স্বাদশেকড় I প্যাঁচালো মিষ্টান্ন
জিলাপির স্বাদ কে না নিয়েছে! গ্রামের মেলা থেকে অভিজাত মিষ্টিবিপণির শোকেস অব্দি। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
রোজার সময় চকের ইফতারের বাজারে যাদের আনাগোনা, তারা পদটি অবশ্যই দেখেছেন, ঠোঙায় পুরে ঘরেও নিয়ে গেছেন। পঞ্চাশ গ্রাম থেকে শুরু করে পাঁচ কেজি ওজনেরও হয়। জিলাপির প্যাঁচ- চকের সেই মানুষের মেলা থেকে অক্ষত অবস্থায় ঘরে আনাও কম ঝক্কির ব্যাপার নয়! প্রবীণেরা বলেন, জিলাপি বলে ডাকলে নাকি বেয়াদবি হয়, তার নাম হলো জলেবা। আর এখনকার ‘পোলাপানের’ ভাষায় ‘শাহি জিলাপি’। তবে আমিও বলতে চাই- নামে কী আসে যায়, রসেই যার পরিচয়!
জিলাপির নাম ও ধারণা এসেছে মধ্য এশিয়া থেকে। ইরানের জালিবিয়া, আরবের জালাবিয়া আর আমাদের জিলাপি/জিলিপি একই জিনিস। সেখানে উৎসবে আর রমজানের সময় গরিবদের বিলানো হয় এই মুচমুচে, মিষ্টি শত-প্যাঁচি জিলাপি। তেরো শতকে মুহাম্মাদ বিন হাসান আল-বাগদাদির লেখা রেসিপির বই ‘কিতাব আল তাবিখ’-এ রয়েছে জিলাপি তৈরির কলাকৌশল। আট শ বছর পরও সে কৌশল অবিকৃত। ভারতে এটির আগমন সম্ভবত পারস্যের মানুষজনের হাত ধরেই, মুসলিম শাসনের সময়ে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সংস্কৃত ভাষায় এর উল্লেখ মেলে ‘কুন্ডলিকা’ আর ‘জলবল্লিকা’ হিসেবে। ১৪৫০ সালে জৈন সাধক জিনসুরের লেখা ‘প্রিয়ঙ্কর-রূপরেখা’-তে রয়েছে জিলাপির কথা। এই পুঁথির উল্লেখ আবার পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে রঘুনাথের লেখা ‘ভোজন-কুতূহল’ বইয়ে। ১৬০০ সালে সংস্কৃত ভাষায় লেখা ‘গুণ্যগুণবোধিনী’ বইয়ে এই খাবারের উপকরণ আর প্রণালি- দুটোরই বর্ণনা মেলে। আবার ১৬০০ সালে আন্নাজির লেখা ‘সৌন্দরা বিলাস’ নামের কান্নাড়া কবিতায়ও ঈশ্বর পূজায় নিবেদন হিসেবে জিলাপির উল্লেখ রয়েছে।
পদটি যখন পারস্য পেরিয়ে ভারতে এসেছে, যাত্রাপথেই তৈরি হয়েছে এর বিপুল ভক্ত। পারস্য পেরিয়ে আফগানিস্তানে এলে তারাও সেই রসে মজে যায়। আফগানরা শীতে শুকনো মাছ আর জিলাপি খেয়েই নাকি ঋতুবদলের প্রার্থনায় দিন গোনে। পাকিস্তানেও এই পদের সমঝদার কম নেই। ভারত আর বাংলাদেশে তো জিলাপি খাওয়ার সময়-অসময় নেই। ভারতে হরিদ্বার, ইন্দোরসহ আরও কিছু শহরে সকাল শুরু হয় রাবড়ি বা দুধে জিলাপি ভিজিয়ে। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে ভোজনের পর ডেজার্ট হিসেবে এটি খাওয়ার চল রয়েছে। আমাদের দেশে মানুষ কারণে-অকারণে জিলাপি খায়। সকালের নাশতাতেও চলে, খাওয়ার পরের মিষ্টিমুখ হিসেবেও চলে।
অনেকেই আবার জিলাপিকে গুলিয়ে ফেলেন জাহাঙ্গিরির সঙ্গে। জাহাঙ্গিরি জিলাপির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক মিষ্টান্ন, যাকে আমরা বাংলায় আমৃতি বলে থাকি, আর হিন্দুস্তানিরা ইর্মাতি। জাহাঙ্গিরিই আবার নেপালে গিয়ে হয়েছে জেরি। জিলাপির রকমফেরও রয়েছে দেশে দেশে। ইরানে চিনির পাশাপাশি মধুও ব্যবহার করা হয়, সঙ্গে থাকে জাফরান বা গোলাপজল। মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকায় চিনি ও মধু তো থাকেই, সঙ্গে যোগ হয় সামান্য এলাচি। দেশগুলোতে জালাবিয়া তৈরি হয় ডিম, ময়দা আর দুধের ব্যাটার থেকে। জিলাপি যেমন প্যাঁচ দিয়ে বানানো, জালাবিয়ার আকৃতিতে তেমন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। এটি কখনো ডোনাটের মতো আবার কখনো গোলাকারও হয়। তাতে থাকতে পারে দারুচিনি, লেবু বা মিহি চিনি।
বাংলায় জিলাপি নিয়ে এল কারা? ফার্সিভাষী তুর্কিরা নাকি তাদের ইথিওপীয় দাসেরা? আবার এই দাসেরাই তো বাংলার তখ্তে আসীন ছিল কিছুকাল। তখন কি জিলাপি রাজকীয় খাবার হয়েছিল? কে জানে! ষোড়শ শতাব্দীর কৃত্তিবাসের ‘সপ্তকান্ড রামায়ণ’ আর রঘুনাথ ভগবতাচার্যের ‘শ্রীকৃষ্ণ প্রেম তরঙ্গিনী’তে বাংলা এলাকার মিষ্টান্নের তালিকায় রয়েছে ছানাবড়া, খাজা, পিষ্টক, মোদক, মালপোয়া, সীতামিছরি আর সন্দেশের পাশাপাশি জিলাপিও। বিহারের খাবারেও জিলাপি তার জায়গা করে নিয়েছে।
ঢাকার জিলাপির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘শাহি জিলাপি’; যা কেবল রোজার মাসে চকবাজারের মেলাতেই পাওয়া যায়। মানে এটি খাওয়ার জন্য পঞ্জিকা ধরে অপেক্ষায় থাকতে হয়। জিলাপি কি এমন তুচ্ছ মিষ্টান্ন যে চাহিবামাত্র ইহার রসিককে দিতে বাধ্য থাকিবে ময়রাগণ! দুর্লভ জিনিসটি পেতে একটু কষ্ট তো করতেই হয়! এক কেজির জিলাপি খাওয়া যায় সাত-আটজনে ভাগ করে। আর তার থেকে বেশি ওজনের গুলো পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় সবাইকে বিলিবণ্টন করেই খাওয়ার রেওয়াজ। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই গুরুভারে তার স্বাদের কোনো খামতি হয় না। এরপরই আসে গুলিস্তানের নিউ পূর্ণিমা স্ন্যাকসের জিলাপির কথা। সারা বছর সকাল থেকে রাত অব্দি মেলে এখানকার জিলাপি, গত ৬০ বছরে এই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। শাহি জিলাপি আর পূর্ণিমার জিলাপি এই দুই পদের রেসিপিতে মেলে মাষকলাই ডালবাটা, ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার, টক দই, বেকিং পাউডার, সয়াবিন, চিনি, জাফরান, গোলাপজল, এলাচিগুঁড়া, খাবার রং ইত্যাদি।
ঢাকায় আরেকটি পদেরও দেখা মেলে, রেশমি জিলাপি। ২০০৭ সাল থেকে ঢাকায় এর আনাগোনা, জয়পুর সুইটসের হাত ধরে। রোজার সময় এর কদরও কম নয়, রীতিমতো সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে নাগাল পেতে হয় এই আরাধ্য বস্তুর। আকারে ছোট আর ছিপছিপে চিকন গঠনের জন্য এর নাম রেশমি জিলাপি। চিকন গড়নের কারণে এর মধ্যে চিনির শিরার প্রবেশাধিকার কম, আর একই কারণে মচমচেও হয় অন্য জিলাপি থেকে। অবশ্য এটির জনপ্রিয়তার কারণে পাড়া-মহল্লায়ও ইদানীং তৈরি হতে শুরু করেছে, তবে আসল রেশমি জিলাপির স্বাদের ধারে-কাছেও তা যেতে পারে না। কারণ, আসলটিতে ব্যবহার করা হয় চিনিগুঁড়া বা কালিজিরার মতো সুগন্ধি চালের গুঁড়া আর ঘি।
এ ছাড়া ঢাকায় আরও কিছু জিলাপির দোকান আছে। সেগুলোয় ভালো মানের সুস্বাদু জিলাপি তৈরির চেষ্টা হয়ে থাকে। তবে এই পদ নিয়ে এত কথা বলতে গিয়ে গ্রামীণ জিলাপির কথা ভুলে গেলে চলে না। ¯্রফে অলংকারহীন জিলাপির আড়াই প্যাঁচ ভেজে, চিনির শিরায় ডোবানো সেই খাবারের স্বাদও কম যায় না। ঘিয়ের বাতুলতা নেই, নেই জাফরানি রং, এলাচির স্বাদ, তবু গ্রামের মেলায় এর খদ্দেরের কখনো কমতি হয় না। গ্রামের জিলাপির কথা যখন এলোই, তখন আর একখানা জিলাপির কথা নাহয় বলেই ফেলা যাক- গুড়ের জিলাপি। শীতের দিনে গ্রামের হাটের নলেন গুড়ের জিলাপির কথা ভুলে গেলে কি আর হবে! আরেক পদেরও অবশ্য হয়- ছানার, তবে সেটা যতটা না জিলাপি, তার থেকে অনেক বেশিই অভিজাত মিষ্টান্নের কাতারে পড়ে যায়, আমজনতার আয়ত্তের বাইরে।
ছবি: ইন্টারনেট