skip to Main Content

ফিচার I আম্রলিপি

পৌরাণিক কাল থেকেই আম প্রধান একটি ফল হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। নানা উপাখ্যান ও লোককথার জন্ম দিয়েছে এটি। ক্রমেই হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির বিশেষ এক উপাদান। লিখেছেন শিবলী আহমেদ

প্রাচীনকাল থেকেই কবি-লেখকেরা আমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সাহিত্যে এই ফলের উপস্থিতি বিপুল। এমন সুখ্যাতির কারণেই আমগাছের আরেক নাম কল্পতরু। এ ফলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনীতি, গল্প, কাব্য, সংগীতসহ মানুষের নানা আচার আর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। নবাব, রাজা, জমিদার, সামন্ত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ভালো জাতের আমের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল এটি। বাংলাদেশে ধান ও পাটের পর আম চাষকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
গবেষণায় প্রমাণিত, আমের আদি নিবাস বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আশপাশের মিয়ানমার, ত্রিপুরা ও মিজোরামে। তবে বিশারদ ও ফলবিজ্ঞানীদের মধ্যে এর জন্মস্থান নিয়ে মতবিরোধ আছে। সিংহভাগ বিশেষজ্ঞের রায়, আমের আদি জন্মভূমি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হিমালয়সংলগ্ন এলাকা, মিয়ানমার, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মালয়ে। বিরোধীদের ভাষ্যে, ফলটি এসেছে ইন্দো-চায়না থেকে। অর্থাৎ ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস ও ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল এর আদি নিবাস।
আম ছিল পাহাড়ি ও বুনো ফল। সেখান থেকে সুমিষ্ট জাতগুলো সংগ্রহ করে বাড়ির আঙিনায় রোপণ শুরু করে মানুষ। এভাবেই এটির চাষাবাদের সূচনা। আবাদ হচ্ছে ৬ হাজার বছর আগে থেকে। তবে আমের উৎপত্তি নিয়ে কিছু লোককথা আছে। যেমন ভারতীয় প্রাচীন উপাখ্যানে বলা হয়, এটি এসেছে স্বর্গ থেকে। লঙ্কারাজ রাবণপুত্র মেঘনাদ ইন্দ্রপুরী জয় করার পর সেই স্থানে সহস্রাধিক ফলের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি সেখানকার শ্রীফল খান এবং সেটিকেই শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে লঙ্কায় নিয়ে আসেন। সঙ্গে আনেন ওই ফলের বীজ ও চারা। শ্রীফলই আম। সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। কীভাবে বিস্তৃত হলো, সে বিষয়েও উপাখ্যান আছে। রাজা রামচন্দ্র যখন লঙ্কা জয়ের উদ্দেশে এগোচ্ছিলেন, তখন হনুমান ছিলেন অগ্রবর্তী দলে। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লঙ্কায় পৌঁছানোর পর আমবাগান দেখতে পান হনুমান। গাছে গাছে পাকা আম ঝুলছিল। সেই ফলের স্বাদ তাকে বিমোহিত করে। আম খেয়ে খেয়ে উত্তর দিকে আঁটি ছুড়তে লাগলেন হনুমান। তা সমুদ্র পার হয়ে তামিলনাড়ু অঞ্চলে গিয়ে পড়ল। সেখান থেকে আম ধীরে ধীরে মুম্বাই, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, সিন্ধু, পাঞ্জাব ও বাংলায় এসে পৌঁছেছে। এই উপাখ্যান পৌরাণিক। ইতিহাস বলে, মুসলিম মিশনারিদের মাধ্যমে এই উপমহাদেশ থেকে আমের বীজ ও চারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর আফ্রিকায় ছড়িয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পর্তুগিজ বণিকদের মাধ্যমে এই দেশ থেকে ফলটি ব্রাজিল, জ্যামাইকা ও মধ্য আমেরিকায় পৌঁছেছে। খ্রিস্টজন্মের ৫০০ বছর আগে দক্ষিণ ভারতের তামিল ও তেলেঙ্গানার মানুষ নৌপথে জাভা, সুমাত্রা, মালয়, কম্বোডিয়া, বোর্নিও অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। সেকালেই দক্ষিণ ভারত থেকে আম গিয়েছে মালয়ে। তবে উদ্ভিদবিদদের মতে, প্রথমে আম চাষের সূচনা হয় মালয় উপদ্বীপেই।
ইংরেজিতে ম্যাঙ্গো, বাংলায় আম। এই দুই শব্দেরই আছে ব্যুৎপত্তিগত ইতিহাস। ম্যাঙ্গো শব্দটি তামিল ভাষা থেকে এসেছে। তবে সরাসরি নয়। সে ভাষায় আমকে বলা হয় ‘মানকে’। ‘মান’ অর্থ আমগাছ আর ‘কে’ অর্থ ফল। সেটি বিকৃত হয়ে হয়েছে ‘মাংকে’। তামিলনাড়ু অঞ্চলের কন্যাকুমারিকাসহ এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এসে পর্তুগিজরা ম্যাংকের দেখা পায়। সেটিকে তারা নিজেদের মতো করে ‘ম্যাঙ্গা’ ডাকা শুরু করে। এই ম্যাঙ্গাই ইংরেজিতে ‘ম্যাঙ্গো’ হয়ে এসেছে। আমের সংস্কৃত রূপ অম্র। তা থেকে আম্র; পরিশেষে আম। সংস্কৃতে অম্রের অর্থ হচ্ছে অমø। আনুমানিক ৩ হাজার বছর আগে আর্যরা উত্তর ভারতের গঙ্গা, যমুনা-সরস্বতী অববাহিকায় এসে কাঁচা আম খেয়েছিল। তারা ফলটির নাম দিয়েছিল অম্র। টক স্বাদের জন্যই এমন নাম।
আমের বিভিন্ন নাম আছে। সেসবের ব্যাখ্যাও রয়েছে। যেমন ফুল থেকে ছোট আম হওয়ার পর ঝড়, শিলাবৃষ্টিসহ কিছু প্রাকৃতিক কারণে তা শাখা থেকে ঝরে পড়ে। এই ফলটিকে বলে ‘চ্যুত’। আরেক নাম সহকার। আমের মুকুলের ঘ্রাণ বহুদূর পর্যন্ত ছড়ায়। তাতে আকৃষ্ট হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে কোকিল, ভ্রমর, মৌমাছিসহ আরও নানা ধরনের পাখি ও পতঙ্গ ছুটে আসে। এই প্রাণীগুলো পরাগায়ন ঘটায়। প্রাকৃতিক পরাগায়নে আমের মুকুল সহায়ক হিসেবে কাজ করে বলে এর নাম হয়েছে সহকার। এর ফুল বসন্তের আগমনী বার্তা জানায়। তাই আমের একটি নাম বসন্তদূত। বেশ কিছু রাজার পছন্দের ফল ছিল আম। যেমন লক্ষ্মণ সেন। সম্রাট আকবরেরও প্রিয় ফলের তালিকায় আম শীর্ষে ছিল। এ ছাড়া অনেক নৃপতি এটিকে প্রিয় ফল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই এর নাম হয়েছে নৃপপ্রিয়। পুরাণে আমের মঞ্জরিকে প্রেমের দেবতা মদনের পুষ্পশর বলা হয়েছে; যা পঞ্চশরের এক শর। এই বাণের আঘাতে তিনি প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে প্রেয়সীর মনে প্রেমাবেগ জাগিয়েছিলেন। নিজে হয়েছিলেন কামাতুর। কামোত্তেজক বলে আমকে ডাকা হয় কামাঙ্গ, কামশর, কামবল্লভ ও সুমদন। মধুর স্বাদের হওয়ায় ফলটির নাম দেওয়া হয়েছে মাধুলি মধ্বারস ও সীধুরস। আমের রস দুধের সঙ্গে মেশালে হয় সোমধারা, যা শুক্রস্রোতকে শুদ্ধ ও বলবান করে। এই রস মাদকতার সৃষ্টি করে বলে আমের সমার্থক নাম মদাঢ্য। রসে ভরপুর হওয়ায় ফলটিকে রসাল নামেও ডাকা হয়। এর গাছে কোকিল বাস করে। তাই বৃক্ষটিকে অনেকে কোকিলাবাস কিংবা কোকিলোৎসব বলে। আমগাছের একটি নাম মন্মথালয়। কারণ, এটি প্রেম ও কামের দেবতা মদন বা মন্মথের আলয়। আমের মুকুলকে বলা হয় কামায়ুধ।
শিল্প, সংস্কৃতি ও ধর্মেও আমের ব্যাপক উপস্থিতি আছে। দেবী সরস্বতীর পূজার প্রধান উপকরণ এর মুকুল। বৈদিক শাস্ত্রমতে, উন্নত মানের পাকা আম দেবতা গণেশের খুব পছন্দের। ফলটি পূজার একটি অনুষঙ্গ। প্রার্থনাকালে তা থাকলে ভক্তের সিদ্ধিলাভ হয় এবং মনের উৎকর্ষ বাড়ে। গণেশ চতুর্দশী উৎসবেও লাগে আমপাতা। রামায়ণের অনেক শ্লোকে এই ফলের উল্লেখ আছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শবদাহ করতে আমকাঠ ব্যবহৃত হয়। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এর পাতার উপস্থিতি রয়েছে। এটিকে তারা মঙ্গলপ্রতীক ভাবে। গৌতম বুদ্ধ আমগাছের ছায়ায় বসে ধ্যান করেছেন। বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে আমপাতার ব্যবহার হচ্ছে।
অলংকরণশিল্পে ঠাঁই পেয়েছে আমের মোটিফ। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দে ভারতের সাঁচিতে নির্মিত বৌদ্ধ স্তূপায় আমগাছের নিচে লক্ষ্মীর মূর্তি খোদাই করা আছে। সেখানে এই ফলের আদলে আঁকা কিছু নকশাও দেখা যায়। এটিই আমের প্রাচীনত্বের নিদর্শন। ইলোরা ও আজান্তা গুহায় প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলা ও ভাস্কর্যে আমগাছ, পাতা, পুষ্পমঞ্জরি ও ফলটিকে তুলে ধরা হয়েছে। গৌড়ের সুলতান নুশরাত শাহ ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহীর অদূরে বাঘা নামের অঞ্চলে যে মসজিদ নির্মাণ করেন, সেটির দক্ষিণের মেহেরাব আমের টেরাকোটা মোটিফে অলংকৃত।
কম্বোডিয়ায় পাওয়া সপ্তম শতাব্দীর একটি লিপিতেও এ ফলের উল্লেখ আছে। ভারতের অনেক বাড়িঘরের দরজার খিলানে এখনো আমপাতার অলংকরণ দেখা যায়। সে দেশের সূচিকর্মেও এর মোটিফ লক্ষণীয়। কাশ্মীরি শাল, কাঞ্জিভরম ও রাজশাহী সিল্ক শাড়িতে আমপাতা কিংবা আম্রমঞ্জরির নকশা আঁকা থাকে। শত বছর ধরে বাংলাদেশের বয়নশিল্লীরা আম, পাতা ও গাছের নিখুঁত এমব্রয়ডারি করে আসছে কাপড়ে। এ রকমই একটি মোটিফ হচ্ছে আম্বি। আমের বিশেষ নকশা এটি। ভারতীয় সূচিকর্মের প্রধান একটি প্রতীক এই আম্বি। বিশ্বের অনেক দেশই কাপড়ে এই নকশা করে। ডিজাইনটি বর্তমানে বিশ্ববাজারে ভারতকে স্বকীয়ভাবে তুলে ধরেছে। মোগল আমলেই এর উৎপত্তি। তাদের কাশ্মীরি জামাভারশালে ম্যাঙ্গো-মোটিফ অঙ্কিত থাকত। কোম্পানি আমলে মোগলদের এই নকশা উপমহাদেশের বাইরে বিস্তৃত হয়। ইংল্যান্ডের নারীদের কাছে এটি বেশ আকর্ষণীয় ছিল। এমনকি সে দেশের তাঁতিদের ‘পেশলি’ নামের একটি গ্রামে স্থানান্তর করা হয়েছিল শুধু ম্যাঙ্গো মোটিফে কাজ করার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকেই এ ধরনের নকশার বিলেতি নাম হয় পেসলি ডিজাইন।
ভারত ও বাংলাদেশে বিয়ের উৎসবে আমপাতার ব্যবহার দেখা যায়। ঘাট থেকে কলসি ভরে পানি আনে বাড়ির মেয়েরা। কলসির মুখে থাকে আমের পত্রমঞ্জরি। সেটি পানিতে ডুবিয়ে বরের মাথায় ছিটিয়ে দেওয়া হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে যে জামাইষষ্ঠীর আয়োজন হয়, তাতে আম আবশ্যিক।
আম কত জাতের হতে পারে, সঠিক হিসাব নেই। গবেষকদের মতে বাংলাদেশেই আছে ১০ হাজার ধরনের। তবে এটি অনুমাননির্ভর গণনা। সারা বিশ্বে তালিকাভুক্ত আমের জাতসংখ্যা ১৫০০। বিজ্ঞানীদের অভিমত, পৃথিবীতে এই ফলের ধরন আছে ১০ হাজার। যেগুলোর অধিকাংশই তালিকাভুক্ত নয়।
বসন্তে আমের মুকুলে গাছ ছেয়ে যায়। শতভাগ ফুলে যদি ফল ধরত, তাহলে হয়তো গাছটাই ভারে ভেঙে পড়ত। পুষ্পমঞ্জরিতে দুই ধরনের ফুল হয়। পুরুষ ও উভলিঙ্গ। পুংপুষ্পে ফল হয় না। উভলিঙ্গতে ধরে। একটি পুষ্পমঞ্জরিতে যত ফুল থাকে, তার মাত্র ১০ শতাংশ উভলিঙ্গ। কিন্তু এই পরিমাণ ফুলও ঝড়ে কিংবা অন্যান্য কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া বেশ কিছু পুষ্প আপনা থেকেই নষ্ট হয়। তাই অযথা মুকুল ছেঁড়া থেকে বিরত থাকলে একটি গাছে বেশি ফল আশা করা যেতে পারে।

এই লেখার তথ্যগুলো মাহবুব সিদ্দিকী রচিত ‘আম’ বই থেকে সংগৃহীত। আম নিয়ে তিন পর্বের লেখার এটি প্রথম কিস্তি।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top