ফিচার I শহুরে ও গ্রামীণ বিবাহভোজ
শহর ও গ্রামের মধ্যে আপ্যায়নে পার্থক্য রয়েছে। দিনে দিনে তা অপস্রিয়মাণ। তবে গ্রামের উৎসব যখন শহরের অনুকরণে পাল্টে যাচ্ছে, তখন শহুরেরা ঝুঁকে পড়ছে ভিনদেশি কুজিনের দিকে
অঞ্চলভেদে খাদ্যসংস্কৃতির পার্থক্য থাকে। এটি নির্ভর করে ধর্ম, অর্থনৈতিক অবস্থা ও শস্য উৎপাদনের ওপর, যা প্রভাবিত করে উৎসব-পার্বণকেও। যেমন বিয়ে। গ্রাম্য ও শহুরে বিয়ের ভোজেও এই ফারাক চোখে পড়ে। গ্রামীণ জীবন কৃষিনির্ভর। ফলে কখনো তাদের সংসার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, কখনো অসচ্ছলতা। তাই পারিবারিক কিছু উৎসবের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় ফসল ওঠার সময় মেনে। এর মধ্যে বিয়েশাদিও রয়েছে। গ্রামের মানুষের কাছে নগদ অর্থ অপ্রতুল। তবে শস্য প্রতুল। শহরে ঠিক তার বিপরীত। নাগরিক বিয়ের খাবারের আইটেমে বিদেশি খাদ্যের যত ঘটা, গ্রামে তা নেই। সেখানে খাদ্যসংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উপাদান চাল। তাই বিয়েতে মুড়ি-মুড়কি, খই, পায়েস, ক্ষীর আর পিঠার ছড়াছড়ি। ঢাকায় তা নয়। এ ছাড়া ঢাকার কমিউনিটি সেন্টার, ক্যাটারিং সার্ভিস, কুক-শেফের যত ঘনঘটা, গ্রামে সেসব কই!
গ্রামীণ রন্ধনশৈলীও সাধারণ। সেখানে ফিউশনের পসরা নেই। বিয়ের অতিথির সংখ্যা মোটামুটি ২৫ জনের কম হলে নারীরাই রান্নার কাজ সারেন। বেশি মানুষ নিমন্ত্রিত হলে ডেকে আনা হয় বাবুর্চি। যাদের মুনশিয়ানা ওই পোলাও-কোরমা পর্যন্তই। পানীয়র মধ্যে বড়জোর শরবত। সেই বাবুর্চির সঙ্গে ঘরের নারী-পুরুষেরাও রান্নার কাজে হাত লাগান। শহুরেরা এসব থেকে দূরে থাকেন।
গ্রামে বিয়ের দিন মাটি খুঁড়ে অস্থায়ী উনুন তৈরি হয় উঠানেই। ভাত, মাংস, সবজি, বুট কিংবা মাষকলাইয়ের ডাল, আলু, পটোল কিংবা বেগুন ভাজা; শেষ পাতে দই অথবা মিষ্টি। তারপর মুখশুদ্ধির জন্য পান-সুপারি। এগুলোই গ্রামের বিয়ের খাবার। তবে আয়োজকের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর এসব পদে বৈচিত্র্য থাকে। এই যুগে ধনী-গরিবনির্বিশেষে গ্রামের প্রায় সব পরিবারই বিয়েতে পোলাও মাংস রাখেন। এমনকি বহুজাতিক কোমল পানীয় পরিবেশনের চলও ঢুকেছে।
গ্রামের হিন্দু বাড়ির বিয়েতেও পদের বাহার আছে। বিয়েভোজ শুরুই হয় লুচি, বেগুন ও পটোল ভাজা দিয়ে। তারপর পাতে আসে কুমড়ার কোনো একটি পদ। শীতকাল হলে মেলে বাঁধাকপির ঘণ্ট। তা ছাড়া থাকে আলুর দম, মাছের কালিয়া, চাটনি ও পাঁপড় ভাজা। থাকে সন্দেশ, পায়েস, রসগোল্লা ইত্যাদি।
গ্রামীণ সমাজে অনেক বিয়েতে নারী ও পুরুষের খাবারের জায়গা আলাদা থাকে। বাড়ির কর্তা ঘুরে ঘুরে দেখেন- সবাই তৃপ্তিসহকারে খাচ্ছে কি না, কারও কিছু চাই কি না। তবে এখন গ্রামের বিয়েতে এসব যে পাওয়াই যাবে তা কিন্তু নয়। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে গ্রাম-শহরের বিয়ের খাবারের পার্থক্য অনেকটা ঘুচে গেছে। প্রযুক্তির প্রভাবে গ্রামীণ মানুষের যাপিত জীবনে পড়েছে শহুরে ছাপ। প্রভাবিত করেছে তাদের খাদ্যসংস্কৃতিকেও। তবে কিছু রীতি যেন সদর্পেই টিকে আছে। যেমন বিয়ের আগে ও অনুষ্ঠানের দিন পিঠা তৈরি করা। এ কেবল গ্রামেই মেলে। শহুরেরা পিঠা এড়িয়ে যান। চিনি লেবুর শরবতও যেন গ্রামেরই পানীয়। শহুরেরা সেখানে এনেছে চা-কফি। শহুরে বিয়ের খাবারে স্যালাড বলতে যে মুখরোচক পদটিকে বোঝায়, গ্রামে কিন্তু তা নয়। শসা কিংবা গাজর কেটে কাঁচা মরিচ ও লেবু কচলে নেওয়াটাই এখানকার বিয়ের চল।
গ্রামে খাওয়ার শুরুতেও বোল হাতে খাদেম চলে আসে টেবিলে। হাত ধোয়াতে। খাওয়া শেষেও হাত ধোয়ার বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। সেখানে আয়োজকদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকেন সাবান, মগ ও তোয়ালে নিয়ে। শহরে এই সমাদর ঠিক মেলে না।
এবার আসা যাক শহুরে বিয়ের খাবারে। একটা সময় বাড়ির ছাদে শামিয়ানা টানিয়ে বিয়ের আয়োজন করা হতো। ইটের উপর ইট রেখে চুলা বানিয়ে রান্না হতো পোলাও-মাংস। ডেকোরেটর থেকে ভাড়া করা হতো বাবুর্চিসহ থালা-গ্লাস ও চেয়ার-টেবিল। এখন সেই আয়োজন খুব কমই চোখে পড়ে; বরং সবাই কমিউনিটি সেন্টারমুখী। রান্নার ভার ক্যাটারিং সার্ভিসের উপর দিয়ে থাকেন। শহুরে বিয়ের খাবারে থাকে পোলাও, রোস্ট, মাংসের কালিয়া বা রেজালা, মাছের কোপ্তা, সবজি, মুগ বা বুটের ডাল দিয়ে মুরগির গিলা-কলিজা, স্যালাড, বোরহানি, মিষ্টি, দই, জর্দা বা ফিরনি, আইসক্রিম অথবা কোমল পানীয়। ঝামেলা এড়াতে অনেক বিয়েতে কাচ্চি বিরিয়ানিও খাওয়ানো হয়।
অতিশহুরেদের বিয়েতে বুফের আয়োজন হয়। নেই খাবার পরিবেশক। বাড়ির কর্তাও ঘুরে ঘুরে অতিথির খোঁজখবর নেন না। কাউন্টার তৈরি করে সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয় খাবার। থালা হাতে নিয়ে নিজের পছন্দসই পদ পাতে তুলে কোথাও বসে কিংবা দাঁড়িয়ে বিয়ের খাবার খায় নিমন্ত্রিতরা।
যদিও শহরে এই কেতার খুব বেশি প্রচলন এখনো ঘটেনি। কিন্তু সেদিকেই গড়াচ্ছে বিয়ের খাদ্য পরিবেশনের সংস্কৃতি। তা ছাড়া বছরে বছরে বদলায় বিয়ের খাবারের ট্রেন্ড। ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে চাওয়া লোকেরা সেসবের খোঁজ রাখেন। শহরে শীতকালীন বিয়েতে অভ্যর্থনা জানাতে চা-কফির আয়োজন থাকে। যারা আরও এক কাঠি সরেস, তারা গ্রিন টি, হারবাল টি কিংবা অন্য কোনো বেভারেজ দিয়েও অতিথি আপ্যায়ন করেন। শহুরে বিয়েতে ভাজাভুজির কদরও বাড়ছে। পাকোড়া, কর্ন কিংবা ওয়ান বাইট পিৎজা। শীতের সময় বিয়েতে স্যুপও থাকে। অ্যাপেটাইজার হিসেবে গরম স্যুপ পছন্দ করেন শহুরেরা। সঙ্গে পাস্তা, রায়তা, ভেজিটেবল সঁতে। তবে পোলাও, কোরমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন শহুরেরা। বিরিয়ানিতেও উৎসাহ নেই। চাই স্টিমড রাইস কিংবা জিরা রাইস বা পিস রাইস। যাকে বলে স্বাস্থ্যসচেতনতা। ভাত না হলেও বিয়ে থেমে থাকে না এখানে। নান, রুমালি বা তাওয়া রুটি হলেও চলে। শুধু মাছ-মাংসের তরকারি খাইয়ে অতিথি বিদায় করার বিষয়টা শহুরে বিয়ের খাদ্যসংস্কৃতির সঙ্গে এখন খুব একটা খাপ খাচ্ছে না। চিকেন তন্দুরি, ভেটকি পাতুরি, বেকড ফিশ, বেকড প্রন, মাটন স্টেক রাখলে জমে ভালো। বিদেশি কুজিন থেকে কয়েকটা পদ তুলে আনলে শহুরে বিয়ে যেন আরও বেশি স্মরণীয় হয় অতিথিদের কাছে। ইতালিয়ান, মেক্সিকান, জাপানিজ, থাই, মঙ্গোলিয়ান খাবারগুলো এখন ধীরে ধীরে ঢুকছে শহুরে বাঙালির বিয়ের খাবারে। মিষ্টান্নের ব্যাপারেও নগরবাসী একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। বাঙালির এখন চাই বেকড মিষ্টি। শেষ পাতে দইয়ের যুগ ফুরিয়েছে। জায়গা পেয়েছে আইসক্রিম। তবে শীতকাল হলে ভিন্ন কথা। তখন কেক, হালকা পুডিং, ফ্রুট স্যালাড দিয়েই ঘটে বিয়ের খাবারের সমাপ্তি।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট