skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I শবডেগ

বড় পাতিলে রাতভর রান্না হয় বলে খাবারটির নাম শবডেগ। উৎপত্তিস্থল কাশ্মীর। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল দিল্লি, অযোধ্যা আর ঢাকায়। শীতকালে গা গরম করার এই পদ এখন আর নেই, তবে রেসিপি আছে। জানাচ্ছেন আল মারুফ রাসেল

কাশ্মীরের আমজনতা থেকে দিল্লির বাদশাহ ও অযোধ্যার নবাবের রসনা তৃপ্ত করেছে এ খাবার। পিছিয়ে ছিল না এই হাজার বছরের ঢাকাও। মোগল সুবাদার আর কাগুজে নবাবদের হাত ধরে তা এসেছিল এই জনপদেও। এটা শবডেগ নামের এক বৃত্তান্ত।
ঢাকা এখনকার মতো উষ্ণ ছিল না। তখন শীতকাল ছিল খানিকটা দীর্ঘ। পৌষের শীতে বাঘে পোষ মানত আর মাঘের শীতে বাঘ কেঁপে উঠত কাঁটাবন-মিরপুরের শালবনে। তখন ঢাকা শহরের শেষ সীমা ছিল এখনকার শাহবাগ। যেখানে দ্বিতীয় মীর জুমলা তৈরি করেছিলেন ঢাকা গেট। এর বাইরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা আরাকান-মগ জলদস্যু আর পর্তুগিজরা থাকত মগবাজার-তেজগাঁও এলাকায়। ঢাকা নগরীর বাইরে।
এখনকার ঢাকা সেই মোগল আমলের আগে থেকেই সওদাগরদের আনাগোনায় মুখর থাকত। প্রমাণ পাওয়া যায় নারিন্দার বিনত বিবির মসজিদের শিলালিপি থেকেই। তাই কালে কালে এখানকার সংস্কৃতিতে বহিরাগতদের প্রভাব পড়েছে। ঢাকায় চালু হওয়া পারস্যের খোসবাস এরই অংশ। সেই রেশ পুরান ঢাকার খাবারে কণামাত্র অবশিষ্ট রয়েছে। খোশবাস বা সুখবাস সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিলেন তারাই, যারা মোগল সুবাহদারদের সঙ্গে এখানে এসেছিলেন, সঙ্গে ছিল পারস্য ও দিল্লি দরবারের পরিশীলিত রুচি ও সংস্কৃতি, অভিজাত উর্দু ছিল তাদের কথ্য। এই সংস্কৃতির শেষ ধারক ছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান, যার লেখনীতেও আমরা পাই, কীভাবে ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতির ধ্বংস ত্বরান্বিত হচ্ছিল উনিশ শতকের শেষ দশকে।
শীতের রাত ঢাকায় তখন উৎসবের চেয়ে কম কিছু ছিল না। অভিজাত বাড়িগুলোর উঠোনে মাটির চুলায় চড় চড় শব্দে পুড়ত শালকাঠ। রাতে হয়তো তৈরি হচ্ছে নিহারি, সকালে রকমারি পিঠা। আর শবডেগ ছিল রীতিমতো উৎসবের। শবডেগ খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায় শাহজাহানের সময়েই। মসলাদার মাংসের এই স্টুর লোককথা বলে, সতেরো শতকে সম্রাট শাহজাহান যখন দিল্লিতে রাজধানী স্থাপন করেন, তখনই শহরজুড়ে এক মহামারি দেখা দেয়। শাহি খানসামা আর শাহি হাকিম মিলে তখন ঔষধি গুণসম্পন্ন মসলা দিয়ে তৈরি করেন শবডেগ, যা শরীর গরম রেখে জীবাণুকে ধ্বংস করে। আর এই শবডেগ থেকেই নাকি নিহারির উৎপত্তি হয় আরও পরে। তবে শাহজাহানি এই গল্প কেবল গুজব। কারণ, কাশ্মীরের লোকেরা চৌদ্দ শতক থেকেই এটি খেয়ে আসছে।
শবডেগ হলো রান্নার প্রক্রিয়া। শব মানে রাত, ডেগ মানে গভীর আর চওড়া মুখের হাঁড়ি। সারা রাত ডেগে যে খাবার রান্না হয়, সেটাই শবডেগ। সাধারণভাবে এটা মাথায় এলেও, আসলে এই প্রক্রিয়ায় রান্না হয় মাংস, শালগম যোগে। ডেগের মুখ সিলগালা করে দেওয়া হতো ময়দার লেই দিয়ে, যেন দমে রান্না হয় শক্ত মাংসগুলো। শীত রাতের ঠান্ডার সঙ্গে এর রান্না আর ফজরের নামাজের পর ভোরে গরম গরম শিরমাল দিয়ে খাওয়ার প্রচলন ছিল এই ঢাকা নামের শহরে, শত বছর আগেও। আহ্! সেই শিরমাল রুটিও আজ ইতিহাস।
১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মুন্সি মীর আমান দেহলভির বই ‘বাগ ও বাহার’-এর শাহি নিমন্ত্রণে পরিবেশিত খাবারের তালিকায় দেখা যায় শবডেগ। এ ধরনের দাওয়াত তো আর ভোরবেলায় হয় না, তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে শবডেগ দুপুর বা রাতের খাবারের তালিকায় উঠিয়েছিল ‘সায়েব’রা! আর শবডেগের শেষ উদ্ধৃতি পাই হাকিম হাবিবুর রহমানের ‘ঢাকা পাচাস বারাস পহেলে’ বইয়ে। তার উদ্ধৃতিই দেওয়া যাক:
‘ঢাকায় শবডেগ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে, শালগমকে কেচে নিয়ে রান্না করা। কেচে নেওয়া ছাড়াই শালগমের শবডেগ এবং কাশ্মীরি বরীওলা শবডেগ। কিন্তু লোকেরা অক্ষত শালগমের (কেচে নেওয়া ছাড়া) শবডেগ বেশি পছন্দ করেন। কাশ্মীরি বরীওলা শবডেগ ঢাকাবাসীদের নয় বরং সুনির্দিষ্টভাবে কাশ্মীরি শবডেগ। এসব শবডেগে কোরমার মসলা বিশেষ পরিমাণে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। … অবশ্য কিছু লোক তন্দুরের সাহায্যে শবডেগ রান্না করে থাকেন এবং মসলাও এখানকার (ঢাকার) পরিমাণে ব্যবহার করে থাকেন। এগুলোর স্বাদ ও সুগন্ধি খুবই উত্তম হয়। শবডেগ খাসির মাংসেরই রান্না হয় এবং সেরে চার টুকরা করার প্রথা রয়েছে, যদিও এখন কিছু কিছু লোক এক সেরে আট/দশ টুকরা করে থাকেন। কিন্তু এটি প্রাচীন প্রথার ব্যতিক্রম তো বটেই, অধিকন্তু এতে করে গোশতের খাস্তাভাব এবং পনিরভাব তৈরি হয় না। কাজেই এক সেরে আট/দশ টুকরা করা একটি গর্হিত প্রক্রিয়া (অসুন্দর পন্থা) এবং শবডেগের বিকৃতি ঘটান। কিন্তু এখন তো এমন রুচিহীনতার প্রচলন ঘটেছে যে, শালগমের কোরমা রান্নাকে লোকেরা শবডেগ মনে করে। এর কারণ কী? কারণ এই যে, এখন শবডেগের অনুরাগীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং এ জন্য এর রান্নাকারী বাবুর্চির সংখ্যাও কম রয়ে গেছে। যা হোক, ঢাকার শবডেগের একটি বড় গুণ যে, এটি ভাত ও রুটি উভয়ের সঙ্গেই খাওয়া যায়। যদিও শিরমালই শবডেগের জন্য উপযুক্ত জিনিস।’
হাকিম হাবিবুর রহমান যে কাশ্মীরি বরীওলা শবডেগের কথা বলছেন, সেটা মূলত কাশ্মীর ভেরিওলা শবডেগ। বাংলায় অনুবাদের সময় অনুবাদক এটাকে ‘বরীওলা’ বলে উল্লেখ করেছেন। কাশ্মীরে গরমমসলার একটি মিশ্রণ তৈরি করা হয় আদা, রসুন, পেঁয়াজপাতা, লবণ, গুঁড়া মরিচ, গোলমরিচ, ধনিয়া, জিরা, এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, শুকনা পুদিনাপাতা আর সামান্য তেল মিশিয়ে। এই মসলার মিশ্রণকেই ভেরি বা ভের বলা হয়। এটাই ছিল ঢাকায় থাকা কাশ্মীর থেকে আগত মানুষদের শবডেগের অন্যতম উপাদান।
কাশ্মীরি শবডেগ নিয়ে আলোচনা করার কারণ হলো এই খাবার সেখান থেকেই ভারতবর্ষের বড় বড় শহরে ছড়িয়েছে। শুরুটা নাকি কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক শাহ মীরের সময় থেকে। বলা হয় পারস্য থেকে তারা এসেছিল কাশ্মীরে। শাহ মীর বংশের দুই শ বছরের রাজত্বে এই খাবার কাশ্মীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মোগল আমলে কাশ্মীর ছিল মোগলদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের স্থান। সেখান থেকেই শবডেগ চলে আসে দিল্লিতে। আর নগরীটি তখন গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক তীর্থ। ফলে এ খাবার ছড়িয়ে পড়তে আর কতক্ষণ! তবে মোগল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে মোগল শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জেগে উঠেছিল দিল্লির পাশেই- অযোধ্যা নগরী। এখানকার নবাবেরা ছিলেন বেজায় খাদ্যরসিক। তাদের স্বর্ণযুগে দিল্লির পাচকেরা পাড়ি দেয় অযোধ্যা রাজ্যে। মাইনেও ছিল দিল্লির চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। সে কারণে আওধি খাদ্যতালিকায়ও পাওয়া যায় শবডেগ। আর ঢাকায় এই খাবার আসার অনেক সূত্র থাকতে পারে। মোগল শাহজাদাদের অনেকেই ঢাকায় ছিলেন। তাদের পাচকেরা এটা রাঁধতে পারে। অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল কলকাতার গার্ডেন রিচ বা মেটিয়াবুরুজে। সেখান থেকেও চলে আসতে পারে এই খাবার ঢাকায়। আবার ইংরেজ শাসনামলেও ঢাকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র, সে সময়েও ঢাকায় ব্যবসা করতে আসা কাশ্মীরির সংখ্যাও কম ছিল না। ফলে তারাও সঙ্গে নিয়ে আসে তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য- শীতকালের খাবার শবডেগ। উল্লেখ প্রয়োজন, ঢাকার কাগুজে নবাব বংশের প্রতিষ্ঠাতা খাজা আলিমুল্লাহর চাচা খাজা হাফিজুল্লাহ কাশ্মীরি কাশ্মীর থেকে ঢাকায় এসে লবণ আর চামড়ার ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
ঢাকার শবডেগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, এটা তৈরি হতো কেবল খাসির মাংসে। উৎপত্তিস্থল কাশ্মীরে, শবডেগের মাংস হতো মোরগ কিংবা রাজহাঁসের। মোগল দরবারে এসে সেটা খাসি বা ভেড়ায় পরিণত হয় বলেই ধারণা খাদ্যবোদ্ধাদের। এখন দিল্লি আর লক্ষ্ণৌর কিছু রেস্টুরেন্টে শবডেগ রয়েছে, তবে সেই পুরোনো স্বাদ দেয় কেবল দিল্লির লাল কুয়ার হাকিম অ্যান্ড সন্স। কারণ, তারা এখনো রাতভর জ্বাল দিয়ে তৈরি করেন এই খাবার। এখন এ খাবারে খন্ড মাংসের পরিবর্তে কোফতা দেয় অনেকে, তবে সেটা গর্হিত প্রক্রিয়া বলাই যায় হাকিম সাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে।
কাশ্মীরের ঘরে ঘরে এখন আর শবডেগ তৈরি হয় না। জনজীবনের মতো সংঘাতের শিকার হয়ে গেছে এই খাবারও। রক্তপাত সেখানে হারিয়ে দিয়েছে ঐতিহ্যকে। আর ঢাকায়, আধুনিকতা আর ব্যস্ত জীবনে রাতভর রান্নার সময় কার? ঢাকার শবডেগ হারিয়ে গেছে আরও অনেক খাবারের সঙ্গে, সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেই স্বাদ আর আভিজাত্য। বিশ্বায়নের নামে তাই পুরান ঢাকায়ও এসেছে বহুজাতিক ফ্রায়েড চিকেন, পিৎজা আর বার্গারের চেইন।
ঢাকাই শবডেগের রেসিপি পুরান ঢাকার বাবুর্চিদের কাছে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকে নামই শোনেননি! তাই রেসিপির জন্য দ্বারস্থ হতে হলো নয়াদিল্লি শেরাটনের এক্সিকিউটিভ শেফ রাজদীপ কাপুরের। এখনকার শবডেগ আর রাতভর রান্নার জিনিস নেই, মাত্র এক ঘণ্টায় তৈরি হয়ে যায়! সেই শালকাঠের কয়লার ঘ্রাণ পাওয়া যাবে না, মাংসের থেকে আসবে না খাস্তাভাব আর পনিরভাব। তবু হাতের কাছে থাকা রেসিপিকে অবজ্ঞা করাও হয়তো ঠিক হবে না।
?রসিপি
উপকরণ: শর্ষের তেল ১/২ কাপ, জিরা ১ চা-চামচ, লবঙ্গ ২টি, দারুচিনি ২টি, কালো এলাচি ২টি, এলাচি ২টি, তেজপাতা ২টি, পেঁয়াজবাটা ২ চা-চামচ, আদাবাটা ১ চা-চামচ, রসুনবাটা ১ চা-চামচ, খাসির মাংস ২৫০ গ্রাম (৫ টুকরা), টমেটো পিউরি ২ চা-চামচ, ইয়েলো চিলি পাউডার ২ টেবিল চামচ, হলুদ ১/২ চা-চামচ, ধনিয়াগুঁড়া ১/২ চা-চামচ, মরিচগুঁড়া ১/২ চা-চামচ, লবণ স্বাদমতো, শালগম ২টি (কিউব করে কাটা), গরমমসলা (গুঁড়া) ১/২ চা-চামচ, পানি ৩/৪ কাপ।
প্রণালি: মাঝারি আঁচে শর্ষের তেল একটি সসপ্যানে গরম করে তাতে জিরা, লবঙ্গ, দারুচিনি, কালো এলাচি, এলাচি, তেজপাতা হালকা ভেজে নিতে হবে। এরপর তাতে এক এক করে পেঁয়াজ, রসুন ও আদাবাটা দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে হবে। যোগ করতে হবে খাসির মাংস। মসলার সঙ্গে ভালোমতো মিশিয়ে ২ মিনিট পর তাতে টমেটো পিউরি যোগ করতে হবে। এরপর প্রথমে ইয়েলো চিলি পাউডার, হলুদগুঁড়া, ধনিয়াগুঁড়া, মরিচগুঁড়া, লবণ পাত্রে ঢেলে ভালোমতো মিশিয়ে নিতে হবে। এবার যোগ করতে হবে শালগম। ভালোমতো নেড়ে পাত্রে দিতে হবে গরমমসলা আর পানি। এবার চুলার আগুন কমিয়ে, পাত্রটি ঢেকে কমপক্ষে আধঘণ্টা রেখে দিতে হবে। হয়ে গেলে সেটা সার্ভিং ডিশে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে।

তথ্যসূত্র:
মুন্সি মীর আমান দেহলভি, বাগ ও বাহার (দ্য গার্ডেন অ্যান্ড দ্য স্প্রিং) লন্ডন, ১৮৫২
হাকিম হাবিবুর রহমান, ঢাকা পাচাস বারাস পহেলে, লাহোর, ১৯৪৯
সালমা হুসেইন, দ্য এম্পেরর’স টেবিল, দিল্লি, ২০০৮
হোটেল শেরাটন, নয়াদিল্লি ও ইন্টারনেট।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top