্দুরি, কাবাব, চাপ, ফিরনি তো রয়েইছে।
ঈদের নামাজ পড়ার জন্য খিদিরপুর, পার্কসার্কাস, ময়দান, রেড রোড বিখ্যাত। নামাজের পর পার্ক সার্কাস অঞ্চলের জিসান, আরসালান, আফজা, রহমানিয়া, আমিনিয়া, ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের অওধ ১৯৫০, পার্ক স্ট্রিট ও মল্লিকবাজার-সংলগ্ন দাওয়াত-এ-সিরাজে পেয়ে যাবেন নানা রকম মোগলাই কুজিন। সেমাইয়ের জন্য বিখ্যাত মল্লিক বাজার ও কলুটোলা। চিৎপুর রোডের আলাউদ্দিনে দেশি ঘিয়ের লাচ্ছা সেমাই, দুধ সেমাই, দমের সেমাই, শিরখোরসা সেমাই বিখ্যাত। এ ছাড়া করাচি হালুয়া, লাড্ডুও পেয়ে যাবেন এখানে। খিদিরপুর মার্কেটে পাকিস্তান সেমাইও পেয়ে যাবেন, যার মধ্যে রয়েছে আলাদা একধরনের স্বাদ। এ ছাড়া ঈদের দুদিন আগে লাইন পড়ে যায় রহমান মাংসের দোকানে, কলকাতায় এক নামে একে চেনে সবাই।
এবারে ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকালে মন্দ হয় না। অতীতে দৃষ্টি রেখে আমরা দেখি, ইংরেজদের তাড়া খাওয়া নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় এসে এখানে তৈরি করলেন বিলাসবহুল প্রাসাদ, চিড়িয়াখানা, মসজিদ। গুণী এবং বিলাসী নবাব শুধু গান, কবিতা, শায়রির ইত্যাদিতে শৌখিন ছিলেন না, খাবারদাবারেও ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। নবাবের হাত ধরেই এসেছিল রোলের ধারণা। আর এই বিশ্ববিখ্যাত রোল নানাভাবে, নানা স্বাদে, নানা চাটনিতে মন জয় করে নিয়েছে সবার। ওয়াজেদ আলী শাহ রমজানের সময় লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করতেন, যাতে গরিবেরা সারা দিন অভুক্ত থাকার পর পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে। নবাবের বর্তমান প্রজন্ম রয়েছে ফ্যান্সি মার্কেটের ঠিক উল্টো দিকেই। বর্তমান রান্না বা ঈদের রান্না প্রসঙ্গে গল্প জমে উঠেছিল; সিকান্দর আলী মির্জার বেগম আলিয়া ওয়াসি ও তার ছেলে ইউসুফের বক্তব্য, তেল, মসলা, ঘিয়ের প্রয়োগ অনেকটা কমে গেলেও ঈদের সময় নবাবি মেজাজে রান্নায় নানা রকম মসলা, তেল ব্যবহার করা হয়। তৈরি করা হয় পরিবারের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার, যেমন—বিরিয়ানি, চাপ, নানা রকম সেমাই, কাবাব, মিষ্টি।
যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঐতিহাসিক নানা গল্প জুড়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে মুর্শিদাবাদের কথা খুব স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর তৈরি প্রসিদ্ধ কাটরা মসজিদে ঈদ উদ্যাপন করা হতো সাড়ম্বরে। ঈদের সময় ঢালাও রান্না হতো। হাজারো লোকের পাত পড়ত সেদিন। গোলাপজল, জাফরান, কেওড়ার সুগন্ধে ভরে উঠত মুর্শিদাবাদ অঞ্চল। বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত প্রাসাদ বহন করে চলেছে ইতিহাসের ভার। বাতাসের গন্ধে কোথাও যেন দীর্ঘশ্বাস; সেই প্রাচুর্য আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
যা হোক, অতীত কাটিয়ে বর্তমানের কলকাতায় দেখতে পাই, বাড়িতে তৈরি করা হয় ঈদের জন্য বিশেষ পায়েস, রান্না করা হয় নানা পদের সেমাই। স্থান-কাল-পাত্রে খাবার বিশাল প্রভাব ফেলে; সেই উদাহরণ এখানেও দেখি। ঈদের দিন অনেকের বাড়িতে চালের পায়েস, নারকেলের দুধ দিয়ে বানানো হয়। আর মিষ্টি ছাড়া যেকোনো উৎসব অসম্পূর্ণ। তাই ঈদের স্পেশাল মিষ্টি যেমন ‘বত্তিশি হালুয়া’ বা ৩২ রকমের উপকরণ দিয়ে তৈরি হালুয়া চাখতে হলে অবশ্যই চলে আসতে হবে হাজি আলাউদ্দিন সুইটসে, বড়বাজার সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের পাশে। এ ছাড়া বরফি, গাজরের হালুয়া, মাওয়ার লাড্ডুও মেলে। এগুলোর স্বাদ অমৃতসম। বড়বাজারের করোডিয়া রেস্তোরাঁতেও ঈদ স্পেশাল মিষ্টি রয়েছে। কলকাতার মিষ্টি বিশ্ববিখ্যাত, তাই ঈদের সময় নানা রকম চিনির শিরায় মিষ্টি বা শুকনো মিষ্টি পেয়ে যাবেন রাস্তার মোড়ে কিংবা বড় রাস্তার ওপরে। স্বাদে বলুন কিংবা আহ্লাদে, এসব মিষ্টি বা বিরিয়ানি, চাপ, কাবাব ইত্যাদি খাওয়ার লোভে কলকাতা কিন্তু আবিশে^র রসনাবিলাসী বাঙালিদের সব সময় চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালিরা থাকুক না কেন, কলকাতায় ঘুরতে বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে এলে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে অবশ্যকরণীয় থাকে খাবারের স্বাদ আস্বাদন। আর গন্তব্যগুলোতে আগে থেকেই টিক মার্ক দেওয়া থাকে। তা হবে নাই-বা কেন? এই শহরের নাম যে কলকাতা—দ্য সিটি অব জয়। আনন্দনগরী।
লেখক: কলকাতার হ্যাংলা হেঁশেলের সাংবাদিক
ছবি: লেখক