সেলুলয়েড I মহালয়া (২০১৯)
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: সৌমিক সেন
প্রযোজনা: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
গবেষণা ও সংলাপ: তন্ময় মুখোপাধ্যায় ও সৌমিক সেন
চিত্রায়ন: মৃন্ময় নন্দী
সম্পাদনা: নীলাদ্রি রায়
সঙ্গীত পরিচালনা: দেবজ্যোতি মিশ্র
দৈর্ঘ্য: ১০৮ মিনিট
অভিনয়ে: শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্ত, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শুভময় চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি রায়, কাঞ্চন মল্লিক, জয়ন্ত কৃপালানি, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
ছবিটি কাহিনিচিত্র হলেও, আখ্যানের বিস্তার কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে কেন্দ্র করে। দুর্গাপূজার ঠিক আগেই পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনালগ্নে মহালয়া তিথিতে কলকাতার আকাশবাণী বেতারকেন্দ্রে সম্প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামক গীতি-আলেখ্য ও স্তোত্রপাঠ। অনুষ্ঠানটি প্রথম সম্প্রচারিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে। বাণী কুমারের রচনায়, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সংগীত পরিচালনায় এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠে এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ই একসময় অখন্ড বঙ্গে ও পরে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দুর সাংস্কৃতিক সত্তার অংশ হয়ে ওঠে। মূল কারণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভরাট কণ্ঠে স্তোত্রপাঠ। যা পরে শুধু বাঙালি হিন্দুই নয় বরং পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক বাঙালি সমাজের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়।
একসময় বেতারকেন্দ্র থেকে লাইভ পারফর্মেন্সের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো। পরে রেকর্ডিংয়ের সম্প্রচার শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৪ সালে আকাশবাণীর দিল্লি সদরকেন্দ্রের মনে হয়, নাট্যকার ও বাচিকশিল্পী বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বদলে অভিনেতা উত্তমকুমারকে দিয়ে স্তোত্রপাঠ করানো দরকার। ঠিক হয় সংগীত পরিচালনা করবেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ইতিহাসসূত্রেই ছবিতে দেখা যায় উত্তমকুমার (অভিনয়ে যীশু সেনগুপ্ত) প্রথমে এই ব্যাপারে রাজি হননি। কারণ, তিনি জানতেন যে বড় অভিনেতা হওয়া আর বড় বাচিকশিল্পী হওয়া এক নয়। কিন্তু আকাশবাণীর এক অবাঙালি কর্মকর্তা নানাজনকে দিয়ে উত্তমকুমারকে এই ব্যাপারে রাজি করান। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর (অভিনয়ে শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়) কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে তিনি স্তোত্রপাঠে রাজি হন। কিন্তু এটা ইতিহাস যে কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ এই ক্ষেত্রে তাকে মেনে নেয়নি। কারণ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠস্বর ও স্তোত্রপাঠ তত দিনে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। ছবিতেও দেখা যায়, আকাশবাণীর অবাঙালি এক কর্মকর্তার গোঁয়ার্তুমির কারণে উত্তমকুমারকে দিয়ে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্তোত্রপাঠ করানো হলেও অডিয়েন্সের প্রবল ক্ষোভের মুখে পড়ে কর্তৃপক্ষ। পরে ফের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর পঙ্কজ মল্লিকদের অনুষ্ঠানটিকে ফিরিয়ে আনা হয়। উল্লেখ্য, ওই ঘটনার পর আজ অবধি ওই রেকর্ডিংই প্রতিবছর সম্প্রচারিত হচ্ছে।
ছবিটিতে ঐতিহ্য, শিল্পের প্রতি কমিটেমেন্ট বনাম সেলিব্রিটিকে যেকোনোভাবে ব্যবহার করে শিল্পের পণ্যায়নের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, উত্তমকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর পাশাপাশি তিরিশের দশকের ফ্ল্যাশব্যাকে রবীন্দ্রনাথকেও হাজির করা হয়েছে। ইতিহাসনির্ভর কাহিনিচিত্র হলেও ২২শে শ্রাবণের লাইব্রেরি ফুটেজ সাবলীলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এই ছবিতে। একদিকে পপুলার মিডিয়া জগতের ঐতিহ্যের বদলে নতুন কোনো চমক আনার চেষ্টায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল, অন্যদিকে তিনি যেহেতু অব্রাহ্মণ, তাই তাকে দিয়ে স্তোত্রপাঠে বাধা দিয়েছিল কলকাতার তৎকালীন হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীও। ছবিতে সেটাও তুলে আনা হয়েছে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ভূমিকায় শুভাশীষ অনবদ্য। উত্তমকুমারের ভূমিকায় যীশু সফল। অবাঙালি বেতারকর্তার ভূমিকায় প্রসেনজিৎ অনবদ্য। বাকি সবার অভিনয় সাবলীল। দেবজ্যোতি মিশ্রের আবহ সংগীত যথাযথ। সিনেমাটোগ্রাফি ও সম্পাদনা চিত্রনাট্যের প্রয়োজনমতোই। সবচেয়ে সফল ছবির চিত্রনাট্য এবং গবেষণায় ইতিহাসের নানা তথ্যকে সিনেমায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি।
i অতনু সিংহ
কুইজ
১। মহালয়ার দিন কলকাতার আকাশবাণী বেতারকেন্দ্র থেকে কী সম্প্রচারিত হয়?
ক। চণ্ডীপাঠ
খ। গীতাপাঠ
গ। মহিষাসুরমর্দিনী গীতি-আলেখ্য
২। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কার সখ্য এই ছবিতে উঠে এসেছে?
ক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
খ। পঙ্কজ কুমার মল্লিক
গ। রাইচাঁদ বড়াল
৩। প্রথম কবে মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচারিত হয়?
ক। ১৯৪২
খ। ১৯৩১
গ। ১৯৪৭
গত সংখ্যার বিজয়ী
১. আহমেদ তারিক শুভ, বারিধারা, ঢাকা।
২. তাহলিমা লিমা, আদাবর, ঢাকা।
৩. নওরিন আনসারী, মিরপুর, ঢাকা।