ফিচার I ডায়েটনামা
বাড়তি ওজন কমিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খাদ্য নির্বাচনের নানান পদ্ধতি রয়েছে। ফ্যাশনের মতো ডায়েটেরও আছে বিভিন্ন ট্রেন্ড। এসবের সমকালীন কিছু ধারা নিয়ে লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
প্ল্যান্ট বেসড ডায়েট
এতে শাকসবজির প্রাধান্য বেশি। এখন ভেজিটারিয়ানিজম আর ভেগানিজমের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। ভেজিটারিয়ানরা কোনো ধরনের মাছ বা মাংস খায় না। তবে দুধ, পনির, দই, ডিম, মধু- এসব খেতে পারে। আর ভেগানরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো প্রাণী থেকে উৎপাদিত খাবারই খায় না। ভেগান ডায়েট অনেক আগে থেকেই ছিল। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশকে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষার তাগিদে এখন এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গবাদিপশু উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসরিত হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারার ক্লাইমেট ল্যাবের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি সিঙ্গেল সার্ভিং স্টেক উৎপাদন করতে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হয়, তা তিন মাইল গাড়ি চালানোর সমপরিমাণ। অন্যদিকে শাকসবজি উৎপাদনে এই মাত্রা প্রায়ই শূন্যের কাছাকাছি। তাই ভেগান একটি এথিক্যাল এবং সাসটেইনেবল ডায়েট। এরা শরীরে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে প্ল্যান্ট বেসডের ওপর নির্ভরশীল। যেমন ডাল, সয়া (টফু), বিভিন্ন রকমের বাদাম, শস্যদানা ইত্যাদি। এসব খাবারে যেমন রয়েছে পুষ্টি, তেমনি ক্যালরিও অনেক কম। ভেগান ডায়েটে শরীর সুস্থ থাকে, সহজে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, আবার পরিবেশেরও ক্ষতি হয় না।
পালেও
শিকার পর্ব যুগে মানুষের খাদ্যতালিকায় ছিল ফল, মাংস আর শাকসবজি। বর্তমানে পুষ্টিবিদেরা এই খাদ্যাভ্যাসের নাম দিয়েছে পালেও বা পালেওলিথিক ডায়েট। একে ‘দ্য কেভম্যান ডায়েট’ বা ‘স্টোন এজ ডায়েট’ও বলে। এটি মূলত হোল ফুড বেসড। এতে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা খুব কম থাকে। ডেইরি প্রোডাক্ট এবং প্রক্রিয়াজাত চিনি বা খাবার, বিন, ডাল, সয়াবিন, সূর্যমুখী কিংবা ভুট্টার তেল এর অংশ নয়। এসবের বদলে এই ডায়েট রেজিমে থাকে নানা রকমের মাংস, মাছ, বাদাম, বীজ, আলু, মিষ্টিআলু, ইয়াম, স্বাস্থ্যকর তেল যেমন জলপাই, নারকেল, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি। ১৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই ডায়েট ফলো করে মাত্র তিন সপ্তাহে তাদের ২ কেজির বেশি ওজন কমেছে। অন্যদিকে এটি শরীরের টক্সিন কমায় ও মেটাবলিজম বাড়ায়। তবে এই ডায়েট ডায়াবেটিক, সন্তানসম্ভবা অথবা যারা সদ্য মা হয়েছেন, তাদের জন্য নয়।
পেগান
পালেও ভেগান ডায়েটের সংমিশ্রণও। এর প্রবক্তা ড. মার্ক হাইম্যান। শরীরের ইনফ্ল্যামেশন কমানো এবং রক্তে চিনির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এই ডায়েট খুব কার্যকর। যদিও এর অনেক উপাদান নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকের জন্যই পুরোপুরি ভেগান হওয়া বা পালেও ডায়েট অনুসরণ করা অসম্ভব। সেদিক দিয়ে পেগান ডায়েট অনেকটাই ভারসাম্যপূর্ণ। এতে শাকসবজি ও ফলের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। তবে ছোট থেকে মাঝারি পরিমাণে মাংস, নির্দিষ্ট মাছ, বাদাম, বীজ এবং কিছু শিম বা ডাল খাওয়া যেতে পারে। ভারী প্রক্রিয়াজাত চিনি, গ্লুটেন অথবা গ্লুটেন ফ্রি গ্রেইন, তেল এবং শস্য খেতে নিরুৎসাহিত করা হয় এই ডায়েটে। অবশ্য কম পরিমাণে, মাসে একবার খেলে সমস্যা নেই। ফল ও শাকসবজির ভিটামিন, ফাইবার আর খনিজ উপাদান ক্ষতিকর রোগ প্রতিরোধ করে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস আর ইনফ্ল্যামেশন কমায়। অন্যদিকে অনেক স্বাস্থ্যকর ও অসম্পৃক্ত চর্বির জন্য হার্টের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মেডিটারেনিয়ান
সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ডায়েট প্ল্যান। হৃদ্্যন্ত্রের সুস্থতার জন্য আদর্শ। ইউএস নিউজ ও ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের র্যাঙ্কিংয়ে এর অবস্থান এখন এক নম্বরে। ষাটের দশকে আমেরিকান পুষ্টিবিদেরা দেখলেন ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো; বিশেষত ইতালি ও গ্রিসের অধিবাসীদের মধ্যে হৃদ্্রোগে মারা যাওয়ার হার আমেরিকা ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম। তখন থেকেই এই অঞ্চলে ডায়েটের প্রতি সবার আগ্রহ বাড়ে। এটি ওজন কমানোর পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। প্রচুর শাকসবজি (বিশেষ করে টমেটো, বেগুন, আলু, ক্যাপসিকাম, জুকিনি, ব্রকলি ইত্যাদি), ফলমূল এবং সামুদ্রিক মাছ, জলপাইয়ের তেল, শস্যবীজ ও নানা রকমের বাদাম এবং ডালজাতীয় উপাদান এই ডায়েটের আসল রসদ। পরিমিতভাবে খাওয়া যাবে পোলট্রি বা লিন মিট (মুরগি, হাঁস, কোয়েল, টার্কি) ডিম, পনির, দই। সামান্য লাল মাংস খাওয়া যেতে পারে, তবে সেটা মাসে এক থেকে দুবারের বেশি নয়। এড়িয়ে যেতে হবে চিনিযুক্ত বেভারেজ, স্ন্যাকস ও অস্বাস্থ্যকর চর্বিসমৃদ্ধ খাবার। এটি একই সঙ্গে সাসটেইনেবল এবং এথিক্যাল ডায়েটও। ভেগান ও ভেজিটারিয়ানের মতো এটিও পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে ভূমিকা রাখে।
ড্যাশ
বিশ্বের এক বিলিয়নের মতো মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদেরা মিলে এটি কমানোর জন্য একটি নতুন ডায়েট প্ল্যান তৈরি করেছেন। ড্যাশ ডায়েট। এর পুরো নাম ডায়েটারি অ্যাপ্রোচেস টু স্টপ হাইপারটেনশন (dietary approaches to stop hypertension- DASH) গবেষণায় দেখা গেছে, সবজি ও পাতাজাতীয় খাবারের ওপর বেশি নির্ভরশীলদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা কম। এই ডায়েটে জোর দেওয়া হয় শাকসবজির ওপর। পাশাপাশি খেতে হবে ফলমূল ও নানা ধরনের মাছ। ফ্যাট, রিফাইন্ড বা অ্যাডেড সুগার ও রেড মিট বাদ দিতে হবে। লবণ এক চামচের বেশি নয়। এতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ওজন কমে। ক্যানসারের ঝুঁকি এড়ানো যায়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এটি মেটাবলিক সিনড্রমের আশঙ্কা ৮১% পর্যন্ত কমায়।
মাইন্ড
এর পূর্ণরূপ মেডিটারেনিয়ান-ড্যাশ ফর নিউরোডিজেনেরেটিভ ডিলে (Mediterranean-DASH for Neurodegenerative Delay-MIND)। বুড়িয়ে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্কের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে এটি কাজ করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, ডায়াবেটিস, হৃদ্্রোগসহ শরীরে জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। সবুজ শাকসবজি, বেরি জাতীয় ফল, জলপাই তেল, ওমেগা ৩ সমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ, বাদাম, ডাল ও বিচিজাতীয় খাবার এই ডায়েটের অপরিহার্য অংশ।
ইন্টারমিটেন্ট ডায়েট
এখনকার জনপ্রিয় ট্রেন্ড। এটি অবশ্য ডায়েট না, খাদ্য গ্রহণের সময়-সংক্রান্ত প্ল্যান বা প্যাটার্ন। সপ্তাহ বা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় না খেয়ে থাকার ডায়েট। কয়েকভাবেই এই ফাস্টিং প্যাটার্ন তৈরি করা যায়। যেমন সন্ধ্যা ছয়টায় রাতের খাবার গ্রহণ এবং পরদিন সকাল নয়টায় সকালের নাশতা। এতে ফাস্টিং বা উপবাস হয় ১৫ ঘণ্টা। সপ্তাহে ২ দিন পানি বা চিনি ছাড়া ফলের রস পান এবং পাঁচ দিন স্বাভাবিক খাবার খাওয়া। এই দুদিন ৫০০-৬০০ ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ। রোজাও ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং। এর ফলে শরীরে অটোফেজি হয়। এতে বাড়তি কোষ ও ক্ষতিকর উপাদান ভাঙতে থাকে। কোষ পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে শরীর ও ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া হ্রাস পায়। অটোফেজি নিয়ে গবেষণা করে ২০১৬ সালে জাপানি সেল বায়োলজিস্ট ইওশনরি ওশুমি চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পান। মূলত তারপর থেকে সবাই এই ডায়েটের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ক্যানসারের কোষ ধ্বংস, টিউমার, অস্টিও আর্থ্রাইটিস, ক্যানডিডার ফোলা স্কিন ডিজিজসহ বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে এতে। ওজন কমানোর জন্য বিশেষভাবে কার্যকর হলেও এই ডায়েট সবার জন্য নয়। ২৫ বছরের কম বয়সী, রক্তস্বল্পতা, উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপের রোগী, গর্ভবতী ও বুকের দুধ পান করানো মায়েদের এই ডায়েট এড়িয়ে যেতে হবে।
এ ছাড়া ডায়েট রয়েছে বডিশেপ অনুযায়ী। অনেক সময় দেখা যায়, একই খাবার খেয়ে কেউ ওজন কমাতে পারেন, কেউ পারেন না। এমনটি হওয়ার কারণ হতে পারে বডিশেপের তারতম্য। মেয়েদের শরীরের গঠন মোটামুটি চার ধরনের। এগুলো হলো আপেল, নাশপাতি বা পিয়ার, আওয়ার গ্লাস, রুলার শেপ। ওজন কমানো এবং শরীরে মেটাবলিজম বাড়ানোর জন্য গঠন অনুযায়ী ডায়েট বাছাই করলে অল্প সময়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
কাঁধ চওড়া, নিতম্ব-বুক ভারী ও হাত-পা চিকন হলো আপেল গঠনের বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের শরীরে মাঝের অংশে ওজন বাড়ার প্রবণতা থাকে। এ ক্ষেত্রে পারফেক্ট ডায়েট হলো অল্প পরিমাণে কয়েকবার খাদ্য গ্রহণ। দিনে ৬ বার খাওয়া যেতে পারে। তালিকায় রাখতে হবে উচ্চ আঁশযুক্ত শাকসবজি, ফল, ভিটামিন সি, লো ফ্যাট ডেইরি। কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার ও ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপির মতো সবজি কম খেতে হবে।
পিয়ার বা নাশপাতি গঠনে কাঁধ, বুক, কোমর চিকন হয় এবং নিতম্ব, ঊরু-পা চওড়া হয়ে থাকে। এ ধরনের শরীরে ওজন বাড়লে নিচের চওড়া অংশে বেশি চর্বি বা পানি জমে। তাই খেতে হবে মাছ, মাংস, ডিম, সামুদ্রিক মাছ, ডেইরি প্রোডাক্ট ও প্ল্যান্ট বেস হাই প্রোটিন খাবার। মেটাবলিজম বাড়ানোর জন্য খাবার তালিকায় যোগ করতে হবে টমেটো ও টমেটোর জুস। টক্সিন দূর করতে তরমুজ ও আনারসের মতো পানিসমৃদ্ধ ফল খেতে হবে। হারবাল টিও চলতে পারে। হাই সোডিয়ামযুক্ত খাবার, রিফাইনড ব্রেড, নুডলস, ভাত খাওয়া যাবে না। খাবারে লবণের পরিমাণ সীমিত রাখতে হবে।
রুলার শেপে শরীরে কোনো খাঁজ-ভাঁজ থাকে না। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সমান। এই গঠনে ওজন খুব একটা বাড়ে না। তবে বেড়ে গেলে বেছে নিতে হবে হেলদি ফ্যাট। যেমন অ্যাভোকাডো, আমন্ড, স্যামন মাছ আর প্ল্যান্ট বেসড প্রোটিন।
আওয়ার গ্লাস বডিশেপ সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত। এই গঠনে কোমর সরু এবং উপরের ও নিচের অংশ সমান চওড়া হয়ে থাকে। উপরে নিচে সমানভাবে ওজন বাড়ে। তাই অবশ্যই উচ্চ চিনিযুক্ত সামগ্রী এড়িয়ে বেছে নিতে হবে লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খাবার। দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার অল্প অল্প করে খেতে হবে। প্রচুর সবজি ও ফলের পাশাপাশি খেতে হবে লিন প্রোটিন। ওজন তাড়াতাড়ি কমাতে চাইলে অবশ্যই খাদ্যতালিকা থেকে মিষ্টিজাতীয় খাবার, ময়দা, শুকনা ফল ও বাদাম বাদ দেওয়া জরুরি।
তবে সব বডিশেপের অধিকারীদের জন্যই আনহেলদি ফ্যাট, কার্বোনেটেড ড্রিঙ্ক, অ্যাডেড সুগার, প্রসেস ফুড, রিফাইনড ফুড থেকে শত যোজন দূরে থাকতে হবে।
ছবি: ইন্টারনেট
nice