রসনাবিলাস I কাচ্চিকাহিনি
কাচ্চি বিরিয়ানির নতুন ঠিকানা কাচ্চি ভাই। যেখানে ভোজনরসিকদের ভিড়। ঘড়ির কাঁটা সুস্বাদু পদটির প্লেটেই যেন ঘুরতে থাকে
দুপুর ১২টা। বাঙালির চায়ের সঙ্গে টা খাওয়ার সময়। তবে কাচ্চি ভাইয়ে ঢুকে মনে হলো, এই একটা খাবার, বিরিয়ানি- যার খাওয়ার কোনো দিন, ক্ষণ লাগে না।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ফটক ধরে একটুখানি ভেতরে এগোলেই হাতের ডান দিকে পড়ে রেস্তোরাঁটি। দোতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই নাসারন্ধ্র ব্যাকুল হয়ে পড়ে বিরিয়ানির সুঘ্রাণে। এই এক বিরিয়ানি- আর্য-অনার্য, আশরাফ-আতরাফ, কুলীন-ম্লেচ্ছ, ভারত-পাকিস্তানকেও এক টেবিলে বসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এখনো।
অনেক অনেক মিথ, ইতিহাস জন্ম দিয়ে মোঙ্গল, মোগল, অযোধ্যার নবাবি পেরিয়ে খাবারটি আজকের রূপ পেয়েছে। তবে এ কাচ্চি বিরিয়ানি জগতে সেরা। অর্থাৎ মাংস আর চাল একই সঙ্গে রান্না হবে দমে। আর পাক্কি বিরিয়ানিতে মাংস আর চাল আলাদা রান্না করে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ রেস্টুরেন্ট এই পাক্কি পন্থায় বিরিয়ানি রাঁধে আর কাচ্চি নামে পরিবেশন করে থাকে।
ঘ্রাণে যখন অর্ধভোজন চলছে, তখনই রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে জানা গেল। এর বয়স বেশি নয়, চলতি বছর মার্চের ২০ তারিখ শুরু। ভালো সাড়া পাওয়ায় ২০ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করেছে উত্তরা শাখা। নভেম্বরের একই দিনে আরও একটি শাখা শুরু হতে যাচ্ছে ঢাকার আরেকটি এলাকায়। জানা গেল মো. সোহেল সিরাজ, রেস্টুরেন্টের কর্ণধারের কাছ থেকে।
এত কিছু ছেড়ে বিরিয়ানি কেন? জিজ্ঞেস করতেই সাবেক মডেল জানালেন ভালো বিরিয়ানির প্রতি তার অগাধ ভালোবাসার কথা। এই প্রেম অবিদিত নেই যশোরেও। তাই সেখানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যশোর বেজের অনুষ্ঠানগুলোতে প্রধানমন্ত্রীকেও বিরিয়ানির স্বাদে বিমোহিত করার সুযোগ পেয়েছেন। সেখান থেকেই ঢাকায় একখানা ভালো বিরিয়ানির রেস্টুরেন্টের স্বপ্ন দেখেন তিনি। যার পরিণতি এই কাচ্চি ভাই।
কাচ্চি ভাই মূলত বিয়ে বাড়ির বিরিয়ানি পরিবেশন করে। রান্না হয় বাসমতী চালে। তবে মূল রেসিপি অনেকটা দিল্লির বড় বাজারের বিখ্যাত বিরিয়ানির, খানিকটা পরিবর্তিত হয়েছে আমাদের স্বাদেন্দ্রিয়ের প্রভাবে। দমেই রান্না হয় দমে, কাচ্চি প্রক্রিয়ায়।
বিরিয়ানিতে যাদের অরুচি, তাদের জন্য রয়েছে স্রেফ সাদামাটা পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরু আর খাসির রেজালা। সাইডস হিসেবে জালি কাবাব আর চাটনি তো আছেই। মধুরেণ সমাপয়েৎ হিসেবে ফিরনি আর জর্দা। পানীয় তালিকায় রয়েছে বোরহানি আর বাদামের শরবত। এই দ্বিতীয়টি রীতিমতো তারকা!
এরপর ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে টেবিলে এলো গরম গরম বিরিয়ানি। এখানে কেবল বাসমতী চালের বিরিয়ানিই হয়। ঢাকা শহরের হালের ক্রেজ। এরই আকর্ষণে দুপুরবেলা এখানে আড্ডা জমান আশপাশের অফিস আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। তাদের দেখতে দেখতে আর কাচ্চি ভাইয়ের গল্প শুনতে শুনতে পরীক্ষা চলল কাচ্চি বিরিয়ানির।
ভালো বিরিয়ানি যাচাই হয় চারভাবে। ছড়িয়ে, ঘ্রাণ শুঁকে, স্বাদে আর আলুতে। আঙুলে অল্প একটু বিরিয়ানি নিয়ে সাইড ডিশে রেখে এর তেলভাব আর ঝরঝরে ভাবের পরীক্ষা করে নেওয়াটাই হলো বিরিয়ানির ছড়ানো পরীক্ষা। ভাতগুলো একসঙ্গে লেগে থাকবে না, ঝরঝরে ধরনের হবে। মাংস হবে রসালো, পরিষ্কার আর শুকনো ধরনের, চর্বিময় নয় অবশ্যই আর সহজেই বিরিয়ানি থেকে আলাদা করা যাবে। এরপর ঘ্রাণ পরীক্ষা। বিরিয়ানি পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে, মাংসের ঘ্রাণ নিন। বিরিয়ানি অবশ্যই সুঘ্রাণযুক্ত হবে আর মসলার সূক্ষ্ম মিষ্টি গন্ধ আর মুখে জল আনা সুবাস ঠাহর করা যাবে। কিন্তু সেটা বিরিয়ানির ভাতের সুঘ্রাণকে ছাপিয়ে যাবে না। মাংস অবশ্যই ভালোমতো রান্না হতে হবে। স্বাদে অসাধারণ আর রসালো হবে। খুব বেশি কসরত করতে হবে না মাংস ছিঁড়তে। এরপর খানিকটা ভাত মুখে নিলে মসলার সূক্ষ্ম ঘ্রাণ ও স্বাদ আসবে। সবশেষে আলুর পরীক্ষা। আলুর স্বাদ বিরিয়ানিতে থাকা মাংসের সঙ্গে টক্কর দিতে পারঙ্গম হতে হবে। যদি বিরিয়ানিতে আলু না থাকে, তাহলে তো কোনো কথাই রইল না। আলু ছাড়া বিরিয়ানি আর পানি ছাড়া সমুদ্র যে সমার্থক, তা যেকোনো বিরিয়ানিপ্রেমীই জানেন।
এসব পরীক্ষাতেই কাচ্চি ভাই বেশ ভালোভাবে ডিস্টিঙ্কশন মার্ক পেয়ে উত্তীর্ণ। আর সঙ্গে থাকা বোরহানি ঘনত্বের দিক থেকে তো ভালো বটেই, আবার ঝাল, মিষ্টি, নোনা স্বাদেরও পারফেক্ট ব্লেন্ড। তাই অনায়াসে কাচ্চি ভাই হতে পারে পারফেক্ট বিরিয়ানির উপযুক্ত গন্তব্য।
আপাতত এখানে ১৫০ জনের মতো একসঙ্গে বসে খেতে পারেন। জায়গা থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি ঘিঞ্জি করা হয়নি। অন্দরসজ্জা সাদামাটা। মেহগনি-রঙা ফলস সিলিং আর পিলারে দারুশিল্পের আদলে করা নকশা খানিকটা দেশীয় আবহ তুলে ধরেছে। প্রাকৃতিক আলোর অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে রেস্টুরেন্ট জুড়ে।
জানা গেল, বসুন্ধরার এই ব্রাঞ্চ আরও বড় হতে চলেছে। এই ঠিকানাতেই আয়োজন করা যাবে সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠান। পাশাপাশি কাচ্চি ভাই যেকোনো ধরনের ক্যাটারিংও করে থাকে। একদম ঘরোয়া অনুষ্ঠানে হান্ডি দিয়ে আসা, প্রয়োজনে খানসামা দিয়েও তারা সহায়তা করে।
ঠিকানা: কাচ্চি ভাই, নসর টাওয়ার, বসুন্ধরা আ/এ গেট, ফোন: ০১৭১২৭৪৪৪৪৭
আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক