ফিচার I খাদ্যের জন্য গান
শস্য ফলাতে ভূমি, বীজ ও শ্রমের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এখনো এমনটি ভাবা হয় কোথাও কোথাও। মূলত খাদ্যের আকাক্সক্ষা থেকেই শস্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গান। জানাচ্ছেন শিবলী আহমেদ
ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের একাদশ খন্ডে রহস্যময় একটি ঘটনার বর্ণনা আছে। গান নিয়ে। একদল কুকুর ক্ষুধা নিবারণের জন্য একটি শ্বেত কুকুরের কাছে এসে ‘গান’ প্রার্থনা করে। বলে:
‘ভগবান আমাদের অন্নের জন্য গান করুন, আমরা ভোজন করতে চাই’।
ক্ষুধা নিবারণে খাদ্যের বদলে গান চেয়ে নেওয়াই এই বর্ণনার মূল রহস্য। ঘটনাটি ছান্দোগ্য উপনিষদের একাদশ খন্ডে শুরু, সেখানেই শেষ। বিদগ্ধ মহল বিষয়টি নিয়ে বেশ কৌতূহলী। খাদ্য প্রত্যাশায় গান চাওয়ার হেতু কী? এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ও তার ‘লোকায়ত দর্শন’ বইতে এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। তাতে খাদ্যোৎপাদনে গানের সম্পৃক্ততার বয়ান রয়েছে।
ঘটনার বর্ণনায় গানপ্রার্থী যেসব ক্ষুধার্ত কুকুরের কথা বলা হয়েছে, তারা মূলত একদল মানুষ। ‘কুকুর’ টোটেমের লোক বলে তাদেরকে সরাসরি কুকুর সম্বোধন করা হয়েছে। শ্বেত কুকুর বলতে বোঝানো হচ্ছে সাদা চুলবিশিষ্ট বয়স্ক কাউকে। আদিমকালে জন্তু-জানোয়ারের নাম থেকে নিজেদের গোষ্ঠীর নামকরণের প্রথা ছিল। বিশ্বাস করা হতো, কোনো এক জন্তু কিংবা গাছ থেকেই একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সৃষ্টি। তারা ওই জন্তু বা গাছেরই উত্তরসূরি। কুকুর টোটেমের সবার বিশ্বাস, ওই প্রাণীটি থেকেই তাদের উদ্ভব। ছান্দোগ্য উপনিষদের কুকুর দল মূলত ‘শুনক’ তথা কুকুর টোটেমের মানবগোষ্ঠী। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনও সেটিকে মানুষের দল বলেই দাবি করেছেন। তিনি তাদের পুরোহিত বলেছেন। উল্লিখিত ঘটনার বিষয়ে তার মত, ‘পুরোহিতদের মিছিলকে তারা (রচয়িতারা) একদল কুকুরের মিছিলের মতো বর্ণনা করেছেন।’
ছান্দোগ্য উপনিষদের বর্ণনায় জানা যায়, কুকুর নামধারী মানব দলটি বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে গান চেয়েছে। বলেছে, ‘অন্নং নো ভগবানাগায়ত্বশনায়াম্।’ মানে, ক্ষুধা পেয়েছে, অন্ন চাই, অতএব একটা গান দাও।
ক্ষুধা নিবারণের জন্য চাই খাবার। সেই জোগান নিশ্চিত করতে প্রয়োজন শস্য ফলানো। মূলত খাদ্যোৎপাদনের স্বার্থেই ওই কুকুরের দল গান চেয়ে নিয়েছিল। গান কীভাবে শস্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখত, তা বুঝতে প্রাচীনকালের কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে টিকে থাকা কিছু আদিবাসীর চাষকর্ম থেকে অতীতের শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিষয়ে আঁচ করা যেতে পারে। যেমন নিউজিল্যান্ডের মাউরি জাতি। এই গোষ্ঠীর মেয়েরা এখনো ফসলি জমিতে গিয়ে গান গায়। সমবেত কণ্ঠে প্রার্থনা করে, ‘ফসল যেন ভালো হয়… ফলন যেন বেশি হয়…।’ তবে এভাবে গান গেয়ে হাত-পা ছেড়ে বসে থাকলে জমি ফসলে ভরে ওঠে না। শস্যখেতে অবশ্যই শ্রম দিতে হয়। তবে কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে গান করা একেবারে বৃথা যায় না। তা চাষিদের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেহেতু গান গেয়ে ফসলের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে, তাই শ্রম বৃথা যাওয়ার আশঙ্কা নেই- এই বিশ্বাস নিয়ে কৃষকেরা মাঠে নামেন। ফলে দলগত কাজ, স্পৃহা ও আশা- সব মিলিয়ে চাষবাসটা জম্পেশ হয়। ধারণা করা হয়, একই উদ্দেশ্যে ছান্দোগ্য উপনিষদের সেই কুকুর দল ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবারের বদলে গান প্রার্থনা করেছে, যা খাদ্যোৎপাদনে সহায়ক। তারা এমন গান প্রার্থনা করেছিল যেটির সঙ্গে কৃষির যোগ আছে। তা হলো ‘সামগান’। বেদের যেসব ঋক, মন্ত্র বা মন্ত্রাংশ সুর দিয়ে গাইতে হয়, সেগুলোকে ‘সাম’ বলে। এই গানে পাঁচটি স্তর থাকে: হিংকার, প্রস্তাব, উদ্গীথ, প্রতিহার ও নিধন। এই পঞ্চের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সংযোগ আছে। বারিবর্ষণ যে কৃষিকাজের জন্য জরুরি, তা তো সবার জানা। সামগান বিষয়ে ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত আছে:
‘বৃষ্টিতে পঞ্চবিধ সামকে উপাসনা করিবে: বৃষ্টির পূর্বে যে বায়ু উত্থিত হয় তাহাই হিংকার; মেঘ উৎপন্ন হয়, তাহাই প্রস্তাব; বৃষ্টি পাতিত হয়, তাহাই উদ্গীথ; বিদ্যুৎ চমকায়, গর্জন করে, তাহাই প্রতিহার; বৃষ্টি শেষ হয়, তাহাই নিধন। যিনি ইহাকে এই রূপ জানিয়া বৃষ্টিতে পঞ্চপ্রকার সামের উপাসনা করেন, তাহার জন্য মেঘ বর্ষণ করে এবং তিনি বর্ষণ করাইতে পারেন।’
এর মানে, চাষবাসের জন্য প্রয়োজনীয় পানি মিলবে সামগানের মাধ্যমেই। খাদ্যোৎপাদনের জন্য এ গানের প্রয়োজনীয়তা কত বিপুল ছিল, সেটির প্রমাণ মেলে ওই ছান্দোগ্য উপনিষদেই। এতে বর্ণিত হয়েছে :
‘অন্নবানন্নাদো ভবতি ষ এতাস্যেবং বিদ্বানুদ্গীথাক্ষরাণ্যুপাস্ত’।
অর্থাৎ, যিনি এই প্রকার জেনে উদ্গীথের অক্ষরসমূহ উপাসনা করেন, তিনি অন্নবান ও অন্নভোক্তা হন। মানে, সামগানের ‘উদ্গীথ’ উপাসনা করলে খাদ্য লাভ হয়। এসব তথ্যাদিই বলছে যে, শস্য উৎপাদনের জন্য প্রাচীন মানুষের গান গাওয়ার প্রয়োজন হতো।
গান গেয়ে খাদ্য লাভের বিষয়ে বৈদিক দেবতাদেরও স্বীকৃতি আছে। যেমন বৃহদারণ্যকে পাওয়া যায়:
‘সেই দেবগণ বলিলেন, এ পর্যন্ত এই যে অন্ন সেই অন্নকে নিজের জন্য গান করিয়া লাভ করিয়াছ। এখন (পশ্চাৎ) আমাদের সেই অন্নে অংশী করো।’
এর মানে, গান গেয়ে যে অন্ন লাভ হয়েছে, দেবতারা সেটির ভাগ চাইছেন। ছান্দোগ্যের ঘটনা ও বৃহদারণ্যকের শ্লোক বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায়, প্রাচীনকালে শস্য উৎপাদনের সঙ্গে গানের সরাসরি যোগ ছিল। এখানে প্রশ্ন ওঠে- কেন এই সংযোগের দরকার?
শিকার-সংগ্রাহক থেকে মানুষ কৃষিজীবী হওয়ার ফলে খাদ্যভান্ডার সমৃদ্ধ হলেও শস্য উৎপাদন ছিল অনিশ্চিত। রোপিত বীজ থেকে আদৌ চারা গজাবে কি না, গজালেও তা লকলকিয়ে উঠবে কি না, বাড়লেও তা থেকে আশানুরূপ শস্য মিলবে কি না, মিললেও তা ঝড়ে-বন্যায় ভেসে যাবে কি না- এসব অনিশ্চয়তা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। ফলে শস্য উৎপাদকদের দরকার ছিল একটি অতিপ্রাকৃত শক্তির দ্বারস্থ হওয়া। যার মাধ্যমে এসব অনিশ্চয়তা থেকে চাষিদের ফসল রেহাই পাবে। সেই শক্তির আরাধনার উদ্দেশ্যেই রচিত হতো প্রার্থনামূলক গান। বীজ বপন থেকে শুরু করে শস্য ঘরে তোলা পর্যন্ত সেসব গেয়ে দেবতাদের তুষ্ট করা হতো। ফসলের নিশ্চয়তার জন্যই শস্য উৎপাদনে গান গাওয়া জরুরি ছিল। তা ছাড়া আদিম সমমর্মী ও সঞ্চারণী জাদুবিশ্বাসও ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছিল। সেখানে প্রতিস্থাপিত হচ্ছিল অতিপ্রাকৃত শক্তি। মানে অদৃশ্য কিন্তু পরম শক্তিধর কোনো সত্তার সন্তুষ্টি অর্জনই তখন খাদ্যনিরাপত্তার প্রধান একটি উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শস্য উৎপাদনে দেবতার কৃপালাভের প্রত্যাশায় যেসব কলা-কসরতের আয়োজন হতো, গান গাওয়া সেগুলোর মধ্যে অন্যতম পদ্ধতি ছিল।
লোকায়তিক রীতির ওপর যুগে যুগে ধর্ম কিংবা বিভিন্ন দর্শনের প্রভাব পড়েছে। তা লোকায়ত সংস্কৃতির ওপর আস্তর ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু রীতিনীতির অন্তরপিন্ডটি থেকেছে অপরিবর্তিত। তাই আদিম ও প্রাচীন সংস্কারগুলো মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে সুপ্তভাবে। অনুকূল পরিবেশে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই এখনো ধান কাটার সময় কৃষকের কণ্ঠে নিঃসৃত হয় গান। কখনো তা সমবেত; যা শস্যকাটায় একধরনের ছান্দিক গতি আনে। তা ছাড়া শস্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির আশায় এখনো গ্রামে-গঞ্জে গাওয়া হয় বৃষ্টি নামানোর গান। বর্তমানে খাদ্যোৎপাদনের সঙ্গে গানের সংযোগের বাস্তব উদাহরণ হতে পারে রংপুরের রাজবংশী কৃষকদের ‘হুদমা গান’। শস্য উৎপাদনের প্রত্যাশায় এই জনগোষ্ঠীর কিষানিরা রাতে নগ্নাবস্থায় জমিতে গিয়ে হুদমা গায়। এভাবেই কিছু স্থানে খাদ্যোৎপাদনের সঙ্গে গানের সম্পর্ক আজও অমলিন হয়ে আছে; যদিও সেই রীতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
ছবি: ইন্টারনেট