ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I অফুরন্ত পিয়ের কারদিন
জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে ওঠেন ফ্যাশনজগতের কিংবদন্তি। সৃষ্টিশীল ও নতুন সব পোশাক আর অ্যাকসেসরিজে চমক জাগিয়েছিলেন। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাশনজগৎও ছিল বিপর্যস্ত। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে যে কজন ডিজাইনার বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, পিয়ের কারদিন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সৃজনশীল। এই ফিউচারিস্টিক ডিজাইনার একজন সফল ব্যবসায়ীও বটে। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। দীর্ঘ সত্তর বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ফ্যাশন ও বাণিজ্যের দুনিয়া। হয়েছেন কিংবদন্তি। গত ২৯ ডিসেম্বর ৯৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
পিয়ের কারদিনের জন্ম ১৯২২ সালের ২ জুলাই, ইতালির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ছোট শহর সান বিয়াজিও ডি কালালতায়। তখন ইতালিতে ফ্যাসিস্টদের শাসন। তাদের হাত থেকে বাঁচতে বাবা-মায়ের সঙ্গে মাত্র দুই বছর বয়সে ফ্রান্সে পাড়ি জমান কারদিন। ছোটবেলা থেকেই জামাকাপড় বানানোর প্রতি আগ্রহ ছিল তার। প্রতিবেশী বান্ধবীদের পুতুলের জামা বানাতে মজা পেতেন। আট বছর বয়সেই তিনি ঠিক করেছিলেন, বড় হয়ে ডিজাইনার হবেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে নিয়োগ দেয় সেন্ট ইটেইনের সেরা দর্জি চেজ বম্পুইস। সেখানে তিনি শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেন। শেখেন জামাকাপড় বানানোর অনেক খুঁটিনাটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাবার ইচ্ছায় ফ্রান্সে পাড়ি জমান স্থাপত্যশিক্ষার জন্য। প্যারিসে এসে কারদিনের ভেতরের ডিজাইনার হওয়ার ইচ্ছাটি মাথাচাড়া দিয়ে বসে। স্থাপত্যবিদ্যা পড়া শিকেয় তুলে দর্জি হিসেবে যোগ দেন ফ্যাশন হাউস ‘প্যেকুয়াঁ’তে। সেখানে থাকতে সুযোগ পেয়ে যান জ্য কতকোর বিখ্যাত সিনেমা ‘লা বেলে এত লা বেতে’ (বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট)-এর পোশাক ডিজাইনের। সিনেমার মতো এর পোশাকগুলো ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এরপর শিয়েরাপেলি ভায়া ডিওর হাউস! ১৯৪৬ সালে ফ্যাশনের আরেক কিংবদন্তি ক্রিশ্চিয়ান ডিওর সবে নতুন একটি ফ্যাশন হাউস খুলেছেন। সেখানেই নিয়োগ পেয়ে যান কারদিন। এখানে তার জীবনই পাল্টে যায়। হয়ে ওঠেন ডিওরের খুব কাছের কর্মীদের একজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডিওরের ‘নিউ লুক’ জন্মাতে তাকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেন কারদিন। ডিওর হয়ে ওঠেন তার মেন্টর এবং আইডল। তার কাছ থেকে শেখেন অনেক কিছু। এ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে কারদিন বলেন, ‘আমি ফ্যাশন সম্পর্কে খুব কম জানতাম। তিনি আমাকে বোঝাতে সাহায্য করেন- কোনটি ক্ল্যাসিক, কোনটি এলিগ্যান্ট। ডিওর আমার চেয়েও অনেক ক্ল্যাসিক ছিলেন।’
কারদিন ১৯৫০ সালে নিজের কোম্পানি খোলেন। এখানে তিনি বিভিন্ন থিয়েটারের জন্য পোশাক ডিজাইন করতেন। ১৯৫৩ সালে নিজের প্রথম লেডিস কালেকশন প্রদর্শন করেন। এরপরই, ১৯৫৪ সালে তিনি নিয়ে আসেন প্রথম বুটিক ‘ইভ’। ১৯৫৭ সালে সম্পূর্ণ ছেলেদের পোশাকের কালেকশন দিয়ে খোলেন দ্বিতীয় বুটিক ‘অ্যাডাম’। ফ্যাশন যে শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও- এই বুটিকের মাধ্যমে সেই বার্তা তিনি পৌঁছে দেন সবখানে। সে সময় ছেলেরা তাদের বাবার মতো পোশাক পরত। কারদিন এই ধারা অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। তারই সৃষ্টি ল্যাপেল, কলারবিহীন, বাটন ডাউন টপ স্যুট। যা পরে মঞ্চ আলোকিত করেন সব সময়ের প্রিয় ব্যান্ড ‘বিটলস’-এর সদস্যরা। এভাবেই এগোতে থাকেন তিনি। চলতে থাকে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এটা করতে গিয়েই গাঁটছড়া বাঁধেন ডিপার্টমেন্ট স্টোর প্রিন্টেম্পসের সঙ্গে। উদ্দেশ্য, এক নতুন ধারার পোশাকের উদ্ভাবন; যা শুধু উচ্চবিত্ত নয়, মধ্যবিত্তদের ক্রয়সীমার ভেতর থাকবে। ওত কতুরের একদম বিপরীতধর্মী এই পোশাক শরীরের মাপে নয়, একদম রেডিমেড, যা বিভিন্ন সাইজে আগে থেকেই বানানো থাকবে। এভাবেই বেশ ঝুঁকি নিয়ে হাজির করেন নিজের প্রথম ‘প্রেত অ্যাঁ পোরতার’ কালেকশন। যা আজ আমাদের কাছে পরিচিত রেডি-টু-ওয়্যার হিসেবে। কারদিনই এই ধারার অগ্রদূত। এ জন্য তাকে শাম্ব্রে সিন্দিকেল ডে লা কতুরের রোষানলে পড়তে হয়। তাকে সিন্ডিকেট থেকে বরখাস্ত করা হয়। কারদিন এ নিয়ে বলেন, ‘তারা বলেছিল, রেডি-টু-ওয়্যার আমাকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু এটিই আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।’ পঞ্চাশের শেষে এবং ষাটের দশকের শুরুর দিকে তিনি বেশ কয়েকটি রেডি-টু-ওয়্যার কালেকশন প্রদর্শন করেন এবং তার হাউসে এর আলাদা ডিপার্টমেন্ট সংযোজন করেন।
এরপরই তিনি প্যারিসবাসীকে উপহার দিলেন এক নতুন বুটিক। যেখানে কেবল পাওয়া যেত শিশুদের পোশাক। সময়টা ১৯৬৮। এর আগে অবশ্য বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছেন নিজের তৈরি বাবল ড্রেস ও স্পেস এজ কালেকশন দিয়ে। মূলত এর মাধ্যমেই বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি। স্পেস এজ কালেকশন ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে।
কারদিন ফ্যাশন ও ব্যবসাকে কখনোই আলাদা করে দেখেননি। তার কাছে সব শিল্পই ছিল ব্যবসা। ফলে তিনি ধরতে চেয়েছিলেন এশিয়ার বাজারও। শুরুটা হয় জাপানে। সেখানে সফল হওয়ার পর এগোতে থাকেন চীনের দিকে। চীনা বাজারও তাকে জায়গা করে দেয়। এভাবেই কারদিন ছড়িয়ে গেলেন এশিয়াতে। ভারত উপমহাদেশের ফ্যাশনেও অবদান রেখেছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান এয়ারলাইনস পিআইএর এয়ারহোস্টেসদের পরিহিত প্যাস্টেল শেডের বাঙ্গি রঙের গ্রীষ্মকালীন ও শেওলা সবুজ রঙের শীতকালীন ইউনিফর্ম ডিজাইন করেন কারদিন। এই পোশাক পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশি মেয়েদের নজর কেড়েছিল। ঢাকার ফ্যাশন-সচেতন নারীদের তখন এ ধরনের সালোয়ার-কামিজে দেখা যেত। কারদিনের স্লিমলাইন ট্রাউজার, লং স্লিভ শর্ট কামিজ আর দোপাট্টা সত্তরের শেষ পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয় ছিল। এরপর এখানকার ফ্যাশন ট্রেন্ডে এ ধরনের সালোয়ার-কামিজের কয়েকবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
কারদিনের ফ্যাশন শোগুলোও ছিল বেশ চমকপ্রদ। তার ডিজাইনের কালেকশন প্রদর্শনের জন্য কখনো গেছেন চীনের গ্রেট ওয়ালে, আবার কখনো চাংলি কাউন্টির আরানিয়া সি-বিচে। তবে বিশেষ করে বলতে হবে ১৯৯১ সালের মস্কো রেড স্কয়ারের সামনে ফ্যাশন শোটির কথা। এখানে প্রায় দুই লাখ ফ্যাশন-অনুরাগী দর্শক জমায়েত হয়েছিল।
সব সময় ঝুঁকি নিতে পছন্দ করতেন কারদিন। প্রচলিত ধারাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতেন। না হলে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার কীভাবে এমন পাক্কা ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন! সুগন্ধি, টাই, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, রিয়েল এস্টেট, মিনারেল ওয়াটার, খাবারদাবার, তাজা ফুল, কলম এমনকি চাবির রিং- সবেতেই ছিলেন ঈর্ষণীয়ভাবে সফল। তিনি কখনোই থেমে থাকতে চাননি। বার্ধ্যকের যে পর্যায়ে এসে মানুষ বিশ্রাম নেয়, তখনো তিনি ছুটে চলেছিলেন অবিরত। তার শেষ চমকটি ছিল নিজের ৭০ বছরের অনুজ ডিজাইনার পিয়ের কারটিলিয়ারের সঙ্গে কোলাবোরেশন।
ফ্যাশনের ইতিহাসে কারদিন একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। এখান থেকেই প্রেরণা ও শিক্ষা গ্রহণ করবে সমকালীন এবং ভবিষ্যতের ফ্যাশনপিপাসুরা।
ছবি: ইন্টারনেট