ফিচার I পাওয়ার ড্রেসিং
পরিধেয় কি হতে পারে নারীর সফলতার অনুঘটক? এই জিজ্ঞাসার সমাধান মেলে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে। কী সেই সমাধান? আর কীই-বা সেই আউটফিট? লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
‘পাওয়ার ড্রেসিং’ কনসেপ্ট খুব পুরোনো নয়। গত শতকের সত্তর, আশির দশকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে এই ধারণার বিকাশ ঘটে। এ কৃতিত্ব অবশ্য জন টি মলয়ের। তার দুটি বইয়ের মাধ্যমে ‘পাওয়ার ড্রেসিং’ টার্মটি জনপ্রিয় হয়। বিশেষ করে নারীসমাজে। মলয় ১৯৭৫ সালে ‘ড্রেস ফর সাকসেস’ এবং ১৯৭৭-এ ‘উইমেন: ড্রেস ফর সাকসেস’ নামের দুটি বই বের করেন, যা ছিল লিঙ্গ-নির্দিষ্ট প্রফেশনাল ড্রেস কোডের পূর্ণাঙ্গ বই। তার আগে কেউ এ ধরনের বই লেখেননি। এ জন্য সে সময় টাইম ম্যাগাজিন মলয়কে আমেরিকার প্রথম ‘ওয়্যারড্রোব ইঞ্জিনিয়ার’ উপাধি দেয়। বই দুটিতে তিনি ব্যাখ্যা করেন একজন ব্যক্তির ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্যে পোশাক কীভাবে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এর ভেতর ‘উইমেন: ড্রেস ফর সাকসেস’কে বলা হয়েছে নারীদের পোশাক নিয়ে লেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই। কারণ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে বইটি লেখা হয়েছে, শুধু লেখকের ভাবনার ভিত্তিতে নয়।
মলয়ের বইটি প্রকাশকালে পশ্চিমের নারীরা রাজনীতি, ব্যবসা, সরকারি চাকরি ইত্যাদিতে ব্যাপক হারে যোগ দিতে শুরু করেছে। স্বামী, সন্তান এবং ক্যারিয়ারের জন্যও বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল তাদের। নিজেদের সফল ক্যারিয়ার গড়তে যেসব নারী বিপুল কর্মকান্ডে যোগ দিচ্ছিল, তারাই ছিল মলয়ের ‘অভীষ্ট পাঠক’। পশ্চিমে তখনো রাজনীতি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, সরকারি চাকরির বড় বড় পদের দখল ছিল পুরুষের হাতে। মেধা, সৃজনশীলতা বা পরিশ্রমের দিক দিয়ে নারীরা এগিয়ে থাকলেও তাদেরকে কখনোই পুরুষের সমকক্ষ করে দেখা হতো না। মলয়ের ম্যানুয়ালে কর্মজীবী নারীর উদ্দেশে বলা হয়, তারা যদি ‘পুরুষশাসিত পরিবেশে’ নিজেদের একটি বিশেষ অবস্থান গড়ে তুলতে চায়, তাহলে অবশ্যই এমন ‘ইউনিফর্ম’ পরতে হবে, যা তাদেরকে কর্মক্ষেত্রে কর্তৃত্ব, সম্মান এবং ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করবে। তিনি বইতে আরও উল্লেখ করেছেন, নারীরা কর্ম-এলাকায় পোশাক পরিধানে মূলত তিনটি ভুল করে থাকে, যে কারণে তারা সহজে সফল হয় না। প্রথমত, নারীরাই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে সুযোগ দেয় নিজেদের বিজনেস আউটফিট চয়েসকে প্রভাবিত করার। দ্বিতীয়ত, তারা প্রায়শই নিজেদের যৌনসামগ্রী হিসেবে মনে করে। মনে না করলেও তারা ঠিক ওইভাবেই পোশাক পরত। এবং সর্বশেষ ভুলটি হলো, নারীরা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মতো তাদের আর্থসামাজিক পটভূমিকে সুযোগ দেয় নিজেদের পছন্দকে প্রভাবিত করতে। এই সবকিছু থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ দেন মলয়। নারীকে প্রচলিত প্ল্যাটফর্ম হিল, ঘেরযুক্ত জামা, প্রিন্টের গন্ডি এসব থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। এমন ইউনিফর্ম পরার কথা বলেন, যা অনেকটা পুরুষদের বিজনেস স্যুটের কাছাকাছি।
উনিশ শতকের শুরুতে যখন নারীরা নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করল, তখন তাদের দেখা যেত পুরুষের কোটে। ভারী পোশাকের ‘খাঁচা’ থেকে বেরিয়ে নিজেদের চলাফেরার স্বাধীনতাকে উদ্বেলিত করতে নারীরা পরেছিল ‘ব্লুমারস’ প্যান্ট।
সে সময় স্যুট নারীর কাছে মোটেও অপরিচিত ছিল না। কোকো শ্যানেল প্রথম নারীর জন্য স্যুট নিয়ে আসেন। পরে এটি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেন ক্রিশ্চিয়ান ডিওর এবং ইভ স্য লরার মতো নামী ডিজাইনাররা। যদিও তখন নারীদের মধ্যে তেমন কাউকে স্যুট খুব একটা পরতে দেখা যেত না।
মলয়ের ‘উইমেন: ড্রেস ফর সাকসেস’ বই পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে নারীরা টেইলরিং স্যুট বানানো শুরু করে অফিস আউটফিটের জন্য। রঙ হিসেবে বেছে নিত কালো, ধূসর, নেভি ব্লু। মেয়েদের প্যাটার্নে যোগ হয় পিনস্ট্রাইপ, হাউন্ডসটুথ। স্যুটের সঙ্গে শার্ট পরত সাদা, বেইজ রঙের। পরে বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার জর্জিও আরমানির হাত ধরে আসে ‘পাওয়ার স্যুট’। স্যুটে বটম হিসেবে প্রথমে প্যান্ট থাকলেও পরে পেনসিল স্কার্ট আসতে খুব একটা দেরি হয়নি। আশির দশকের ট্রেন্ডের সবখানেই ছিল এই পোশাকের দৌরাত্ম্য। সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত এই পাওয়ার স্যুট নারীবাদ আর সাম্যের প্রতীক হয়ে আছে।
আশির দশকের পাওয়ার ড্রেসিংকে আরও জনপ্রিয় করার পেছনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সেলিব্রিটি এবং মিডিয়ার বিপুল অবদান রয়েছে। তখনকার জনপ্রিয় সোপ অপেরা ‘ডালাস’ এবং ‘ডাইন্যাস্টি’তে প্রধান নারী অভিনেত্রীদের নানা ডিজাইনের পাওয়ার স্যুটে দেখা যায়। সেগুলো ছিল বিভিন্ন রঙ এবং কাটের। ছিল এমবেলিশমেন্টের নজরকাড়া ব্যবহার। পাওয়ার ড্রেসিংয়ের একটি বড় অংশ ছিল অ্যাকসেসরিজ। স্যুটের সঙ্গে গয়না হিসেবে সলিড কাট গোল্ড, সিলভার, পার্ল নেকলেস পরার ভালো আইডিয়া নারীরা এই সোপ অপেরাগুলো থেকে পান। এ ছাড়া কিছু বিখ্যাত মুভি যেমন ওয়ার্কিং গার্ল, টপ গান, হেদারস ইত্যাদিতে এই স্টাইল দারুণভাবে উপস্থাপন করা হয়। এরপর বিশেষভাবে বলতে হবে লৌহমানবীখ্যাত যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের কথা। তার স্টাইল পাওয়ার স্যুটের স্পিরিটকে অন্য মাত্রা দেয়। তাকে যারা নিজের আইডল হিসেবে দেখতেন, তারা সবাই তার মতো পোশাক পরা শুরু করেন। এরপর প্রিন্সেস ডায়ানার কথা না বললেই নয়। নিঃসন্দেহে আশির দশকের ফ্যাশন ট্রেন্ডের বড় প্রভাবক ছিলেন প্রিন্সেস ডি। সে সময় তাকে বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ফরমাল অনুষ্ঠানে দেখা যেত বাহারি রঙের প্যাডেড বা ব্রড শোল্ডারের স্যুট এবং হাঁটুসমান স্কার্টে। তার দেখাদেখি ধীরে ধীরে অফিস পাড়াতে নারীরা রংবেরঙের পাওয়ার স্যুট পরে আসতে শুরু করে।
একটা সময় দেখা যায়, বৈশিষ্ট্যের জন্য পাওয়ার ড্রেসিং অন্য পোশাকের থেকে আলাদা, সেই সব ফিচার দিয়ে সাধারণ পোশাক তৈরি হচ্ছে। যেমন গাউন, টপস, শার্টে প্যাডেড বা ব্রড শোল্ডারের ব্যবহার। এটিই হয়ে যায় আশির দশকের আইকনিক ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
এরপর নব্বই দশক, ওয়াইটুকে এবং এর পরবর্তী দশ বছরে পাওয়ার ড্রেসিংয়ের বেশ বিবর্তন হয়েছে। নব্বইয়ে পাওয়ার স্যুট হয় মিনিমালিস্ট। বাদ পড়ে প্যাডেড শোল্ডার, অতিরিক্ত এমবেলিশমেন্ট, চড়া রঙ। এর বদলে আসে লেসি কেমিসোল, সিল্ক টপ যা পিনস্ট্রাইপ প্যান্টের সঙ্গে পেয়ার করা হতো। স্লিমার কোটের সঙ্গে ফ্লেয়ার প্যান্ট পরতে দেখা যেত। সেই সময়ে অফিস কালচারে যোগ হয় ‘ক্যাজুয়াল ফ্রাইডে’, যার মানে শুক্রবারে কোনো স্যুট পরিধান করা যাবে না। ওয়াইটুকের সময় একদিক থেকে পাওয়ার স্যুটে আরও বেশি করে স্কার্ট, ভেস্টের ব্যবহার শুরু হয়, অন্যদিকে এটি পরার হার কমে আসতে থাকে। এর পরবর্তী দশ বছরে পাওয়ার ড্রেসিং পুরোনো সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসে। জর্জিও আরমানি, যিনি পাওয়ার স্যুটকে বিখ্যাত করেছেন, তিনিও বলছেন নারীদের ক্ষমতা, সম্মান, কর্তৃত্ব আদায় বা প্রমাণের জন্য এখন এটির প্রয়োজন নেই। যেকোনো পোশাক পরে তারা নিজেদের যোগ্য অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে। ক্ষমতাশালী নারীরা এখন করপোরেট গাউন পরছে। কেউবা পরছে জিনস, শার্ট, টি-শার্ট। ক্যাজুয়াল পোশাক পরে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অফিসে যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে পাওয়ার স্যুট বিলুপ্ত হয়নি মোটেও।
মডেল: নিকি
ওয়্যারড্রোব: রুলমেকার
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দিন