ফিচার I অফিস অ্যাটায়ার
ড্রেস কোড যত শিথিল হোক, ফরমাল লুকই অফিসের জন্য সব সময়ের প্রযোজ্য। কী পোশাক এবং অনুষঙ্গে মিলবে কমপ্লিট করপোরেট লুক?
প্রতিটি প্রফেশনেই পোশাক থাকে। পেশাভেদে তা বদলে যায়। একজন ডাক্তারের পোশাক যেমন হয়, ব্যবসায়ীর তা হয় না। আবার কোনো কোনো পেশায় পোশাক নির্ধারিত। যেমন নার্স, সেনাবাহিনী, পুলিশ। এগুলোকে অবশ্য ইউনিফর্ম বলা হয়ে থাকে।
অনেক ক্ষেত্রে ইউনিফর্ম না থাকলেও থাকে ড্রেস কোড বা পোশাকরীতি। বিজনেস প্রফেশন বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন, তাদের আলাদা ড্রেস কোড থাকে। ড্রেস কোড ম্যানুয়াল তৈরি করার দায়িত্ব একটি অফিসের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের। করপোরেট কালচারে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার ড্রেস সাধারণত ফুল ফরমাল হয়ে থাকে। এক্সিকিউটিভ ড্রেসও একে বলা হয়ে থাকে। ছেলেদের ফুল ফরমাল ড্রেস হলো জুতা, মোজা, শার্ট, প্যান্ট, টাই, বেল্ট, স্কয়ার পকেটওয়ালা স্যুট।
জুতা: স্নিকার বা হোয়াইট কেডস কোনোটাই ফরমাল শু না। ফরমাল শু বা জুতাকে ড্রেস শুও বলা হয়ে থাকে। সবচেয়ে কমন ফরমাল জুতাগুলোর মধ্যে আছে অক্সফোর্ড, ডারবি, ব্রগ, লোফার, মঙ্ক শু।
অক্সফোর্ড শু: এটি সবচেয়ে ক্ল্যাসিক ফরমাল জুতা। বিজনেস প্রফেশনাল থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের ছাত্র—সবার কাছে এর কদর অনেক। নিচু হিলের লেসযুক্ত চামড়ার জুতাগুলোই সাধারণত অক্সফোর্ড শু। এর লেস লুপগুলো বন্ধ থাকে। হিল কম চওড়া হয়ে থাকে। বাদামি ও কালো—এই দুই ধরনের অক্সফোর্ড শু বেশি পরা হয়ে থাকে।
ডারবি শু: ডারবি এবং অক্সফোর্ড দেখতে প্রায় একই ধরনের হলেও এই দুই জুতার মধ্যে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন ডারবি শুর লেস লুপ খোলা থাকে, কিন্তু অক্সফোর্ড শুর বন্ধ থাকে। ডারবি শুর হিল অক্সফোর্ড শুর থেকে বেশি চওড়া হয়ে থাকে। আরেকটি বড় পার্থক্য হলো, অক্সফোর্ড শুর চেয়ে ডারবি একটু বেশি ক্যাজুয়াল। ফলে এটি ক্যাজুয়াল ড্রেসের সঙ্গে পরা যায়।
মঙ্ক শু: মঙ্ক শু হচ্ছে সেই ধরনের ড্রেস শু, যাতে বাকল থাকে। এই জুতা খুব আকর্ষণীয়। দুই ধরনের মঙ্ক শু আছে—সিঙ্গেল বাকল এবং ডাবল বাকল। এই ধরনের শু ফুল ফরমাল, সেমি ফরমাল, বিজনেস ক্যাজুয়াল—সব লুকের সঙ্গে মানানসই।
ব্রগ শু: একধরনের অক্সফোর্ড শু। একে উইংটিপও বলা হয়। এই জুতা খুব ডেকোরেটিভ হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের চামড়া একসঙ্গে করে এটি তৈরি করা হয়। একে ব্লুচার শুও বলে। এই জুতা সাধারণত বাদামি শেডের হয়।
লোফার: এখনকার বেশ জনপ্রিয় জুতা হলো লোফার। এর কোনো লেস থাকে না। খুব সহজেই পরা যায়। ক্যাজুয়াল লোফারের চেয়ে ফরমাল লোফারের কদর বেশি। তিন ধরনের ফরমাল লোফার আছে। পেনি লোফার একদম প্লেইন, টাসেল লোফারের সামনে ছোট টাসেল থাকে এবং বিট লোফারের ভ্যাম্পের সামনে মেটাল ডিজাইন থাকে। এসব লোফারই যেকোনো ফরমাল লুকের সঙ্গে মানিয়ে যায়।
ফরমাল জুতার ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিক রঙ হচ্ছে কালো ও বাদামি। এ ছাড়া গাঢ় খয়েরিও পরা যায়। খুব চোখা জুতা পরা যাবে না। সব সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন সঠিকভাবে পলিশ করা থাকে।
মোজা: জুতার সঙ্গে অবশ্যই মোজা পরতে হবে। ড্রেস শুর সঙ্গে সাদা মোজা একদমই যায় না। বরং কালো জুতার সঙ্গে কালো মোজা, বাদামি জুতার সঙ্গে বাদামি বা একই শেডের মোজা পরা উচিত। এ ছাড়া প্যান্টের সঙ্গে ম্যাচ করে মোজা পরা যেতে পারে।
প্যান্ট: উল অথবা কটন ফ্যাব্রিকের প্যান্টগুলোই ফরমাল। অনেক ক্ষেত্রে স্যুট এবং প্যান্টের ফ্যাব্রিক এক হয়ে থাকে। আবার সিঙ্গেল কাট ফরমাল প্যান্টও থাকে। ফরমাল প্যান্টের রঙ কালো, গাঢ় বাদামি, ধূসর হয়ে থাকে। তবে চেক প্যাটার্ন থাকতে পারে। সিজন অনুযায়ী পরিবর্তন হতে পারে প্যান্টের কালার।
শার্ট: ফরমাল ড্রেসে অবশ্যই ফুল স্লিভ শার্ট পরতে হবে। এর অনেক ধরন রয়েছে। সবচেয়ে ব্যবহৃত ফরমাল শার্ট হচ্ছে স্ট্রেট পয়েন্ট কলার এবং সেমি স্প্রেড কলার শার্ট। এ ছাড়া আছে বাটন ডাউন শার্ট, সেমি ফরমাল লুকের জন্য। হোয়াইট কালার শার্ট ক্ল্যাসিক। অফিসে সবার উচিত হালকা রঙের শার্ট পরা। এ জন্য লাইট প্যাস্টেল কালারের শেডগুলো বেছে নেওয়া যেতে পারে। এক কালারের পাশাপাশি স্ট্রাইপ এবং চেক প্যাটার্নের শার্ট পরে অনেকে। সে ক্ষেত্রে খুব ঘন চেক বা গাঢ় স্ট্রাইপ এড়িয়ে হালকা স্ট্রাইপ এবং চেক পরা উচিত।
টাই: এটি ছাড়া ফুল ফরমাল লুক অসম্পূর্ণ। অনেক অফিসের ড্রেস ম্যানুয়ালে টাই পরা বাধ্যতামূলক। বিভিন্ন রকমের টাই আছে। যেমন চওড়া, চিকন। কিন্তু অফিসের সবার উচিত ক্ল্যাসিক ‘থ্রি ইঞ্চ’ টাই বেছে নেওয়া। এর রঙ বাছাইয়ে সতর্ক থাকতে হবে। শার্ট, প্যান্ট, স্যুট—সবকিছুর রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টাইয়ের রঙ বাছাই করা উচিত। কার্টুন ক্যারেক্টারঅলা টাই কখনোই অফিসে পরা যাবে না। ডিজাইন হতে হবে স্মল প্যাটার্ন এবং স্ট্রাইপ অথবা একরঙা। স্ট্রাইপ শার্ট পরলে স্ট্রাইপ টাই এড়িয়ে চলা উচিত।
কাফলিং: অনেক ফরমাল বা ড্রেস শার্টে কাফলিং পরতে হয়। এটা অনেকটা অ্যাকসেসরিজের মতো। ভারিক্কি ডিজাইনের। অফিসে কাফলিং পরা ঠিক নয়। পরতে হবে ছোট হালকা ধরনের সফিস্টিকেটেড কাফলিং। রঙের ক্ষেত্রে সিলভার শেড সবচেয়ে ভালো।
স্যুট: সিঙ্গেল ব্রেস্টেড টু বাটন স্যুট হচ্ছে ক্ল্যাসিক ফরমাল অফিস স্যুট। তবে ওয়ান বাটন, থ্রি বাটন স্যুটও পরা যেতে পারে। স্যুটের কালার হতে হবে ডার্কার। যেমন নেভি ব্লু, ব্ল্যাক, গ্রে। ডার্ক কালার স্যুটের সঙ্গে কন্ট্রাস্ট করে লাইট কালার শার্ট পরলে ভালো।
পকেট স্কয়ার: স্যুটের বুকপকেটে অনেকে ছোট রুমাল রাখে, একে পকেট স্কয়ার বলে। এটি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি। পকেট স্কয়ার হওয়া উচিত সমন্বিত রঙের। অর্থাৎ টাই ও কোটের কালারের সঙ্গে মিল রেখে যে পরতে হবে, তা নয়। কাছাকাছি কালার প্যাটার্ন হলেও চলবে। যেমন কেউ যদি সবুজ রঙের টাই পরে, তাহলে পকেট স্কয়ার হতে পারে হালকা সবুজ রঙের।
এ ছাড়া ফরমাল ড্রেস আপে লক্ষ রাখতে হবে চশমার ফ্রেম ও ঘড়ির দিকে। চশমা হতে হবে হালকা, সাধারণ মাঝারি সাইজের ফ্রেমের। রঙ হতে পারে কালো বা বাদামি কিংবা খয়েরি। সানগ্লাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ওয়েফেরার। ফরমাল লুকের সঙ্গে ক্লাবমাস্টার সানগ্লাসও পরা যেতে পারে।
ঘড়ি এখন সবাই ব্যবহার করে অ্যাকসেসরিজ হিসেবে। অনেকে অফিসে স্পোর্টস ওয়াচ পরে আসে। এটি করা যাবে না। ঘড়ি হতে হবে কালো বা বাদামি বেল্টের বা হালকা সোনালি কিংবা রুপালি চেইনের। চেইন ঘড়ি অনেকে ব্রেসলেটের মতো ঝুলিয়ে ঘড়ি পরা দৃষ্টিকটু। তাই রিস্ট ওয়াচ যাতে কবজির সঙ্গে লেগে থাকে, খেয়াল রাখতে হবে।
বেল্ট ছাড়া প্যান্ট পরা উচিত নয়। লক্ষ রাখতে হবে বেল্টের বাকলের দিকে। ফরমাল গেটআপের সঙ্গে বড় গ্লসি বাকল বেল্ট বেমানান। জুতার কালারের সঙ্গে মিল রেখে বেল্ট পরা উচিত।
বিজনেস ডে এবং বিজনেস মিটিংগুলোতে অবশ্যই ফরমাল ড্রেস পরতে হবে। এ ছাড়া করপোরেট অফিসে বিভিন্ন ধরনের পার্টি হয়ে থাকে। বিজনেস পার্টির আলাদা ড্রেস কোড থাকে। যদি না থাকে, তাহলে নরমাল বিজনেস ফরমাল লুক বেছে নেওয়া উচিত। অনেক অফিসে স্পোর্টস গ্যাদারিং হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রোগ্রামে চিনো এবং পোলো শার্টের সঙ্গে স্নিকার বা ক্যাজুয়াল লোফার পরা উচিত।
নারীর ফরমাল ড্রেস
বাংলাদেশে মেয়েদের ফরমাল ড্রেস কী, এটা বলা মুশকিল। অফিসে সাধারণত পরা হয় কামিজ ও শাড়িই।
কামিজ-প্যান্ট: অফিসে মেয়েদের উচিত লাইট কালারের কামিজ এবং স্ট্রেট কাট প্যান্ট পরা। সালোয়ার পরা উচিত নয়। কামিজের সঙ্গে মিল রেখে বা কন্ট্রাস্ট করে সুতি নয়তো লিনেনের স্ট্রেট কাট প্যান্ট বানিয়ে পরা যেতে পারে।
শাড়ি-ব্লাউজ: ফরমাল লুকে শাড়ি সবচেয়ে ভালো অপশন। হালকা ডিজাইনে টাঙ্গাইলের তাঁত এবং জামদানি শাড়ি পরা যেতে পারে। এ ছাড়া সব সময় পরার জন্য হালকা সিল্ক ও জর্জেটের শাড়ি পরা ভালো। অফিসে কাতান কিংবা এমন ভারী ও গাঢ় রঙের শাড়ি পরে আসা ঠিক নয়।
শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ এক কালারের হলে ভালো। ব্লাউজে ছোট প্রিন্ট থাকতে পারে। প্লেইন ডিজাইনের ব্লাউজ পরা উচিত। এর কলার হতে পারে ব্যান্ড, রাউন্ড অথবা বোট।
স্যুট প্যান্ট: বাংলাদেশের অনেক করপোরেট অফিসে মেয়েরা স্যুট প্যান্ট পরে যায়। ডার্ক কালারের স্যুটের সঙ্গে হালকা প্যাস্টেল কালারের শার্ট ছেলেদের মতোই মেয়েরা পরতে পারে। ন্যুড বা লাইট মভ কালারের স্যুটও পরা যায়। প্যান্ট স্ট্রেট কাট হতে হবে।
জুতা: অফিসে স্যান্ডেল পরা যাবে না। কমপক্ষে ২ থেকে ৪ ইঞ্চি উঁচা জুতা পরা উচিত। প্ল্যাটফর্ম হিল এবং পেনসিল হিল এড়িয়ে চলা উচিত। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ব্লক হিল পরা। এটি স্বাস্থ্যসম্মত ও আরামদায়ক বটে।
অ্যাকসেসরিজ: এ ক্ষেত্রে মেয়েদের বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। ভারী কানের দুল ও মালা বা শব্দ হয় এ ধরনের কোনো গয়না পরা যাবে না। পরা উচিত হালকা গয়না। পার্ল, সিলভার বা লাইট গোল্ডের ছোট কানের দুল, সঙ্গে সরু চেইন। পায়ে অনেকে নূপুর পরে। এর বদলে শব্দ হয় না এমন চেইন তারা পরতে পারে। আংটি পরলে সেটিও হতে হবে হালকা ছোট ডিজাইনের। ঘড়ি হতে হবে চিকন বেল্ট বা চেইনের নন-ব্রেসলেট টাইপ।
ব্যাগ: অফিসের জন্য মেয়েদের সবচেয়ে ভালো ব্যাগ হচ্ছে টোট ব্যাগ। ল্যাপটপের ব্যাগও ব্যবহার করা যেতে পারে। এড়িয়ে চলা উচিত ফুল লতাপাতা পাখি ডিজাইনের বড় ঝোলা ব্যাগ বা বটুয়া টাইপ ব্যাগ এবং যেকোনো ধরনের ক্যাজুয়াল ব্যাগ।
হেয়ারস্টাইল: বড় চুলের জন্য প্লেইন খোঁপা অথবা টাইট পনিটেইল করা যেতে পারে। চুলে যেকোনো ধরনের অ্যাকসেসরিজ এড়িয়ে চলা উচিত।
বিজনেস পার্টিতে মেয়েদের ড্রেস হতে পারে শাড়ি বা ইভনিং গাউন। সাজটা খুব জমকালো না হয়ে হালকা ও মার্জিত হওয়া উচিত। গয়না খুব চটকদার না হলেই ভালো।
ড্রেস ডাউন ডে: অনেক করপোরেট অফিসে সপ্তাহের একটি দিন ‘ড্রেস ডাউন ডে’ পালন করা হয়। এই দিন সবাইকে রোজকার ফরমাল লুকের ড্রেস পরে আসতে হয় না। যে যার মতো ড্রেস পরে আসতে পারবে। এমনটি বলা হলেও ব্যাপারটা পুরোপুরি তা নয়। ড্রেস ডাউন ডে-তে ক্যাজুয়াল নয়, সবচেয়ে উপযুক্ত হচ্ছে সেমি ফরমাল বা বিজনেস ক্যাজুয়াল। এই লুকে কেউ ইচ্ছা করলে টাই বা স্যুট ছাড়া অফিসে আসতে পারে। এর চেয়ে বেশি ‘ক্যাজুয়াল’ না হওয়াই ভালো।
ফরমাল লুককে বলা হয়ে থাকে ‘জেন্টলম্যান লুক’। অর্থাৎ ভদ্রলোকের স্টাইল স্টেটমেন্ট। করপোরেট প্রফেশনের ফুল ফরমাল লুক কখনোই এড়ানো যায় না। এটি চর্চা বা অনুশীলনের বিষয়। এক দিনে আয়ত্ত করা যায় না। নতুন যারা করপোরেট দুনিয়ায় আসছে, তারা ইচ্ছা করলে তাদের সিনিয়রদের দেখে শিখতে পারে। এ ছাড়া হলিউড সেলিব্রিটিদের মোস্ট ফরমাল মোমেন্ট থেকে নিজের জন্য একটি ‘ফরমাল স্টেটমেন্ট স্টাইল’ তৈরি করা যায়। এ ছাড়া গুরুত্ব দিতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে। যত ব্যস্ততা থাকুক, কখনোই অফিসে অপরিষ্কার পোশাক পরে আসা যাবে না।
ফাহমিদা সিকদার
মডেল: শাওন, কায়জার, মিথিলা, জায়েব ও নাজিয়া
ওয়্যারড্রোব: ওকোড, আর্টিসান হাট ও ক্লাব হাউজ
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস