স্বাদশেকড় I কুক্কুটকাহন
বাড়ির ডাইনিং থেকে পিকনিক- পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র চিকেনের স্বাদ উপস্থিতি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো লাল ঝুঁটির পালকওয়ালা পাখিটা কী করে হয়ে উঠল মানুষের খাদ্যতালিকায় প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস? ভাজা মুরগি বিক্রি করে গড়ে উঠল এক খাদ্যসাম্রাজ্য? সেই গল্পই বলছেন সামীউর রহমান
‘ডিম আগে না মুরগি আগে?’ ‘স্যার, আপনি যেটা আগে অর্ডার করবেন।’ বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিরহস্যকে এভাবে এক নিমেষেই সমাধান করে দেওয়ার বাকপটুত্ব কেবল রেস্টুরেন্টের ওয়েটারেরই আছে! তবে বাণিজ্যিক উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় আগে এসেছে ডিম। মাংসের জন্য মুরগির খুব একটা সুখ্যাতি ছিল না। কিন্তু দুটি ঘটনা বদলে দিল সবকিছু!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানুষের জীবনধারা পাল্টে দিয়েছিল, গরু ও শূকরের মাংসের স্বল্পতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে চালু হয়েছিল মাংসের বিক্রির ওপর কড়াকড়ি। ডিমের একঘেয়ে স্বাদ আর ডিম দেওয়া মুরগির শক্ত কটকটে মাংসের জন্য সেসবও খাওয়ার উপায় নেই। একটা চেইন সুপার মার্কেটের পোলট্রিবিষয়ক গবেষক হাওয়ার্ড সি পিয়ার্স ব্যাপারটা নিয়ে বেশ ভাবনাচিন্তা করছিলেন। তার কাছে মনে হচ্ছিল, মুরগির বুকের মাংসটাই যদি টার্কির মতো রসাল আর বড়সড় হয়, তাহলে কেমন হয়! তাই মার্কিন কৃষি বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে এ অ্যান্ড পি (দ্য গ্রেট আটলান্টিক অ্যান্ড প্যাসিফিক টি কো¤পানি) শুরু করল নতুন জাতের মুরগি উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা ‘চিকেন অব টুমরো’। আয়োজনটা বিশাল সাড়া ফেলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা বাদে সব প্রদেশে, কৃষি খামার ও বিজ্ঞানীরা মিলে চেষ্টা করতে লাগলেন নতুন জাতের মাংসল মুরগির জাত উদ্ভাবনের জন্য। অনেকগুলো ধাপে প্রতিযোগিতা চলল। যাচাই-বাছাই, নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৯৪৮ সালের ২৪ জুন এলো ঘোষণা। তাতে বিজয়ী হয়েছিলেন চার্লস ভ্যানট্রেস নামের এক মুরগি খামারি। নিউ হ্যাম্পশায়ার আর ক্যালিফোর্নিয়া কর্নিশ জাতের সংকর করে উদ্ভাবন করা সেই মুরগির জাতের পরবর্তী বংশধরেরাই আজ আমার-আপনার পাতে চিকেন ফ্রাই আর তন্দুরি চিকেন হয়ে স্বাদ বর্ধন করছে। এই ভ্যানট্রেস সাহেবকে বাজারের সামান্য মুরগিওয়ালা মনে করবেন না আবার, তার কোম্পানি কব-ভ্যানট্রেস এখনো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী সংস্থা, যার আয় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। চিকেন অব টুমরোর আয়োজকেরা চেয়েছিলেন এমন মাংসল মুরগির জাত উদ্ভাবন করতে, যেটার বুকের মাংস স্টেকের মতো পুরু করে কাটা যাবে আর মুরগির রানের হাড়টা হবে সরু কিন্তু ঢাকা থাকবে রসাল মাংসের পুরু স্তরে; যেটা খেলে মন ও পেট- দুই-ই ভরবে! ভ্যানট্রেস সেদিন তার উদ্ভাবিত মুরগির জাতে সেই চাহিদার সবটা মেটাতে পেরেছিলেন, তাই আজও চিকেন ব্রেস্ট আর ড্রামস্টিক সমানে খাওয়া হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
কাছাকাছি সময়ে মার্কিন মুল্লুকে আরও কয়েকটা ব্যাপার ঘটল। লুইভিল কেন্টাকির এক পিতৃহীন ছেলে হারল্যান্ড স্যান্ডার্সকে বাসায় রেখে মা যেতেন কাজে। সাত বছরের স্যান্ডার্স যেন ছোট ভাইবোনদের খাওয়াতে পারে, সে জন্য মা ছেলেকে রান্না করাটা শিখিয়েছিলেন। ১৩ বছর বয়স হতেই ঘর পালাল স্যান্ডার্স, এদিক-ওদিক ঘুরে নানান মানুষের সঙ্গে মিশে ১৯৩০ সালে রেলশ্রমিক, বিমার দালালিসহ নানান কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে স্যান্ডার্স ফিরল নিজের শহরে। পুরোনো একটা পেট্রলপা¤প কিনে সেটার গুদামঘরে ডাইনিং টেবিল পেতে শুরু করল খাবার বিক্রি। মূলত স্যান্ডার্স বিক্রি করত স্টেক আর মাংসের কিমা। খদ্দের বাড়তে লাগল, জায়গাও বাড়াল কিন্তু সময় তো আর ২৪ ঘণ্টার বেশি বাড়ানো যায় না! মুরগি ভেজে দিতে লাগে আধঘণ্টার মতো, অতক্ষণ অনেক খদ্দেরেরই ধৈর্য নেই। বিশেষ করে রেস্তোরাঁটা যখন হাইওয়ের ধারে, মোটরগাড়ি করে আসা খদ্দেরই বেশি। তাদের আবার গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া। এ রকম সময়ে বাণিজ্যিকভাবে প্রেশারকুকার উৎপাদন শুরু হলো। প্রেশারকুকার কিনে সেটাকেই নিজের মতো করে একটু অদলবদল করে স্যান্ডার্স বানিয়ে নিল ‘প্রেশার ফ্রায়ার’। চটজলদি গরম গরম মুরগির মাংস ভাজা, বাইরেরটা মচমচে আর ভেতরে নরম রসাল মাংস। এভাবেই জন্ম নিল ‘কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন’, সংক্ষেপে কেএফসি।
কেএফসির ব্যবসা ডানা মেলতে শুরু করল ১৯৫৭ সালে, যখন কর্নেল স্যান্ডার্স তার ‘গোপন রেসিপি’তে বানানো মুচমুচে মুরগি ভাজা বিক্রির ফ্র্যাঞ্চাইজি দিতে শুরু করলেন। শুরুতে স্যান্ডার্সের ১১টি মসলার গোপন রেসিপির জন্য প্রতি এক টুকরা মুরগিতে স্যান্ডার্সকে দিতে হতো ৪ সেন্ট, পরে সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৫ সেন্ট। এভাবে গোটা আমেরিকা ঘুরে নানান রেস্টুরেন্টে স্যান্ডার্স বিক্রি করতে লাগলেন কেএফসির ফ্র্যাঞ্চাইজি, ১০ বছরের কম সময়ে ৬০০টির বেশি রেস্টুরেন্ট নিয়ে কেএফসি হয়ে উঠল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় খাবারের দোকানের চেইন! ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চালানো একটা জরিপে জানা গেছে, বিশ্বের ১৩৬টা দেশের ২২ হাজার ৬২১টা দোকান নিয়ে কেএফসি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রেস্টুরেন্ট চেইন। আর কর্নেল স্যান্ডার্স মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও বিশ্বের অন্যতম বড় ব্র্যান্ড আইকন হয়ে হাসিমুখে শোভা পাচ্ছেন প্রতিটি কেএফসি আউটলেটে। কেএফসিকে অনুকরণ করে গড়ে উঠেছে আরও অনেক মুরগি ভাজার দোকান। বিশে^র যে তল্লাটেই যাওয়া হোক না কেন, ফ্রায়েড চিকেন ঠিকই জুটে যাবে নিঃসন্দেহে!
মুরগির মাংস ভাজা বিক্রির এই অভিনব কৌশল গোটা মার্কিন মুলুকে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন নিউইয়র্কে এক সন্ধ্যায় টেরেসা ও ফ্র্যাঙ্ক দম্পতি হঠাৎ মুখোমুখি হয়েছিলেন অদ্ভুত এক সমস্যার। সময়টা ১৯৬৪, নিউইয়র্কের বাফেলো শহরে ‘অ্যাঙ্কর’ নামে একটা পানশালা আছে তাদের। একদিন বেশ রাত করে তাদের ছেলে ডমিনিক তার কলেজের বেশ কিছু বন্ধুকে নিয়ে এল সেখানে। টেরেসা তো বিপদে; কারণ, ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। হঠাৎই চোখ গেল স্যুপের চিকেন স্টক তৈরিতে ব্যবহার করার জন্য রেখে দেওয়া একগাদা মুরগির পাখনার দিকে। সেগুলোকেই কড়া করে ডুবো তেলে ভেজে লাল মরিচের সস মাখিয়ে পরিবেশন করেছিলেন টেরেসা। জš§ হয় বাফেলো উইংস নামের এই খাবারের। এটি এতই জনপ্রিয়তা পায় যে বাফেলো শহর কর্তৃপক্ষ ফ্র্যাঙ্ককে ডেকে সম্মাননা দেয় এবং ২৯ জুলাইকে চিকেন উইংস ডে ঘোষণা করে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাজুড়ে এই বাফেলো উইংস পানশালাগুলোর সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। নানান রাজ্যে বাফেলো উইংস কে কত বেশি খেতে পারে, এসবের প্রতিযোগিতা হয়। সব মিলিয়ে বাফেলো উইংস খাওয়াটা হয়ে উঠেছে মার্কিন সংস্কৃতির একটা অংশ।
নান্দোসের পেরি পেরি চিকেনের রসনার সঙ্গে রাজধানীবাসীর পরিচয় দীর্ঘদিনের। সেই ২০০৭ সাল থেকে। নেপথ্যের গল্পটা হয়তো অনেকেরই অজানা। নান্দোস দক্ষিণ আফ্রিকান একটি কোম্পানি, প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করছে পর্তুগিজ ঘরানায় রান্না করা মুরগি, তবে গল্পটা এখানেই শেষ নয়। ১৯৮৭ সালে, জোহানেসবার্গে ঘুরতে আসা দুই পর্যটক- পর্তুগালে জম্ম নেওয়া ফের্নান্দো দুয়ার্তে আর রবার্ট ব্রোজিন খেতে গিয়েছিলেন একটা পর্তুগিজ রেস্তোরাঁয়। পেরি পেরি সস মাখানো মুরগি খেয়ে তারা এতটাই মুগ্ধ হন যে ৮০ হাজার র্যান্ডে কিনে নেন রেস্তোরাঁটাই! এই পেরি পেরি বা সোয়াহিলি ভাষায় পিরি পিরি হচ্ছে একধরনের মরিচ। মোজাম্বিক একসময় ছিল পর্তুগিজ উপনিবেশ (ইউসেবিও জন্মেছিলেন মোজাম্বিকে), সেই সুবাদে পর্তুগালেও মোজাম্বিক থেকে যাওয়া অনেক মানুষ বসবাস করত। তাদের হাতেই তৈরি হয় এই লাল মরিচের সস। আফ্রিকা থেকে ইউরোপ, সেখান থেকে আবার আফ্রিকায় ফেরত আসে এই পেরি পেরি সস, ফার্নান্দো নিজের প্রথম ছেলের নামে চালু করা রেস্টুরেন্টে বিক্রি শুরু করেন এই সস মাখানো পেরি পেরি চিকেন; যা এখন বিশ্বের অন্যতম বড় রেস্টুরেন্ট চেইন। নান্দোসের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের ৩৫টি দেশের এক হাজারের বেশি আউটলেটে।
মুরগির আরেকটি পদ ‘জার্ক চিকেন’-এর সঙ্গেও জুড়ে আছে ঔপনিবেশিকতার নিষ্ঠুর ইতিহাস। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমল থেকে জ্যামাইকায় শুরু হয় স্প্যানিশ শাসন। স্প্যানিশদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা অনেক রোগব্যাধিতে মারা যায় স্থানীয়রা। তখন তারা দাসদের ধরে আনে আফ্রিকা থেকে। ১৬৫৫ সালে ব্রিটেন দ্বীপটি দখল করে নিলেও দাসদের ভাগ্যবদল হয়নি। বরং আখখেতে শ্রম দেওয়ার জন্য আরও শ্রমিককে ধরে আনা হতে লাগল। এই পালিয়ে যাওয়া দাসরাই দ্বীপের গহিন অংশে গিয়ে কিছু বেঁচে লুকিয়ে থাকা আদিবাসীদের সঙ্গে থাকত। তাদের সংস্পর্শে এসেই প্রাকৃতিক উপকরণ আর আগুনের ধোঁয়ায় সেঁকা মাংস রান্নার পদ্ধতিই পরিচিতি পেয়েছে ‘জার্ক’ নামে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ যেসব জায়গায় ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বাসিন্দারা থাকার বন্দোবস্ত নিয়েছেন, সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন এই ‘জার্ক চিকেন’-এর রেসিপি; যা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে অন্য জাতিসত্তার মানুষজনের মাঝেও।
চীনা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে মেনুতে হরহামেশাই চোখে পড়ে মুরগির দুটো পদ, কুং পাও চিকেন আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান। খেতেও সুস্বাদু দুটো পদের পেছনের ইতিহাসটাও মজার! কুং পাও বা গং বাও আসলে একটা উপাধি, যার অর্থ হচ্ছে দুর্গ অধিপতি। ধারণা করা হয়, চিং রাজবংশের সময় সিচুয়ান প্রদেশের গর্ভনর ডিং বাওঝেনের নামানুসারে খাবারটির নামকরণ করা হয়েছিল। সিচুয়ান প্রদেশের বিশেষ মরিচের ব্যবহার পদটিকে আলাদা করে তুললেও বিশ্বায়নের বদৌলতে সব বদলে গিয়ে টিকে আছে শুধু নামটাই! মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাও সে তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর এই খাবারের নাম বদলে করে দেওয়া হয়েছিল ‘হোংবাও চিকেন’ বা দ্রুত-ভাজা মুরগি। কারণ, আগের নামটায় যে বড্ড রাজতন্ত্রের গন্ধ! চিকেন মাঞ্চুরিয়ানের উৎপত্তি মোটেও চীন দেশে নয়, বরং বাড়ির পাশে কলকাতার চীনেপাড়ায়। বন্দরে আর চামড়াশিল্পে কাজ করার জন্য চীনারা সতেরো শতকের শেষ দিকে ভারতে আসতে থাকে, সে সময়কার বড় লাট ওয়ারেন হেস্টিংস তাদের থাকার জন্য সাড়ে ছয় শ বিঘা জমিও দিয়েছিলেন। এই চীনারাই নিজেদের মসলা আর রন্ধনশৈলীর সঙ্গে ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসের একটা মেলবন্ধন তৈরি করে জš§ দিয়েছিলেন নতুন এক খাদ্যঘরানার, যা পরিচিত ইন্দোচীনা খাদ্যসম্ভার নামে। বাংলাদেশে চীনা খাবার বলতে আমরা সচরাচর যেসব খাবার খাই, সেসব মূলত এই খাদ্যধারারই অন্তর্গত।
এবার একদম খাঁটি চৈনিক তরিকায় মুরগির একটা পদ রান্নার পেছনের গল্প শোনা যাক। একবার এক ভিক্ষুক এক বাড়ি থেকে একটা মুরগি চুরি করেছিল। লোকজন তাড়া করায় সেই ভিক্ষুক করল কী, একটা পুকুরের ধারে গিয়ে মুরগিটা মেরে পদ্মপাতায় মুড়িয়ে কাদার ভেতর লুকিয়ে রেখে সটকে পড়ল। বেশ খানিকটা সময় পর এসে সেই ভিক্ষুক যখন কাদার ভেতর থেকে মুরগিটা বের করল, তখন দেখে পাতার গায়ে কাদার পুরু স্তর জমে গেছে। বেচারার তো কোনো বাড়িঘর, ঘটিবাটি নেই; তাই সেই কাদার তালটাই ফেলে দিল কাঠকুটো জ্বালিয়ে ধরানো আগুনে। বেশ খানিকটা সময় পোড়ানোর পর সেই কাদার দলা বের করে ভেঙে ভেতরের পাতার পুঁটলিটা খুলতেই ভেসে এল মনভোলানো নির্যাস! তখন আবার সেই পথ ধরে যাচ্ছিলেন সম্রাট, সুগন্ধের টানে তিনি এসে যোগ দিলেন ভিক্ষুকের ভোজে। তারপর যা হয়, সম্রাটের দরাজ হাতের ইনামে ঘুচল ভিক্ষুকের দৈন্যদশা আর এই পদ্মপাতায় মুড়িয়ে কাদা মাখিয়ে পুড়িয়ে রান্না করা মুরগির পদ ঠাঁই পেল রাজকীয় পাকশালে। জানা যায়, ১৯৭২ সালে চীন সফরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনও মজেছিলেন ‘ভিক্ষুকের কুক্কুট’-এর স্বাদে!
সাত সমুদ্র তের নদীর পাড় থেকে বণিকের তুলাদন্ড হাতে নিয়ে এসে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজদন্ড হাতে তুলে নিয়েছিল ইংরেজরা। আর ইংরেজরা ভারত ছাড়লেও ‘কারি’ তাদের ছাড়েনি! উপমহাদেশের অভিবাসীরা ইংল্যান্ডে গড়ে তুলেছে ‘কারি’ শিল্প আর ‘চিকেন টিক্কা মাসালা’ স্বীকৃতি পেয়েছে ব্রিটেনের জাতীয় খাবারের। উপমহাদেশীয় কায়দায় মাটি দিয়ে বানানো চুল্লিতে কাঠ-কয়লার আগুনে সেঁকা মুরগির মাংসের টুকরাকে টকদই আর নানান মসলার ঝোলে চুবিয়ে পরিবেশন করা হয় চিকেন টিক্কা মাসালা। ইংল্যান্ডে প্রবাসী বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি অনেক জাতীয়তার লোকজনই এই পদের পিতৃত্ব দাবি করে আসছেন। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটা হচ্ছে; গ্লাসগোর এক বৃষ্টিমুখর অন্ধকার রাতে আলি আসগর আসলামের শীষমহল রেস্তোরাঁয় উপস্থিত হয়েছিল এক বাস ড্রাইভার। কাজের শিফট শেষে আসা সেই বাস ড্রাইভার অর্ডার করেছিল চিকেন কারি। খাবার পরিবেশনের পর সে সেটা ফেরত পাঠায়, বলে অতিরিক্ত শুকনো আর খটখটে! তখন রাঁধুনি করল কী, অর্ধেকটা খালি হয়ে যাওয়া টমেটো পিউরির কৌটার সবটুকু, দই আর কিছু মসলা মিলিয়ে কড়াইতে একটা ঝোল তৈরি করে তাতে মুরগির টুকরাগুলোকে খানিকটা সাঁতলে উপরে ক্রিম ঢেলে পরিবেশন করেন। খদ্দের একেবারে চেটেপুটে খেয়ে সাবাড় করেছিলেন সেই রান্না। পরদিন বন্ধুবান্ধবসহ ওই বাস ড্রাইভার এসে অর্ডার করেন খাবারটি। এরপর থেকেই শীষমহল রেস্তোরাঁর মেনুতে নতুন এই পদ সংযুক্ত হয় ‘চিকেন টিক্কা মাসালা’ নামে। গ্লাসগোর সাংসদ হাউস অব কমনসে ২০০৯ সালে এই খাবারের ভৌগোলিক স্বত্ব দাবি করে আবেদন করেছিলেন, ভারতীয় এক রসনালিখিয়েও পদটি পাঞ্জাবি খাবার বলে দাবি করেছিলেন, তবে সব ছাপিয়ে চিকেন টিক্কা মাসালা থেকে গেছে ব্রিটেনের বহুজাতিকতার প্রতীক হিসেবে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব রবিন কুক এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘চিকেন টিক্কা মাসালা যে ব্রিটেনের জাতীয় খাবার হয়ে উঠেছে, সেটা শুধু জনপ্রিয়তার নিরিখেই নয়। এই খাবার সত্যিকার অর্থেই ব্রিটেনের বহুজাতিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে, যেভাবে ব্রিটেন ধারণ করেছে বাইরের অনেক প্রভাব।’
সত্তরের দশকের আগপর্যন্ত হিন্দু হেঁসেলে মুরগি ছিল ব্রাত্য। এমন নয় যে বাঙালি হিন্দুরা নিরামিষভোজী, মাছ ছাড়া তো বাঙালির চলেই না। কিন্তু আমিষের অন্য উৎস হিসেবে প্রথম পছন্দ পাঁঠার মাংস। মুরগি পিকনিকে গিয়ে খাওয়া যায়, রেস্তোরাঁয় ফাউল কাটলেট আড্ডার সঙ্গে দেদার চলে; এমনকি স্টিমারেও খালাসিদের রান্না মুরগিতে অমৃতের সন্ধান মিললেও বাড়ির রান্নাঘরে মুরগির প্রবেশ নিষেধ। এমনটা চলেছে সত্তরের দশক পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব- সব মিলিয়ে মুরগি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। আর বর্তমান সময়ে এসে মুরগি তো হয়ে উঠেছে দেশপ্রেমেরই প্রতীক! জুতাটা জাপানি আর স্যুট ইতালিয়ান হলেও পাতের মুরগিটা কিন্তু দেশিই হওয়া চাই!
ভূগোলের বেড়াজাল ডিঙিয়ে মুরগি হয়ে উঠেছে বিশ্বায়নের এক মূর্ত প্রতীক। কেন্টাকি ঘরানার মুরগি ভাজা মিলছে বেইলি রোডে আবার উত্তর ভারতীয় তন্দুরি চিকেন দিব্যি মিলছে লন্ডনের রাস্তায়। চিলি চিকেন, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান- এসব পদ নামেই শুধু ভিনদেশি। আসলে তো উৎপত্তি কলকাতার চীনেপাড়ায়। ব্রিটিশ উপনিবেশও মুরগির বিভিন্ন পদকে জনপ্রিয় করে তুলেছে ভারতীয় রসনায়। চিকেন ডাকবাংলো, মাদ্রাজি চিকেন- এ রকমই দুটো পদ। অবিভক্ত ভারতবর্ষে সরকারি নানান কাজে দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয়েছে সরকারি কর্তাবাবুদের। সেখানেই ডাকবাংলোর বাবুর্চির হাতে রান্না করা দেশি মুরগির সালুনই পরিচিত হয়ে উঠছে চিকেন ডাকবাংলো নামে। তখন তো আর ফ্রিজের বালাই ছিল না, বাংলোর ধারেই থাকত দারোয়ান কিংবা মালির কুঁড়েঘর। তারাই বাবুদের জন্য পেলে-পুষে বড় করত দেশি মুরগি। টাটকা মাংসের গরম-গরম ঝোলের সঙ্গে মোটা মোটা হাতরুটি অথবা ঢেকিছাঁটা চালের ভাত যে কারও জিভেই জল আনবে। চিকেন মাদ্রাজি নামটা ব্রিটিশদের দেওয়া। মাদ্রাজি কারি পাউডার বা মাদ্রাজি কারি পেস্ট দিয়ে রান্না করা ঝাল ঝাল মুরগিই ব্রিটিশ রসনায় ঠাঁই করে নিয়েছে মাদ্রাজি চিকেন বা মাদ্রাজ চিকেন কারি নামে। গোয়ালন্দ স্টিমার কারি নামের যে মুরগির সালুনের কথা সৈয়দ মুজতবা আলী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেকেরই লেখায় খুঁজে পাওয়া যায়, সেটা আসলে স্টিমারের খালাসিদের নিজেদের জন্য রাঁধা মুরগির ঝোল। সরষের তেলে রান্না করা ঝাঁঝালো ও ঝাল এই ঝোল দিয়েই থালার পর থালা ভাত উড়িয়ে দিতেন গোয়ালন্দ থেকে কলকাতার স্টিমার যাত্রীরা। কারও কারও মতে, এই রান্নার বিশেষত্ব হচ্ছে মুরগির ঝোলে কুচো চিংড়ি বাটা, যে কারণে এই তরকারির স্বাদ অন্য রকম। ফাউল কাটলেট খাবারটিও নিঃসন্দেহে ঔপনিবেশিক অবদান। মুরগির কিমাকে বিস্কুটের গুঁড়া মাখিয়ে ডিমের গোলায় চুবিয়ে ডুবো তেলে মচমচে করে ভাজার পর যে খাবারটি তৈরি হয়, সান্ধ্যখাবার হিসেবে তার তুলনা নেই। এখনো রেল ও রকেট স্টিমারের মেনুতে আছে কাটলেট, তারাই ধরে রেখেছে সেই সাবেকিয়ানা। আরও আছে চিকেন স্টু। কলকাতার বেশ কিছু রেস্তোরাঁর পাশাপাশি ময়দান বা ক্লাবপাড়ার ক্যানটিনে যার সরব উপস্থিতি।
মুরগির সব কটা চেনা পদই কি তাহলে ভিনদেশি? মোটেই নয়। শীতের শুরুতে নতুন আলুর সঙ্গে দেশি মুরগির ঝোলটা খেয়ে দেখুন। রান্নাটা যদি বাটা মসলায় হয়, তাহলে বাজি ধরে বলা যায়, চিলি চিকেন আর মুরগির ঠ্যাং ভাজাকে গুনে গুনে দশ গোল দেবে। রোস্টিংটা যদিও রান্নার বিদেশি কেতা, তবে বাংলাদেশে বিয়েবাড়ির যে রোস্ট, সেটা দেশীয় বাবুর্চিদের হাতযশ আর কারিগরির সুবাদে শতভাগ দেশি, বিলেতি পটরোস্টের সঙ্গে এর কোনো মিলই নেই। রেস্তোরাঁগুলোতে সকালবেলা যে মুরগির স্যুপ বিক্রি করে, সেটা কোরমার জ্ঞাতিভাই হলেও নানরুটি বা পরোটার সঙ্গে খেতে দিব্যি। আর না হলে মুরগির লটপটি তো আছেই! অনেকের কাছেই মুরগির যেসব অংশ ব্রাত্য; সেই গিলা, কলিজা, গলার সঙ্গে বুটের ডাল বা আলু দিয়ে ঘন থকথকে ঝোলের সঙ্গে মুচমুচে আগুন গরম পরোটার প্রাতরাশে যে একবার মজেছে, তার কাছে কোথায় লাগে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট!
তাই গলা চড়িয়েই বলতে হচ্ছে, মুরগির মতো গণতান্ত্রিক পাখি আর একটিও নেই। সে জন্যই বোধ হয় ফরাসিরা তাদের জাতীয় প্রতীক করেছে মুরগিকেই!
লেখক: সাংবাদিক, দ্য নিউ এইজ
ছবি: ইন্টারনেট