স্বাদশেকড় I লাড্ডুবৃত্তান্ত
সুস্বাদু এই খাদ্যের ইতিহাস তার রং আর গুণের মতোই চমকপ্রদ। শুরুতে ছিল নানান রোগের দাওয়াই। কালক্রমে আপ্যায়নের বিশেষ একটি পদ হয়ে ওঠে
মনে করা হয়, এই মিষ্টান্ন অন্তত দুই হাজার বছরের পুরোনো। ঘি, বেসন আর বাদামের তৈরি এই পীতবর্ণের গোলক উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টির একটি। এর জন্ম দক্ষিণ এশিয়ায়।
যিশুর মর্ত্যে আগমনের ৩০০ বছর আগের কথা। মহর্ষি বিশ^ামিত্রের ছেলে বৈদ্য হিসেবে নাম করেছেন। লাইন দিয়ে তার কাছে রোগের নিদান নিতে আসে বেনারসের লোকেরা। বৈদ্যের নাম সুশ্রুত। কেউ আসছে হাড়ের ব্যথা নিয়ে, কেউ হজমের সমস্যা নিয়ে। কারও সামান্য সর্দি-কাশি, কারও রক্তচাপের জটিলতা। অন্যদিকে মায়েরাও এসেছে কিশোরীদের নিয়ে, ঋতুস্রাবজনিত সমস্যা সমাধানে। রোগের ধরন যা-ই হোক, ভারতীয় শল্যবিদের কাছে দাওয়াই একটাই- লাড্ডু। তবে তখন এর নাম ছিল লাড্ডুকা। তিল, গুড় আর বাদাম দেওয়া ছোট ছোট গোলাকার পি-ই ওষুধ। আপাতদৃষ্টে সেটাকে কেবল মিষ্টান্ন বলে ভ্রম হলেও এর ভেতরেই পুরে দেওয়া হতো পাঁচন। যেন তেতো ওষুধ গিলতে সমস্যা না হয়। অনেকটা একালের সুগার কোটেড ট্যাবলেটের মতো। একেক রোগের একেক পাঁচন, তবে উপরের গোলকের উপাদান অভিন্ন। গালগপ্পো মনে হলেও লাড্ডুর শুরু সেখান থেকে। সুশ্রুত সংহিতা তা-ই বলে।
মহাভারতে পাওয়া যায় ভীমের লাড্ডুপ্রীতি। মামা শকুনি আর সৎভাই দুর্যোধনের চক্রান্তে কালকূটের বিষ মেশানো লাড্ডু খেয়েই ভীম যমুনার জলের নিচে নাগলোকে পৌঁছে যায়। পরে দ্রৌপদীকে লাড্ডু বানিয়ে পাঠায় কনিষ্ঠ পান্ডব।
নৈষধচরিতের পাকশাস্ত্রে লাড্ডুকার দেখা মেলে, যেখানে এর অর্থ ‘মিষ্টি স্বাদের গোলক’। মানসোল্লাশা’য় কেশর, উদুম্বারা, বর্ষপালগোলক নামের মিষ্টান্নের উল্লেখ রয়েছে। এগুলো তৈরি হতো ময়দা ও আটা দিয়ে। ক্ষীরপ্রকার নামের মিষ্টি ছিল রসগোল্লার মতোই, তবে তা ছানা নয়, ময়দা বা আটা দিয়ে তৈরি হতো। স্বপ্নবাসবদত্ত মোদককে মিষ্টি গোলক বলে রায় দিয়েছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর ‘ভোজনকুতুহল’ (দ্রব্যগুণাগুণ-কথন) গ্রন্থে লাড্ডুকাকে বলা হয়েছে বদহজমের কারণ। এটি অতিরিক্ত ভোজনে হজমের সমস্যা হতে পারে বলে উল্লেখ রয়েছে।
সুশ্রুত সংহিতার সূত্র টেনে খাদ্য-ইতিহাসের গবেষক মধুলিকা দাস বলেছেন, লাড্ডু খাওয়া হতো মূলত ওষুধ হিসেবে। বিভিন্ন অসুখের প্রতিষেধক আর কিশোরীদের হরমোনজনিত আবেগ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার ছিল এটি। ‘অ্যানথ্রোপলজি অব সুইটমিট’ বইতে লেখক এ কে সিনহা লিখেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে মিষ্টিজাতীয় খাবার প্রস্তুত ও বিতরণ করা হতো ধর্মীয় উৎসবগুলোতে। মূলত প্রাচীন চোলা সাম্রাজ্যে এভাবেই লাড্ডু প্রথমে ধর্মীয়, পরে ঔষধি এবং তারও পরে জনপ্রিয় মিষ্টান্নে পরিণত হয়। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা মতিচূরের আবিষ্কারক। সে প্রসঙ্গে একটু পরে।
দিল্লির সুলতান আর মোগলরা, লাড্ডুর অবস্থানের উন্নতিতে ভূমিকা রাখে। মধুলিকা দাসের মতে, তারা শাহি লাড্ডুর আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন, পারস্য থেকে আনা খেজুর, ডুমুর, অন্যান্য ফল আর সবজির বীজ মিশিয়ে। তিনি বলেন, এখনকার লাড্ডুর বিবর্তনের ঠিক আগের ধাপের এই খাদ্য তিন শ বছরের পুরোনো, যখন থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেরা এতে সাদা চিনির ব্যবহার শুরু করে। ভারতবাসীর কাছে এটি সাদা বিষ নামে পরিচিত হলেও তা লাড্ডুতে দিয়ে খেতে এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। ১৭৯০ সাল থেকে ২২৫ বছর ধরে দিল্লিবাসীকে মতিপাক লাড্ডু আর নুক্তি কি লাড্ডু খাইয়েছে ঘান্টেওয়ালা হালওয়াই, সে ওই চিনির ব্যবহারেই। তবে বাংলার ইতিহাস গড়বড়ে। রমেশচন্দ্র মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায়, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় দেখা যায় মধ্যযুগে বাংলায় চিনির ব্যবহার ছিল। তাই সমগ্র ভারতবর্ষ এক পাশে আর বাংলা অন্য পাশে।
লাড্ডু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দক্ষিণ এশিয়ার পরবের মিষ্টি হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। বিয়ে, দীপাবলি, ঈদ, নবজাতকের আগমন, কাজে বা শিক্ষায় সাফল্য, বিভিন্ন ওরসে, বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মদিনে- কোথায় নেই লাড্ডু। সেই পারস্য থেকে শুরু করে শে^তহস্তীর দেশ পেরিয়ে মালয় দ্বীপপুঞ্জেও এর প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে লাড্ডুর ধরন কমবেশি ৩০০ পদের। আমাদের নাড়ু–, মোয়াও লাড্ডুরই এক পদ, অন্তত সুশ্রুত সংহিতা, বেদ, নৈষধচরিত, মানসোল্লাশা থেকে পাওয়া লাড্ডুর বিবরণ তা-ই বলে। এই ৩০০ পদের লাড্ডুর প্রতিটিরই নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে, লোকাচার আছে, বানানোর আলাদা রীতিও বিদ্যমান। উপকরণের বৈচিত্র্য তো বোঝাই যায় বেসনের লাড্ডু থেকে মোয়া পর্যন্ত এর রকমফের দেখলেই। তবে বাঙালিরা মোদক, নাড়ু, মোয়া থেকে লাড্ডুকে আলাদা জানে, ভিন্ন পদই মানে। ধর্মমঙ্গলের শ্লোকেও তাই লাড্ডু ও মতিচূর আলাদা ব্যাপার। লাড্ডু হবে রঙিন, গোল- মিহিদানা, মতিচূর, মাওয়া, বেসন যা-ই হোক না কেন! যেহেতু নাড়ু, মোয়াকে আমরা লাড্ডু ভাবি না, তাই আমাদের এলাকার সবচেয়ে কাছে-পিঠের লাড্ডু ধরে নেওয়া যায় মতিচূরকে। কারণ, বিষ্ণুপুরেই এর জন্ম, বিকাশ। যা এখন লড়ছে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিটির জন্য।
এতে ব্যবহার করা হয় পিয়ালের ফল। বলা হয় বিষ্ণুপুরের কোনো এক মল্ল রাজা গোপালের ভোগের জন্য ভিন্ন ধরনের প্রসাদ তৈরির নির্দেশ দেন রাজ-ময়রাকে। তখন পিয়াল ফলের বেসন থেকে তৈরি হয় মতিচূর। তবে গোটা বাংলায় আরও কয়েক রকম বেসনের প্রচলন ছিল, তা জানা যায় বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘মিষ্টান্ন পাক’ বইতে। বাংলা ১৩০৫ অর্থাৎ ১৮৯৮ সালের দিকে প্রকাশিত এই বই থেকে কলাই ডালের বেসনের পাশাপাশি বরবটি, ছোলার ডাল, বুট আর পানিফলের বেসন ব্যবহারের কথাও রয়েছে। সেখান থেকেই জানা যায় লাড্ডুতে ব্যবহৃত সফেদা বা সবেদার কথা। তবে এই সফেদা ফল নয়, বিপ্রদাসের ভাষায়, ‘ময়দার ন্যায় চাউল জাঁতায় ভাঙ্গিয়া যে গুঁড়া বা চূর্ণ করা যায়, তাহাকে সফেদা বা সবেদা বলে।’ তিনি পরে বলেছেন, টাটকা ভাঙা কামিনী চালের গুঁড়া সবচেয়ে ভালো। এখান থেকেই এক শ বাইশ বছর আগেকার বাংলায় প্রচলিত লাড্ডুর প্রকারভেদের কথা জানা যায়। মিঠাই- দু রকমের মিহিদানা মিঠাই (একটা অর্ধেক সফেদা আর অর্ধেক বেসন, অন্যটা দশ আনা বেসন, ছয় আনা সফেদা), নিখুঁতি, মতিচূর, বাঁধা দধির মতিচূর, মুগের লাড্ডু, বুটের লাড্ডু, ক্ষীরসাপাতি লাড্ডু, পোলাওদানা মিঠাই আর দরবেশ মিঠাই। প্রায় সব লাড্ডুই বঁদে বা বুন্দিয়া গাঢ় গোছের চিনির রসে ফেলে দুহাতের তালুতে রেখে তৈরি হয়। প্রকারভেদে তাতে ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ পড়ে।
এত এত লাড্ডুর কথার পর ঢাকাই লাড্ডুর বিশেষ একটি পদের নাম না করলেই নয়। হাকিম হাবিবুর রহমানের ভাষ্যে সেটা ঢাকার নারীদের বিশেষ কীর্তি ছিল, পরে হালুইকরদের হাতে বাণিজ্যিক রূপ নেয়- ছানার লাড্ডু। হাকিম সাহেবের ভাষ্যে ‘দশহরার সময় প্রস্তুত লাড্ডুর প্রকার ও বিশুদ্ধতা পূর্ববৎ আছে’। তবে দুর্ভাগ্য, লাড্ডুর প্রকরণের ব্যাখ্যা তিনি করে যাননি।
তামিলনাড়ুর তিরুপতি মন্দিরের কথাও বলতে হয়। প্রতিবছর দশ কোটি লাড্ডু বেচে এই মন্দির। এখানে প্রসাদ হিসেবে চার ধরনের লাড্ডু বিক্রি করা হয়।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট