সেলুলয়েড I সীমান্তরেখা (প্রামাণ্যচিত্র, ২০১৭)
গবেষণা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: তানভীর মোকাম্মেল
প্রযোজনা: কিনো ফিল্মস
চিত্রগ্রহণ: তুলি রায়
রাকিবুল হাসান
মহাদেব শী
সম্পাদনা: মহাদেব শী
বাংলা ভাষায় সমান্তরাল ধারার চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল ২০১৭ সালে বাংলা ভাগের ৭০ বছরে তৈরি করেছিলেন ‘সীমান্তরেখা’ নামের একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যরে ডকুমেন্টারি ফিল্ম। ছবিটি মূলত ১৯৪৭-এর বাংলা ভাগকে কেন্দ্র করেই। এর আগে ১৯৯৮ সালে ‘চিত্রা নদীর পারে’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যরে কাহিনিচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। তাতে তুলে ধরা হয়েছিল দেশভাগের ফলে পূর্ব বাংলা বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি হিন্দুদের জীবনে নেমে আসা দুর্ভোগের আখ্যান চিত্র। এই ‘সীমান্তরেখা’ নামের ডকুমেন্টারিতে তিনি প্রকাশ করলেন ১৯৪৭ এবং এর আগের বাংলাদেশ ও সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষের স্থানান্তরের চিত্র। শুধু তা-ই নয়, দেশভাগের পেছনে কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগের রাজনীতির বিশ্লেষণও রয়েছে।
ছবিটিতে পরিচালক স্বীকার করেছেন, দেশভাগের সুফল খানিকটা মুসলমানরাই বাংলা ভাগের প্রভাব ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবার উপর পড়েছে, তা দেখিয়েছেন পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। আবুল হাসিম, সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসুরা ভারত ভাগের আগের মুহূর্তে যেভাবে ভারত-পাকিস্তানের সমান্তরালে অখন্ড স্বাধীন বাংলা তৈরির প্রস্তাব এনেছিলেন, তাতে বাংলা ভাগ না হয়ে ভারত ভাগ হলে যে বাঙালির যে কিছু যেত আসত না, সেই বিষয়টিও একভাবে এই ছবিতে উঠে এসেছে। এই তথ্যচিত্র শুরু হচ্ছে পূর্ব বাংলা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া একটি বাঙালি হিন্দু পরিবারের দুই প্রবীণ মহিলার সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে, যারা বহু যুগ পর আবার রাজশাহীতে তাদের ভিটেমাটির সন্ধানে যাছেন। আবার একইভাবে এক বাঙালি মুসলিম প্রবীণাকে দেখানো হয়েছে, যিনি একসময় পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আজকের বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায় তার বাড়িতে ফিরে আসার দৃশ্য দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। ক্যামেরা ঘুরেছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনিতে, উঠে এসেছে অসমের ভারতে যাওয়ার ইতিহাস, ভারতের আন্দামানেও পূর্ববঙ্গ থেকে মাইগ্রেট করা বাঙালি হিন্দুদের সাক্ষাৎকার রয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। বাংলাদেশে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহীর বেশ কিছু দৃশ্য রয়েছে। উঠে এসেছে ভারতের অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনের ইতিহাস। যেখানে ১৯৫২ সালের মতোই শহীদ হয়েছিলেন বাঙালিরা। যে ভাষা সংগ্রামে আমরা দেখতে পাই কমলা ভট্টাচার্যের মতো নারী ভাষাশহীদকে। দেশভাগের বলি হিসেবে এই ছবি সীমান্তে শহীদ ফেলানী খাতুনের সীমান্ত মৃত্যুর করুণ ঘটনাকেও তুলে এনেছে। ছবির শেষের দিকে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিমের মধ্যে বিবাহের মাধ্যমে সম্প্রীতির জয়গান গাওয়া হচ্ছে। যাতে আন্তসাম্প্রদায়িক সুখী দাম্পত্য জীবন দেখানো হয়েছে। এই ছবিতে দুই বাংলার বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎকারে রয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, বামপন্থী তাত্ত্বিক নেতা বদরুদ্দীন উমর, অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী পবিত্র সরকার প্রমুখ। গণসংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়কেও ক্যামেরায় ধরা হয়েছে।
কিন্তু এই ছবির ক্ষেত্রে দুর্বলতার মূল দিকটি হলো, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের অংশ যতটা প্রবলভাবে তুলে আনা হয়েছে, বাংলাদেশের অংশ সে তুলনায় কম। অন্যদিকে বাঙালি মুসলিম ও নমশূদ্রদের পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণকে ধরতে এটি ব্যর্থ হয়েছে। বাঙালি হিন্দুর দৃষ্টিকোণ এ ছবিতে যতটা প্রতিফলিত, সাতচল্লিশকে ঘিরে বাঙালি মুসলিমের মনোজগৎ সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
প্রামাণ্যচিত্রের নান্দনিক ভাষা আর নিউজ রিলের তথ্যজ্ঞাপনের ধরন এক নয়। ইন্টারভিউ, ধারাভাষ্য ও লাইব্রেরি ফুটেজ ডকুমেন্টারির জন্য যথেষ্ট নয়। ডকুমেন্টারি তো আসলে সিনেমাই, কিন্তু এই ছবিতে ডকু-ছবির ভাষা দুর্বল। মনে রাখা উচিত, ডকুমেন্টারিতে ঘটনা ও তথ্য তুলে আনলেই তা সিনেমার শর্তপূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। সিনেমার নিজস্ব ভাষায় তথ্যজ্ঞাপন ও বিশ্লেষণ ডকুমেন্টারির পূর্বশর্ত। কিন্তু তা এখানে মান্য হয়নি।
অতনু সিংহ
কুইজ
১. ‘সীমান্তরেখা’র আগে তানভীর মোকাম্মেলের কোন কাহিনিচিত্রে দেশভাগের প্রসঙ্গ এসেছে?
ক। নদীর নাম মধুমতী
খ। চিত্রা নদীর পারে
গ। লালসালু
২. কোথাকার ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ এই ডকুমেন্টারিতে উঠে এসেছে?
ক। ঢাকা
খ। মালভূম
গ। বরাক
৩। কোন গণসংগীতশিল্পী এই তথ্যচিত্রের ক্যামেরায় ধরা পড়েছেন?
ক। প্রতুল মুখোপাধ্যায়
খ। কফিল আহমেদ
গ। হেমাঙ্গ বিশ্বাস
গত সংখ্যার বিজয়ী
১. আকিরা চৌধুরী, বাড্ডা, ঢাকা।
২. সামারা সুলতানা, ধানমন্ডি, ঢাকা।
৩. শামস আদনান, উত্তরা, ঢাকা।