ইভেন্ট I ফোক ফেস্ট
গানের দেশ বাংলাদেশ। এখানকার প্রকৃতি আর গণযাপনের মধ্য থেকে তৈরি হয় সুর, বাঁধা হয় গান। তাতে ধরা থাকে লোকজীবনের সুখ-দুঃখ-প্রেম-বিরহ-ভক্তি-বিদ্রোহ। বঙ্গীয় লোকগানের সঙ্গে বন্ধন তৈরি হয় বিভিন্ন জাতির সুরবৈচিত্র্যের। এই সংযোগ তৈরি করার গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্টিভ্যাল। এ বছর উৎসবটি অনুষ্ঠিত হলো ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর। বিশ্বের লোকসংগীতের একঝাঁক শিল্পী ও গানের দলের জমায়েতে বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে চাঁদের হাট।
প্রয়াত সুবীর নন্দী, শাহনাজ রহমতউল্লাহ ও আইয়ুব বাচ্চুর মতো শিল্পীদের স্মরণ করে এই উৎসবের সূচনা হয় গত ১৫ নভেম্বর। শুরুতেই ছিল ‘প্রেমা ও ভাবনা’ নৃত্যদলের পরিবেশনায় সিলেটের ধামাইল নৃত্য। পরিচালনায় ছিলেন সামিনা হোসেন প্রেমা। ধামাইল লোকনৃত্যের ছন্দে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছিল ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসব প্রাঙ্গণ।
প্রথম দিনেই জর্জিয়ার লোকসংগীত পরিবেশন করে সেখানকার গানের দল শেভেনেবুরেবি। জর্জিয়ার নানা ধরনের আঞ্চলিক লোকবাদ্যযন্ত্রের তালে তাদের গানে মেতে উঠেছিল এই উৎসবে সমবেত দর্শক-শ্রোতারা। এই দলের সূচনা ২০০১ সালে।
সূচনার দিন যার গানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন শ্রোতা-দর্শকেরা, তিনি হলেন শাহ আলম সরকার। লোকগানের অগুনতি অ্যালবাম রয়েছে তার। একসময় এই শিল্পীর লেখা ও সুর করা গান গেয়েছিলেন শিল্পী মমতাজ। শাহ আলম সরকারের লোকগান এই উৎসবকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে।
প্রথম দিনের শেষ শিল্পী ছিলেন দালের মেহেন্দি। ভারতের পাঞ্জাবের ভাঙরা তাঁর মূল পরিচিতির জায়গা হলেও বলিউডি চলচ্চিত্রে গানের বদৌলতে তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। প্রমাণ পাওয়া গেল এই উৎসবেও। নিজের বলিউডি সত্তাকেই উৎসবের মাঝে বেশি করে মেলে ধরেছিলেন দালের মেহেন্দি। তা উপভোগ করেছেন শ্রোতা-দর্শকেরা। কিন্তু ফোক ফেস্টের চরিত্র তাতে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
দ্বিতীয় দিনের শুরুতে সংগীত পরিবেশন করেন রাব্বি ও শফিকুল। এরপর মঞ্চে ওঠেন কাজল দেওয়ান। মাতাল কবি হিসেবে খ্যাত বাউলগীতির জনপ্রিয় লোকশিল্পী আবদুর রাজ্জাকের পুত্র তিনি। একের পর এক পালাগান, ফকিরি গান ও অন্যান্য লোকসংগীত পরিবেশন করে শ্রোতা-দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন।
এরপর গান শোনালেন পাকিস্তানের সুফি ঘরানার শিল্পী হিনা নাসরুল্লাহ। কোক স্টুডিওতে সংগীত পরিবেশনের জন্য তিনি বিখ্যাত। সিন্ধি ও উর্দু ভাষায় চমৎকার সব সুফি সংগীত পরিবেশন করলেন। এরপর মঞ্চে ওঠেন বাংলাদেশের ফকির শাহাবুদ্দিন। ফকিরি গান দিয়ে তিনি আবারও মাতালেন শ্রোতাদের।
ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবের এবারের সেরা একটি অর্জন ছিল মালির হাবিব কইটে অ্যান্ড বামাদা। নব্বই দশকের শুরু থেকেই তিনি গোটা বিশ্বে জনপ্রিয় তার প্রথম অ্যালবাম ‘মুসো কো’র জন্য। তার গিটার বাজানোর বিশেষ আঙ্গিক ও গায়কি শ্রোতাদের আচ্ছন্ন করে। এই উৎসবেও সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে এই শিল্পীর গান।
তৃতীয় দিনের সূচনা হয় মালেক কাওয়ালের কাওয়ালি দিয়ে। বাংলা কাওয়ালি ও মাইজভান্ডারি গানের মাধ্যমে উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি। এরপর মঞ্চে ওঠে ‘সাত্তুমা’ ব্যান্ড। এটি রাশিয়ান কারেলিয়া অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি ব্যান্ড। ২০০৩ সালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই ব্যান্ড তৈরি হয়েছিল। ফোক ঘরানার গান নিয়ে সাত্তুমা ঘুরে বেড়িয়েছে ইউরোপের নানা প্রান্তে। এই উৎসবের মঞ্চে তাদের সংগীত পরিবেশনের পাশাপাশি বিচিত্র বাদ্য ও সুরযন্ত্র দর্শক-শ্রোতাকে সম্মোহিত করেছিল।
শেষ দিনের উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ ছিলেন শিল্পী চন্দনা মজুমদার। তাঁর কণ্ঠে গাওয়া লালনগীতি বাংলাদেশসহ অখন্ড বাংলার মানুষকে আবিষ্ট করে রাখে। এই উৎসবেও ব্যতিক্রম হয়নি। দর্শক-শ্রোতাদের মনে ভক্তিভাবের পরশ রেখে গেলেন তিনি। উৎসব শেষ হলো পাকিস্তানের সুফি ব্যান্ড ‘জুনুন’-এর সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। দলটির চতুর্থ অ্যালবামের প্রথম গান ‘সাইওনি’ এই উৎসবে আলোড়ন তুলেছে। জুনুনের একগুচ্ছ গানের মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে এবারের উৎসব।
সান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এবারের আয়োজনে কোনো খামতি দেখা যায়নি। ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো ত্রুটি চোখে পড়েনি।
অতনু সিংহ
ছবি: ওমর ফারুক টিটু