skip to Main Content

আড্ডা I সৃষ্টিশীল কাজে চাপ নেওয়া যায় না

খৈয়াম শানু সন্ধি, আরাফাত কীর্তি, আরাফাত নিধি এবং রাকাত জামি- চার তরুণের সঙ্গে আড্ডা। সবাই সংগীতের নানান মাধ্যমে যুক্ত ও সফল। সেই সমবেত আলাপে উঠে এসেছে সংগীতে সৃষ্টিশীল অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও অর্জনের গল্প। আয়োজন সঞ্চালনা ও গ্রন্থনায় ফুয়াদ রুহানী খান

ক্যানভাস : শুরুর সময়ের কথা যদি শুনতে চাওয়া হয়?
আরাফাত কীর্তি : রেডিও ফুর্তিতে কাজ দিয়েই আমার শুরু। পরে স্টুডিও ৫৮ গড়ে তুলি। প্রথম দিকে নিধিকে দিয়ে একটা স্টেশন আইডি বানাই, যেটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। এরপরই আমরা আলোচিত হই। তখন বিভিন্ন ধরনের কাজ আসতে থাকে। প্রথমে বাংলালিংক, এয়ারটেলের মতো ক্লায়েন্টের কাজ দিয়ে শুরু। পরে এয়ারটেল দিয়েই আমরা স্পটলাইটে আসি। কাজটি ছিল তাদের টেলিফিল্ম ‘ভালোবাসি তাই’। তারপর জিঙ্গেলের অসংখ্য কাজ করেছি। এটা শুরু হয়েছিল রাজীব আশরাফের দেওয়া একটা বিজ্ঞাপনের কাজের বদৌলতে।
রাকাত জামি : এম্বারস ইন স্নো হচ্ছে আমার সলো প্রজেক্ট। এটার জন্য ২০০৯-১০-এর দিকে লিরিক লেখা শুরু করি। প্রথমে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ছিল। আসলে কীভাবে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাব, এ বিষয়ে কোনো গাইডলাইন ছিল না। মিডিয়ায় আমার পরিচিত মানুষ খুব কম ছিলেন। ইন্টারনেট ঘেঁটেই তখন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হাতেখড়ি, সোবহানবাগে ছোট একটা স্টুডিও দিয়ে কাজ শুরু। পরে লাইভ স্কয়ার নামে একটি কোম্পানিতে লাইভ সাউন্ডে কাজ করি। সেখানেই পরিচয় হয় জন কবীর, জুবায়ের হুসেইন, জোহাদ রেজা চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে। তারপর কয়েক বছরের জন্য কানাডায় চলে যাই লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে। দেশে ফিরে আসার পর জুবায়ের ভাই আমাকে প্রথম ইন্দালোতে সাউন্ডের কাজ করতে বলেন। ২০১৬ ছিল আমার জন্য অনেক ভালো একটা বছর। সে সময় ইন্দালোর সঙ্গে বেশ কিছু শোতেও কাজ করি। এসএ টিভিতে ইন্দালোর সাউন্ডের জন্য বেশ প্রশংসিত হই। এই শোর পর নেমেসিস ব্যান্ডে কাজ করার প্রস্তাব পাই ড্রামার ডিও হকের কাছ থেকে। এরপর বেশ কিছু জিঙ্গেলের কাজও করি।

খৈয়াম শানু সন্ধি

সন্ধি : আমার বাবা ছিলেন মিউজিক কম্পোজার। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করতেন। বাবা বাসায় বসে যে কাজই করতেন, সেসব আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতাম। ছোটবেলায় বিভিন্ন সংগীত প্রতিযোগিতায় ভালো করেছি। এরপর প্রখ্যাত কম্পোজার সমর দাশের একটি সিনেমার গান গাই। সোলস-এর পার্থদার মেরিল বেবি জেল টুথপেস্টের জিঙ্গেলে কণ্ঠ দিই। এতে স্কুলের বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে অনেকের কাছেই নতুনভাবে পরিচিতি পেতে থাকি। গিটার বাজানোর প্রথম দিকে কয়েক বন্ধু মিলে গড়ে তুলি ব্যান্ড মহাকাল। এর পেছনের শক্তি হিসেবে কাজ করে আমার গান লিখতে পারা। ব্যান্ড গড়ে তোলার পরেই আমার গান ‘স্বপ্নচূড়া’ অ্যালবামে জায়গা করে নেয়। এর মধ্য দিয়েই মূলত আমাদের সবাই চিনতে শুরু করে। ২০০৯-১০ সাল থেকে মূলত জিঙ্গেলের কাজ করতে শুরু করি।
ক্যানভাস : প্রথম কাজের চ্যালেঞ্জ কেমন ছিল? সে সময় কারা অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন?
আরাফাত নিধি : আমাদের প্রথম কাজ ছিল বাংলালিংকের। ২০০৯ সালে সম্মানী পাওয়ার অনুভূতি ছিল অন্য রকম আনন্দের। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হলো, তখন নিজেদের স্টুডিও ছিল না। ইকুইপমেন্টও ছিল খুব কম। তাই প্রথম কাজ করতে হয়েছিল সাজ্জাদ ভাইয়ের ড্রিম ডেস্ক স্টুডিওতে। কিন্তু কারেকশনের বেলায় আবারও স্টুডিওতে গিয়ে কাজ করার বিষয়টি সহজ ছিল না। মায়ের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় ২০১০ সালে তাই নিজেদের স্টুডিও গড়ে তুলি।
রাকাত জামি : আমার চালেঞ্জ অনেকটা একই রকম। ইকুইপমেন্ট ছিল না। অনেকটা ধারদেনা করেই সেসব সংগ্রহ করতে হয়। বিজ্ঞাপনের জন্য লেখা, মিউজিক, ব্যাকগ্রাউন্ড সিঙ্ক করার ব্যাপারটা শিখতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে সে সময়ে মায়ের অবদান না বললেই নয়।
সন্ধি : আমার অনুপ্রেরণার কথা বলতে হলে বাবার সঙ্গে বাপ্পা মজুমদারের নামও স্মরণ করব। ছোটবেলা থেকেই একই এলাকায় আমাদের বেড়ে ওঠা। চ্যালেঞ্জটা বাকি সবার মতোই।
ক্যানভাস : ক্লায়েন্ট বা ডিরেক্টরদের সঙ্গে কাজ করার চ্যালেঞ্জ কি ভিন্ন? নিজেদের জন্য গান বা কাজ করার ব্যাপারটা কতখানি আলাদা?
রাকাত জামি : আমি মূলত তিনবার রিভিশনে কাজ শেষ করার চেষ্টা করি। ক্লায়েন্ট ব্রিফ ভালোভাবে নেওয়াটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কাজ শুরুর আগে কনফিউশন দূর করে নিই ক্লায়েন্টের কাছ থেকে।
সন্ধি : আমার কাজের অভিজ্ঞতা হলো, জিঙ্গেল খুব কম সময়ই আমি পরিবর্তন করেছি। কখনো হয়তো রক ঘরনার একটা সাউন্ড পপ করতে হয়েছে। অনেক দিন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার ফলে ক্লায়েন্ট জানে, কোন কাজের জন্য কার কাছে যেতে হবে। আর নিজেদের কাজের ব্যাপারে আসলে তেমন কোনো ডেডলাইন থাকে না বিধায় ইচ্ছেমতো কাজ করার অবকাশটা বেশি। নিজের গান সম্পর্কে বলতে চাই, আমার এ ব্যাপারে একটা ভাইব ফিল করতে হয়, পরবর্তী সময় সেটাই নিজের মাথার ভেতর থেকে লেখা শুরু করি। উদাহরণস্বরূপ, ‘আয় ঘুম আয়’ গানটা যেভাবে করব ভেবেছিলাম, করতে গিয়ে সেটা হয়তো একেবারেই ভিন্ন কিছু হয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম।

আরাফাত কীর্তি

আরাফাত কীর্তি : আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখবেন, বড় মিউজিশিয়ানদের আলাদা একটা সাউন্ড আছে। এখানেও ব্যাপারটা সে রকম। গ্রামীণফোনের জন্য আপনি যেমন মিউজিক করবেন, বাংলালিংক বা এয়ারটেলের জন্য সে রকম সাউন্ড করবেন না। বাকিটা কাজ করতে করতে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বলতে চাই, যখন কোনো নির্দিষ্ট ক্লায়েন্টের জন্য ভয়েস নিতে হয়, তখন ভয়েস আর্টিস্টের টোন গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের গানের বিষয়ে খুব উল্লেখযোগ্য হলো কোথায় থামতে হবে, সেটা জানা। যেমন অনেক গান প্রথম ড্রাফটে যত ভালো ছিল, খুব বেশি এক্সপেরিমেন্টের জন্য সেটা আর তেমন থাকেনি, এমনও হতে পারে।
আরাফাত নিধি : ক্লায়েন্টের কাজ হচ্ছে পেইড জবের মতো। নির্দেশনা অনুযায়ী আপনাকে কাজ করতে হবে। আর নিজের গানের জন্য মোমেন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। সৃষ্টিশীল কাজ কোনো চাপ নিয়ে করতে পারবেন না। বিশেষ মুহূর্তে সবকিছু ক্লিক করলে একটি সুন্দর কম্পোজিশন বের হয়ে আসে। এমনকি অনেক গান অ্যালবাম বের হওয়ার বেশ পরে হিট হয়েছে। যেমন অর্ণবের ‘চাই না ভাবিস’ অ্যালবামের কথাই ধরুন।
ক্যানভাস : গান কম্পোজিশনের নির্দিষ্ট কোনো ফর্মুলা আছে?
আরাফাত নিধি : এর বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই। আমার ক্ষেত্রে যেমন আগে টিউন আসে, লিরিক নয়। সময়, জায়গা, পরিস্থিতি- সবই গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য।
রাকাত জামি : এম্বারস ইন স্নো-এর ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা কাজ করে সেটা হলো, আমি জানি কী ধরনের গান শুনেছি এবং আমি কী বানাতে পারব। এরপর হয়তো লিরিক লিখি। এম্বারস ইন স্নো-এর সব লিরিক আমার ব্যক্তিগত কোনো না কোনো অভিজ্ঞতা থেকে লেখা এবং কম্পোজ করা। যেমন ডাউনটাউন গানটি কানাডিয়ান ডাউনটাউনে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। তবে গানটি পরে বাসায় বসে সেই মুহূর্তের ইমাজিনেশন থেকে করা।
সন্ধি : আরেকটা ব্যাপার বলতে চাই, একই প্রেক্ষাপটে আমরা চারজন যদি গান বানাই, তবে চারটা ভিন্নধর্মী গান হবে। শব্দচয়ন থেকে টিউন- সবই। কারণ, আমাদের থিঙ্কিং প্রসেস ভিন্ন।
ক্যানভাস : ভালো কম্পোজার হতে ভার্সেটাইল লিসেনার হতে হবে- এই ধারণার সঙ্গে কি আপনারা একমত? মিউজিশিয়ান হিসেবে আপনাদের অনুপ্রেরণা কারা?

আরাফাত নিধি

আরাফাত নিধি : একদম ঠিক। আমার মিউজিক শুরু মেটাল ব্যান্ড দিয়ে। আমি শুধু এক গান শুনি, বাকিগুলো শুনি না। মানে আমি নিজেকে ব্রাকেটবন্দি করে ফেলছি। ধরুন, আমি যখন কিউবান মিউজিক শুনি, তখন দেখি পারকাশন স্ট্রাকচার কীভাবে করে। লাতিন মিউজিক শুনে দেখি, গিটার প্রগ্রেশন কী বা কেমন। অনুপ্রেরণা ছিলেন অর্ণব, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, এ আর রহমান, ঈগলস, জন মেয়ার প্রমুখ।
আরাফাত কীর্তি : নিধি সব সময় বলে, ওর কোনো জনরা নেই। অনেক ধরনের গান শুনলে আপনি আলাদা কিছু সৃষ্টি করতে পারবেন। বাংলা ব্যান্ড, কিংবা পবন দাস বাউল একদম ভিন্নভাবে আমাদের সামনে ফোক গান উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রসংগীত তেমনি একটু আলাদাভাবে কম্পোজ করে এই জেনারেশনের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন অর্ণব। অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছি অর্ণব, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, এ আর রহমান, ঈগলস, জন মেয়ার, জেসন মিরাজ, পিঙ্ক ফ্লয়েডকে। তবে আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, বাংলাদেশে রকস্টার থাকলে তিনি কে- আমি বলব জেমস।
সন্ধি : এ ব্যাপারে বলতে চাই, ২০১৩-১৪ সালের দিকে আমি টেকনিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভুগেছি। গান শুনতে গিয়ে হয়তো টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে এত মাথা ঘামিয়েছি, দিন শেষে মিউজিক উপভোগ করতে পারছিলাম না। আমার অনুপ্রেরণা অর্ণব, এ আর রহমান, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, ডায়ার স্ট্রেইটস, মেটালিকা, ড্রিম থিয়েটার।

রাকাত জামি

রাকাত জামি : বাংলা ব্যান্ডের অ্যালবামে একটা ভার্সেটাইল সাউন্ড ছিল। এই অ্যালবামে আপনি ডার্ক, ফাঙ্ক, রোমান্টিক- সব ধরনের ব্যাপার পাবেন। আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি অর্ণব, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, এ আর রহমান, ঈগলস, জন মেয়ারের কাছ থেকে।
ক্যানভাস : শ্রোতাদের শেখানোর দায়িত্ব কি মিউজিশিয়ান বা কম্পোজারদের? মিউজিককে ইউনিভার্সাল ল্যাঙ্গুয়েজ বলা হয়। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?

রাকাত জামি : শ্রোতাদের শেখানোর কিছু নেই। একই গান একেকজন একেকভাবে রিসিভ করবেন।
আরাফাত কীর্তি : নারকোস-এর গান অথবা মানি হাইস্ট-এর বেলা চাও অনেকেই গাইছে। সবাই গানটা ফিল করতে পারছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যানভাস : ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আসায় কি সবার সুবিধা হয়েছে?
আরাফাত কীর্তি : এখন সবার কাছে অনেক ডেটা আছে। এখানে মানুষের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।
সন্ধি : লিসেনাররা বাসায় বসে গান শুনতে পারছেন। তাদেরকে এখন আর বাইরে থেকে সিডি কিনে নিয়ে আসতে হচ্ছে না। সব সুবিধাই ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো।
ক্যানভাস : এখন কী নিয়ে আছেন? আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনাই-বা কী?
সন্ধি : আমি পাঁচটি ফোক গান কম্পোজ করেছি। ম্যাজিক বাউলিয়ানার টপ ফাইভ উইনার আর্টিস্ট, তাদের সঙ্গে পাঁচজন স্টারকে মিলিয়ে। তারা হলেন চঞ্চল চৌধুরী, মেহের আফরোজ শাওন, তারিন আহমেদ, ফজলুর রহমান বাবু ও কুসুম শিকদার। ‘জানোয়ার’ ওয়েব সিরিজের কাজ শেষ করেছি। আশফাক নিপুণের ওয়েব সিরিজের জন্য কাজ করলাম। যেটা জি-ফাইভে আসবে।

ফুয়াদ রুহানী খান

রাকাত জামি : আপকামিং সব কাজই বিভিন্ন আর্টিস্টকে নিয়ে। অ্যাটিক ব্যান্ডের অ্যালবাম আসছে সামনে। ওটার কাজ শেষ করেছি। একজন স্পেশাল আর্টিস্টের সঙ্গে কাজ করব, যার নাম এখনই বলতে চাচ্ছি না। জিঙ্গেলের ক্ষেত্রে অ্যাপলবক্সের সঙ্গে আইপিডিএলসির জন্য একটা কাজ করতে যাচ্ছি। এ ছাড়া আমার ব্যান্ড এম্বারস ইন স্নোর তিনটি গান আছে, যেগুলো টিউনআপের কাজ করছি।
আরাফাত কীর্তি : সামনের বছর আমরা চারটি গান রিলিজের প্ল্যান করছি। সিরিজ বেজড, কনসেপচুয়াল কাজ, যেগুলোর মিউজিক ভিডিও থাকবে। ওয়েব সিরিজের কাজ আছে কিছু। ডিরেক্টর রায়হান রাফির সিনেমার কাজ করছি। যেটা জানুয়ারি থেকে শুরু করব।
ছবি: মিঠু মোহাম্মদ
কৃতজ্ঞতা: উনান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top