ফিচার I ব্যাডমিন্টন বৃত্তান্ত
প্রাচীন গ্রিস থেকে ব্রিটেন, তারপর ভারতবর্ষ। সেখান থেকেই আজকের ব্যাডমিন্টনের উৎকর্ষ ও প্রসার। এখনো শীতের বিনোদন হয়ে টিকে আছে। লিখেছেন শুভ্র মিসির
দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে ৪৪ বাই ২০ ফুট। মাঝখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রেখে, দুই পাশের অংশে সমান করে চারটি বড় এবং ছোট দুটি বক্স। দুই প্রান্তে। মাঝের জায়গায় টানানো হয় নেট। তারপর বিশেষ এক ধরনের ব্যাট বা র্যাকেট হাতে পালকের তৈরি কর্ক, ফেদার কিংবা শাটল দিয়ে খেলা হয় ব্যাডমিন্টন। তারুণ্যের খেলা।
আমাদের দেশে বছরজুড়েই নানান ধরনের খেলার প্রচলন থাকলেও ব্যাডমিন্টন শীত মৌসুমেরই ক্রীড়া। এর সঙ্গে রয়েছে বায়ুপ্রবাহের উপস্থিতির সম্পর্ক। শহর কিংবা গ্রাম—শীত এলেই তরুণদের মধ্যে এ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। গ্রামে এখনো বেশ খোলামেলা জায়গা থাকার কারণে কোর্ট তৈরি করে ব্যাডমিন্টন খেলতে তেমন বেগ পেতে হয় না। কিন্তু শহরের হিসাব ভিন্ন। একটু খোলা পরিবেশে হাঁটার জায়গাই যেখানে নেই, সেখানে ব্যাডমিন্টনের জোগাড়যন্ত্র করাটা কঠিন বৈকি। কিন্তু তাতে কার কী এসে গেল, শীত এসেছে আর ব্যাডমিন্টন হবে না, তা তো হতেই পারে না। কোর্ট তৈরির মতো অল্প জায়গা হলেই হলো, দল বেঁধে নেমে পড়ে উৎসাহীরা। খালি জায়গা উঁচু-নিচু হলেও যেন সমস্যা নেই। সেখানে ভিটিবালু বা মাটি ফেলে সমান করে নেওয়া হয়। অল্প ব্যবহৃত রাস্তাও বাদ যায় না তখন। খেলা হয় ছাদে। অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা অভিজাত বাড়ির লনেও খেলতে দেখা যায়। তবে ব্যাডমিন্টনের ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু জানা যায় না।
যত দূর জানা যায়, প্রায় ২০০০ বছর আগে যিশুখ্রিস্টের জন্মের সময় প্রাচীন গ্রিসে এক বিশেষ ধরনের খেলার প্রচলন ছিল, যাতে গ্রিকরা শাটলকক ব্যবহার করত। প্রাচীন জাপানেও ব্যাডমিন্টনের মতোই একধরনের খেলা প্রচলিত ছিল। ছোট চওড়া কাঠের তৈরি বিশেষ ব্যাট এবং উজ্জ্বল রং করা শাটলককের সাহায্যে এই খেলার নাম ছিল হানেটসুকি। বিশেষ করে নববর্ষের দিনে সেই সময়কার জাপানের ঐতিহ্যবাহী খেলা ছিল এটি। এ খেলার আরেক নাম ছিল ওইবানে। শাটলককের বদলে গোল উলের বল দিয়েও এটা খেলা হতো।
ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, এই খেলা গ্রিস থেকেই পরবর্তী সময়ে পূর্ব দিকের দেশগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কালক্রমে ব্রিটেন, ভারত, চীন ও থাইল্যান্ডে বিস্তার লাভ করে। ষোলো শতকে এই খেলা ব্রিটিশদের মাঝে ব্যাটলডোর অ্যান্ড শাটলকক নামে পরিচিত ছিল। মধ্যযুগ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত খেলাটি ব্রিটেনের গ্রামাঞ্চলে শিশুদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে ব্রিটেনের পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাটলডোর অ্যান্ড শাটলকক উচ্চ শ্রেণির মানুষদের কাছে আধুনিক খেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ব্যাটলডোর অ্যান্ড শাটলকক থেকে খেলাটির নাম কীভাবে ‘ব্যাডমিন্টন’ হলো? এই খেলা ব্রিটেনেই প্রথম জনপ্রিয়তা পায়। দক্ষিণ-পশ্চিম ব্রিটেনের একটি প্রদেশ গ্লোচেস্টারশায়ার। এখানকার একটি ছোট্ট গ্রাম ব্যাডমিন্টন, যা যাজকপল্লি নামে পরিচিত। গ্লোচেস্টারশায়ারের শাসক ডিউক অব বিউফোর্টের একটি বিখ্যাত বাড়ি আছে এখানে, যা ‘ব্যাডমিন্টন হাউস’ নামে পরিচিত। তো ওই বাসিন্দারা এই খেলা ভালোবাসত। সেখান থেকেই ব্যাডমিন্টন গ্রাম বা ব্যাডমিন্টন হাউস অনুসারে এ খেলার নাম ব্যাডমিন্টন রাখা হয়েছে। তবে এই নামকরণের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল আইজ্যাক স্পার্ট নামক এক খেলনা ব্যবসায়ীর। ১৮৬০ সালে তিনি একটি বই লেখেন, ‘ব্যাটলডোর ব্যাডমিন্টন: আ নিউ গেম’ শিরোনামে। সেটি ছিল মূলত এই খেলার নিয়মকানুন নিয়ে। বইটির কোনো কপি পরবর্তীকালে আর পাওয়া যায়নি।
তবে ব্যাডমিন্টনের যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে ব্রিটিশ ভারতের গ্যারিসন টাউন হিসেবে পরিচিত পুনে রাজ্যে। এখানকার ইংরেজ অফিসার ও সৈনিকেরা ১৮৭৩ সাল নাগাদ ব্যাডমিন্টনের নেট, কোর্ট, পয়েন্ট, দুজনের বদলে চারজন খেলোয়াড়সহ বেশ কয়েকটি নিয়ম চালু করেন। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন রাবার ব্যবহার করে বানানো হয় আধুনিক শাটলকক। সেখান থেকেই এখনকার ব্যাডমিন্টনের যাত্রা শুরু। কয়েক বছর পর এই অফিসাররা নিজ দেশ তথা ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে পরিবর্তিত রূপে খেলাটি পরিচয় করিয়ে দেন সবার কাছে। কয়েক বছরের মধ্যেই তা ব্রিটেনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশন অব ইংল্যান্ড। ১৮৯৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় খেলাটির প্রথম টুর্নামেন্ট। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডের উদ্যোগে ১৯৩৪ সালে গ্লোচেস্টারশায়ারেরই আরেক শহর চেলটেনহ্যামে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন সংস্থা। ধীরে ধীরে এশিয়ার প্রায় সব দেশ এই সংস্থায় যোগ দেয়। ২০০৬ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের পর গঠিত হয় বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন।
ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের দেশে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। স্বাধীনতার আগে এটি ছিল কেবল শহরাঞ্চলেরই খেলা। কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রামাঞ্চলেও ব্যাডমিন্টন জনপ্রিয়তা পায়। একটা সময় শীত আসতে না-আসতেই পাড়ায় পাড়ায় ব্যাডমিন্টন কোর্ট তৈরির ধুম লেগে যেত। আগে পাড়ায় বা মহল্লায় খোলা জায়গা ছিল, আস্ত মাঠও ছিল কোথাও কোথাও, তখন বেশ আয়োজন করে কোর্ট বানানো হতো। চাঁদা ওঠানো হতো এলাকার সবার কাছ থেকে। নেট কেনা, বাঁশ পুঁতে নেট বাঁধা, সীমানা কাটা, শাটলকক কিনে রাখা—খরচ তো কম নয়! আবার রাতে খেলার জন্য বাতির ব্যবস্থা করা, ইলেকট্রিসিটির লাইন আনা—সবই ছিল উৎসবের মতোই।
আজকাল ব্যাডমিন্টনের এই জৌলুশ আর নেই। কারণ, খোলা জায়গার অভাব আগেই বলা হয়েছে। অন্যদিকে সামাজিক বন্ধনও কেবল শিথিল হয়নি ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, পরিবারে-পরিবারে বিচ্ছিন্নতাও দেখা দিয়েছে। তবে যারা ক্রীড়ামোদী, বিশেষত খেলার মধ্যে যারা বিনোদন খোঁজেন, তাদের অনেকেই এখনো ব্যাডমিন্টন খেলে থাকেন।
এখনো শীত এলে রাতের বেলা বাতি জ্বালিয়ে কিছু উৎসাহী ও ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ ব্যাডমিন্টন খেলে থাকেন। কিন্তু নেই সেই আগের আমেজ। যখন হরদম খেলা হতো, তখন দেখা যেত চারজনের বেশি খেলা যায় না বলে কোর্টের পাশেই হয়ে যেত বড় ভাই-ছোট ভাই আর বন্ধুদের দারুণ আড্ডা। হইহুল্লোড় লেগে থাকত পুরোটা সময়। খেলা দেখার জন্যও ভিড় করত অনেকে। ব্যাডমিন্টনকে কেন্দ্র করেই সন্ধ্যাকালীন দেখা-সাক্ষাৎ হতো। চাঁদা তুলে কখনো কখনো পিকনিকের আয়োজনও হতো। আনন্দের সেই উদ্্যাপনের দিনগুলো আজ অনেকটাই স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। গ্রাম বা শহর—সবখানের চিত্রই অনেকটা এমন।
ব্যাডমিন্টন যে শুধু নিপাট আনন্দ লাভের জন্যই খেলা হয় তা নয়। এই খেলার আছে দারুণ শারীরিক উপকারিতা। ওজন কমাতে ব্যাডমিন্টনের জুড়ি নেই। খেলাটি ভীষণ পরিশ্রমের তো বটেই, পাশাপাশি শরীরের প্রায় সব মাসলই ব্যবহৃত হয়। এক ঘণ্টা খেললে ৪৮০ ক্যালরি বার্ন হয়ে থাকে। ফলে স্থূলকায় মানুষদের জন্য ব্যাডমিন্টন দারুণ উপকারী। নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেললে হৃদপিন্ডের কার্যক্ষমতা বাড়বে, হাড়ের ঘনত্ব বাড়ে এবং হাড় মজবুত করে, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও কমায়। পাশাপাশি ব্যাডমিন্টন কাজ করার আগ্রহ ও একাগ্রতা বাড়াতেও সাহায্য করে থাকে।
নগরায়ণ, আধুনিকতা, প্রযুক্তির ব্যবহারে খোলসবন্দি হয়ে পড়েছি আমরা। অনেকেই বলবেন, কর্মব্যস্ত জীবনে ছুটির ফুরসত মেলা যেখানে ভার, সেখানে আবার ব্যাডমিন্টন! জায়গার অভাব, তবু খোলা রাস্তায় কিংবা ছাদে দেখা যায় ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে।
ছবি: ইন্টারনেট