ফিচার I স্বাদের প্রভাবক
প্রযুক্তির উৎকর্ষে রান্নার মাধ্যম বদলে যাওয়ায় খাবারের স্বাদ ও পুষ্টিমান কমছে। তৈজসের কোনো কোনো উপাদান স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ায়
খাবার সুস্বাদু করতে রান্নার মাধ্যমটি গুরুত্বপূর্ণ। চুলা, পাত্র, এমনকি জ্বালানির প্রভাবও পড়ে স্বাদে। বলা হয়, মাটির চুলায় রাঁধলে খাবার মুখরোচক হয়। এর পেছনে কিছু বিজ্ঞান আছে। সেই কৌশল জানতে হয় রাঁধুনিকে। এ ক্ষেত্রে ‘দমের খড়ি’র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেসব লাকড়ি পুড়তে দীর্ঘ সময় লাগে এবং যেগুলো বেশি তাপ উৎপন্ন করে, সেগুলোকে দমের খড়ি বলে। বট, তেঁতুল ও বরইগাছের কাঠ এবং বাঁশের মাথার অংশ বেশিক্ষণ ধরে পোড়ে। তাপ বিকিরণও করে প্রচুর। এগুলোই দমের খড়ি। মাংস রাঁধতে এ ধরনের জ্বালানি লাগে। এগুলো অনেকক্ষণ ধরে পুড়ে তাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে মাংসের পদ সুস্বাদু হয়। অন্যান্য লাকড়ি দিয়ে রাঁধলে তা না-ও হতে পারে। কম দমের কাঠ বা গাছের ডালগুলো মাছ বা সবজি রাঁধতে ব্যবহৃত হতে পারে। মাংস রান্নার পর দমের জ্বালানির যে অঙ্গার থাকে, তা দুধ জ্বাল দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে দুধ ঘন হয়। জ্বালানি ছাড়াও চুলার বয়সও খাবারের স্বাদে প্রভাব ফেলে। মাটির চুলা যত পুরোনো হয়, সেটির ভেতরের অংশ পুড়তে পুড়তে তত বেশি লাল হয়ে ওঠে। পুরোনো চুলা দ্রুত তাপ ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে মাটির চুলায় রাঁধলে খাবার সুস্বাদু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
জ্বালানি ও চুলা ছাড়াও কোন পাত্রে রান্না হচ্ছে, সেটির ওপরেও পদের স্বাদ ও পুষ্টিমান নির্ভর করে। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে বলা হয়েছে, মাটির পাত্র রান্নাকে ধীর করে; খাবারের স্বাদ উন্নত করে। কাদা দিয়ে তৈরি হয় বলে মাটির পাত্র প্রাকৃতিকভাবেই ক্ষারীয়, যা খাবারের অ্যাসিড প্রশমন করতে সক্ষম। তাপ প্রয়োগে মাটির পাত্রের ক্ষার খাবারের অম্লের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। ফলে পিএইচের ভারসাম্য ঠিক থাকে। এতে খাদ্য সহজপাচ্য হয়। তা ছাড়া মাটির পাত্রে রান্না করলে পদের লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও সালফার অটুট থাকে। এ ধরনের পাত্রে কম তেলে রান্না করলেও খাবার সুস্বাদু হয়।
মাটির হাঁড়ির যুগ পেরিয়েছে। সেই জায়গা দখল করছে ধাতু। কিছু ধাতব পাত্রে করা রান্না শরীরের জন্য উপকারী। অপকারিতাও আছে। যেমন ননস্টিক প্যানে রান্না করা খাবার খাওয়া ক্ষতিকর। এ ধরনের পাত্রে পারফ্লুরোকট্যানয়িক নামের উপাদান থাকে, যা অম্লীয়। তাই এই প্যানে রাঁধলে খাবার অ্যাসিডিক হয়ে যেতে পারে, যা স্বাস্থ্যে খারাপ প্রভাব ফেলে। এমনকি টিউমার হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। নিরাপদ বিকল্প হতে পারে লোহার পাত্র। তাতে তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম। কপারের ও নিকেলের পাত্রে রান্না করা খাবারও ক্ষতিকর। এ ধাতুদ্বয়ে তাপ দিলে তা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক তৈরি হয়, যা খাবারে প্রবেশ করে। তবে নিকেলমুক্ত ইস্পাতপাত্রে রান্না করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কম তাপে রাঁধলে ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে।
রান্নার পাত্রের দোষে হতে পারে আলঝেইমার। অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রাঁধলে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব রোগ-বালাই, অম্ল ও বিষক্রিয়া এড়াতে সিরামিক পাত্রে রান্না করাই ভালো। মাইক্রোওয়েভ আভেনের জন্যও এই উপাদানের পাত্র উপযোগী। অনেকেই আভেনে প্লাস্টিকের পাত্র ঢোকায়, যা খাদ্যকে বিষাক্ত করে। কেননা, তাতে বিসফোনেল নামের উপাদান থাকে। এটি হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এমনকি হৃৎস্পন্দনের গতি অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। এটি হয় মাইক্রোওয়েভ আভেনের রেডিয়েশনের কারণে। করোনারি আর্টারিতে চর্বির প্রলেপ পড়ার প্রকোপও বাড়ে। ফলে হার্টের অসুখ এবং আচমকা হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই যারা অনিয়মিত হৃৎস্পদনে ভোগে কিংবা বুকের ব্যথার রোগী, তাদের এই মাধ্যমে রান্না করা খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
তা ছাড়া প্লাস্টিক থেকে ক্যানসার তৈরিকারী উপাদান খাবারে প্রবেশ করে। তাই তাতে খাবার তাপ দেওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সম্ভব হলে রান্নার ক্ষেত্রে মাইক্রোওয়েভ আভেন এড়িয়ে চললেই ভালো হবে। এ ধরনের চুল্লিতে রান্নার কিছু খারাপ দিক আছে। যার প্রভাব পড়ে খাবারে। যেমন আভেনে রান্না কিংবা খাবার গরম করলে ভিটামিন বি১২ অকার্যকর হয়ে পড়ে। এমনকি প্রতিবার গরমের ফলে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয় ভিটামিনটির। তা ছাড়া মাইক্রোওয়েভ আভেন উচ্চ তাপ বিকিরণ করে। তাতে খাবারের সব ধরনের পুষ্টিগুণই ভেস্তে যেতে পারে। বিশেষ করে দুধ ও মাংস প্রচুর ভিটামিন বি১২ হারায় মাইক্রোওয়েভে গরম করার কারণে। দুধের অ্যামিনো অ্যাসিডও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তা পরিবর্তিত হয়ে কার্সিনোজেনিক সাবস্ট্যান্স তৈরি করে। এই উপাদান ক্যানসারের কারণ। মাংসের অ্যামিনো অ্যাসিডও ডি-নাইট্রোসোডিএন্থানল অ্যামিনস হয়ে যায়। এটিও ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ায়। এই তাপযন্ত্রে রান্না করলে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থও অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। উচ্চ তাপে ভিটামিন সি-ও নষ্ট হয়। নিয়মিত মাইক্রোওয়েভ আভেনে রান্না করা খাবার খেলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে। অ্যাপেন্ডিসাইটিস, গলস্টোন, বন্ধ্যাত্ব, ছানি এবং ইসকেমিক ডিজিজের প্রবণতা বাড়ে।
মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করলে বেনজিন ও জাইলিন তৈরি হতে পারে, যা বিষাক্ত রাসায়নিক। অনেক মা বুকের দুধ মাইক্রোওয়েভ আভেনে গরম করেন। এতে দুধ পুষ্টিগুণ হারায়। এমনকি তাতে আর ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধের ক্ষমতা থাকে না। কেননা অ্যান্টিবডিগুলো মরে যায়। রক্তের লোহিত কণিকাও কমে যেতে পারে মাইক্রোওয়েভে রান্না করা খাবার খেলে। পাশাপাশি শ্বেতকণিকা বাড়ে। এই মাধ্যমে রান্না করা খাবার খেলে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়। ফ্রিজে রাখা সবজি মাইক্রোওয়েভ আভেনে গরম করলে খাবারের উপকারী প্ল্যান্ট অ্যালকালয়েড বিষাক্ত পদার্থে বদলে যায়, যা নানান রোগের কারণ। এই তাপযন্ত্রে বিট, গাজর ও মুলা সেঁকে স্যালাড বানালে ফ্রি র্যাডিক্যাল তৈরি হয়, যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমায়।
মাইক্রোওয়েভ আভেনের রান্না খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে পেটেও গন্ডগোল দেখা দেয়। হজমশক্তি একেবারেই কমে যেতে পারে। এমনকি লসিকাগ্রন্থির কর্মক্ষমতা কমে যায়। এই চুলায় রান্না করা খাবার মস্তিষ্কের তরঙ্গে খারাপ প্রভাব ফেলে। তাই নার্ভের সমস্যা দেখা দেয়। এতে মানসিক স্থিতাবস্থা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধি, স্থিরতা ও ধৈর্য কমে। ডিপ্রেশনও বাড়তে পারে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট