ফিচার I সেই সব মহীয়সী
নিজের যোগ্যতায় সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নারীও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারে। সমাজের দৃষ্টিতে অচ্ছুত, প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সম্মান, খ্যাতি ও জ্ঞানের শীর্ষে। ছড়িয়েছেন নিজস্ব ব্যক্তিত্বের আলো। এমনই কয়েকজন নারীকে নিয়ে এবারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিমূলক প্রতিবেদন
খনা
এই উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখে ছন্দোবদ্ধ প্রবাদরূপে কৃষিকাজ, শস্য ও বৃক্ষরোপণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, গৃহনির্মাণ, পশুপালন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে যেসব বচন শোনা যায়, সেগুলো খনার নামে প্রচলিত। কিন্তু কে এই খনা? কথিত আছে, তিনি মহীয়সী, কারও কারও ধারণায় বিদুষী জ্যোতির্বিদ, আবার অনেকে তাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি হিসেবে।
খনার পরিচয় সম্পর্কে কিছু তথ্য তার বচনে পাওয়া যায়। যেমন, একটিতে খনার পিতার নামের উল্লেখ আছে অটনাচার্য- ‘আমি অটনাচার্যের বেটি, গনা-বাছায় কারে না আঁটি।’ কিছু বচনে ‘মিহির’ এবং ‘বরাহ’র নাম পাওয়া যায়। যেমন, ‘ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী, শোন পতির পিতা, ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা। রাজ্য নাশে, গো নাশে, হয় অগাধ বান, হাতে কাটা গৃহী ফেরে কিনতে না পান ধান’; ‘খনা কয় বরাহেরে কোন লগ্ন দেখো, লগ্নের সপ্তম ঘরে কোন গ্রহ দেখো।’ এসব বচনে উল্লিখিত হয়েছে খনার স্বামী মিহির এবং শ্বশুর বরাহ।
তবে গবেষকদের ধারণামতে, খনা অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে বাংলার কৃষিপদ্ধতিতে সংযোজন করেছিলেন নতুন দিকনির্দেশনা। চাষকৌশলে তার বচন প্রয়োগ করে অভিজ্ঞ হয়েছিল কৃষক এবং সাফল্য এনেছিল ফসল উৎপাদনে। অনুমান করা হয়, বাংলাদেশে কৃষির সূচনাপর্বে খনা এসব বচন রচনা করেছিলেন। এভাবে তিনি কৃষকদের কাছের মানুষ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তার এই জ্ঞান ও জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেননি শ্বশুর বরাহ। খনার অগাধ পান্ডিত্যের কথা চারদিকে রটে গেলে পুরুষতন্ত্রের জিঘাংসা প্রবল হয়ে ওঠে। বরাহ মিহিরকে নির্দেশ দেন খনার জিব কেটে ফেলতে। মিহির বাবার আদেশ পালনের জন্য তৈরি হন। তবে জিব কাটার আগে তিনি খনাকে কিছু বলার সুযোগ দেন। খনা চাষপদ্ধতি, মাটি, আবহাওয়া, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং গৃহস্থালির বিভিন্ন দিক ও মানবজীবনের নানা সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলেন। এরপর জিব কর্তনের পর তার মৃত্যু হয়। দীর্ঘকাল ধরে খনার বচন মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। এসব বচনে মানুষ কার্যকর দিকনির্দেশনা পেয়েছে। এ কারণেই পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো গবেষক খনাকে পুরুষ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। পুরুষের ঊর্ধ্বে কোনো নারীর এত জ্ঞান মানা যায় না, এই ছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতন্ত্রের হাতে নারীর প্রজ্ঞা মুছে ফেলার আরও প্রমাণ এই যে, ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের ইতিহাসে বিদুষী খনার উল্লেখ নেই।
কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, খনা স্মরণীয় হয়ে আছেন বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজের জীবনচর্যায়।
বিনোদিনী দাসী
উনিশ শতকের নাট্য আন্দোলনে যে কজন নারী অবরুদ্ধ সমাজের অন্দরমহল খুলে দেন, বিনোদিনী দাসী তাদের পথিকৃৎ। কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লির অন্ধকারে ১৮৬৩ সালে তার জন্ম। তখনো সাবেকি নবাব-বাবুদের দখলে ছিল শহরটি।
বিনোদিনীর জন্ম ১৪৫ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে পতিতালয়ে, তখন অনতিদূরে সভ্য পাড়ায় জন্মেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১] আর বিবেকানন্দ [১৮৬৩-১৯০২]। বাংলা সাহিত্য ও ধর্মভাবনার এই দুই প্রবাদ পুরুষের পাশাপাশি বিনোদিনী পতিতালয় থেকে যেভাবে কলকাতার নাট্যমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা বিস্ময়কর। কেননা তখন সেখানে সভ্য ঘরের নারীদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার বলতে কিছুই ছিল না। নিষিদ্ধ পল্লির নারীদের দশা তো তথৈবচ।
বিনোদিনীর পিতা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। বাল্য-জীবনের স্মৃতিচারণা থেকে যেটুকু জানা যায়, সেখানে তার মা, মাতামহী, মাতা ঠাকুরানীর উপস্থিতি প্রবল। মাতামহীর একটি বাড়ি ছিল পতিতাপল্লিতে। সেই বাড়ির ভাড়া দিয়ে তাদের সংসার চলত। এখানেই, প্রচন্ড অভাবের মধ্যেও নিজের কণ্ঠ পরিশীলিত করে তোলেন প্রতিবেশী গঙ্গা বাইজির আনুকূল্যে। এ সময় তার বয়স মাত্র সাত-আট।
১৮৭৪ সালে তেরো বছর বয়সে পেটের দায়ে মঞ্চে এসে দাঁড়ান বিনোদিনী। তখন বাংলা নাটক বাবুবাড়ির অন্দরমহল ছেড়ে আমজনতার কাছে মঞ্চে পরিবেশিত হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে পুরুষ-অভিনেত্রীদের পরিবর্তে মঞ্চে এসে দাঁড়ায় নারীরা। এলোকেশী-জগত্তারিণী-সুকুমারী-ক্ষেত্রমণি-লক্ষ্মী-নারায়ণী প্রমুখ অভিনেত্রীর পথ ধরে মঞ্চে আসেন বিনোদিনী।
নাট্যজীবনের সূচনায় বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে ন্যাশনাল থিয়েটার আর শরৎচন্দ্র ঘোষের শিক্ষায় বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনয় করলেও বিনোদিনী দাসীর মঞ্চকুশলতা ও সফলতা আসে গিরিশ ঘোষের তত্ত্বাবধানে। বলা চলে, তিনিই ছিলেন বিনোদিনীর প্রত্যক্ষ শিক্ষক। ‘আমার কথা’ গ্রন্থে গিরিশ ঘোষের নাটকের পার্ট শিক্ষা দেবার কৌশল, চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে প্রয়োজনীয় জ্ঞান প্রদানের পদ্ধতি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
গিরিশ ঘোষের নির্দেশনায় বহু মঞ্চনাটকে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিনোদিনী। মধুসূদন দত্তের কাব্যকাহিনি ঘিরে গিরিশ ঘোষের রূপান্তরে ‘মেঘনাদ বধে’ সর্বাধিক সাতটি চরিত্রে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। এই নাটকে কখনো চিত্রাঙ্গদা, কখনো প্রমীলা বা বারুণী, কিংবা রতি, মায়া, মহামায়া আবার কখনো সীতা হয়েছেন একই রজনীতে।
বিনোদিনী তার জীবন শেষ পর্যন্ত নিরাশার ভেতর কাটিয়ে দিলেও বাংলা মঞ্চনাট্যের ইতিহাস ও তার বিবর্তন, কলকাতার তৎকালীন জীবন, সমাজ ও সময়কে সার্থকভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন তার ‘আমার কথা’ গ্রন্থে।
কানন দেবী
ভারতীয় সংগীত ও চলচ্চিত্রে অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাসাবাড়িতে বাসন মেজে, ঝিয়ের কাজ করে যার জীবন একসময় অতিবাহিত হয়েছে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তিনিই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি। কানন দাস, কাননবালা, কাননবালা দেবী নামেই বিখ্যাত এই শিল্পী। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সেরা অভিনেত্রীদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার অর্জন করেন। অভিনয়ের বাইরে কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও তিনি অনন্য। তা ছাড়া সেবামূলক কাজেও নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন এই নারী। বিশেষত, দুস্থ ও বয়স্ক শিল্পীদের সহযোগিতার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মহিলা শিল্পী মহল’।
তার সম্পর্কে সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘কানন কিন্তু একাই এক নিখুঁত, অতুলনীয় প্যাকেজ। আর গান বলে গান! কার নয়, আর হায়, কী গান! কি বাংলায়, কি হিন্দিতে।’ এমনকি রবীন্দ্রনাথ তার সিনেমায় গানের চিত্ররূপ অনুমোদন করলে সেটি গেয়েছিলেন কানন দেবী- ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে।’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার গান শোনার জন্য শান্তিনিকেতনে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
১৯২৬ সালে বারো-তেরো বছর বয়সে কানন দেবী প্রথম অভিনয় করেন ‘জয়দেব’ সিনেমায়। ১৯৩৬ সালে দেবকী বসুর সিনেমা ‘বিদ্যাপতি’ তাকে অসাধারণ জনপ্রিয়তা দেয়। প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ চলচ্চিত্র তো বাংলা ছবির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এ সিনেমায় কানন দেবীর অভিনয় এবং রবীন্দ্রসংগীত দর্শক-শ্রোতাদের অনুরাগী করে তুলেছিল। নজরুলসংগীতেও তিনি ছিলেন অসামান্য শিল্পী। ১৯৬৪ সালে তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হন। ২০১১ সালে তার স্মরণে প্রকাশিত হয় বিশেষ ডাকটিকিট। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কানন দেবী পশ্চিমবঙ্গের হাওড়াতে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রতনচন্দ্র দাস এবং মা রাজবালা দেবী। জানা যায়, মা ছিলেন তার বাবার রক্ষিতা। কানন দেবী আত্মকথায় বলেছেন, ‘এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি মানুষ, সেই পরিচয়টাই আমার কাছে যথেষ্ট।’
হাইপেশিয়া
আলেকজান্দ্রিয়ায় ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গণিতবিদ হাইপেশিয়ার উত্থান যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি মর্মান্তিক তার মৃত্যু। সম্ভবত, তিনিই প্রথম নারী গণিতজ্ঞ। ইউক্লিডের পর এত বড় গণিতবিদের জন্ম হয়নি বলে কথিত। গবেষকদের মতে তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী ইতিহাসের শেষ ‘প্যাগান সায়েন্টিস্ট।’ খ্রিস্ট ধর্মব্যবসায়ীদের রোষানলে পড়ে হাইপেশিয়া মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রয়াণের পর পাশ্চাত্যে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটতে সময় লেগেছে প্রায় এক হাজার বছর।
হাইপেশিয়ার বাবা থিওন নিজেও ছিলেন বড় মাপের গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ এবং আলেকজান্দ্রিয়া মিউজিয়ামের পরিচালক। তখন নারীদের আক্ষরিক অর্থে দেখা হতো পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে। থিওন তার মেয়েকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ রূপে। হাইপেশিয়া তা তো ছিলেনই, একই সঙ্গে ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী ও জ্ঞানী। ফলে তাকে বিয়ে করার জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন অনেকেই। কিন্তু স্বাধীনচেতা হাইপেশিয়া প্রত্যেককেই প্রত্যাখ্যান করেন। নিজেকে নিয়োজিত করেন বিজ্ঞান সাধনায়। অর্জন করেন আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপকের পদ। দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা আসত তার বক্তৃতা শুনতে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি কক্ষে প্রতি সন্ধ্যায় বক্তৃতা দিতেন।
হাইপেশিয়ার মৌলিক কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দায়োফ্যান্তাস রচিত অ্যারিথমেটিকা গ্রন্থের ওপর ১৩ অধ্যায়ের আলোচনা, অ্যাপোলোনিয়াসের কৌণিক ছেদ পুস্তিকার ওপর রচনা, টলেমির কাজ নিয়ে প্রবন্ধ।
তার জ্ঞান মেনে নিতে পারেনি আর্চবিশপ সিরিল। তার উদ্দেশ্যই ছিল হাইপেশিয়ার সমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণ করা। কিন্তু সিরিল শেষ পর্যন্ত হাইপেশিয়াকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। তারই নির্দেশে ৪১৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চে এই গণিতজ্ঞকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় কেসারিয়াম চার্চে। সেখানে তারা হাইপেশিয়ার পোশাক খুলে নগ্ন করে ফেলে। ধারালো অস্ত্রে তার চামড়া তুলে মাংস চিরে দেয়। এভাবে তার মৃত্যু হলে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়।
হাইপেশিয়ার মৃত্যুর বেদনাঘন ঘটনা মনে করিয়ে দেয় বাংলা অঞ্চলের বিদুষী নারী খনার কথা। দুজনের খ্যাতিই ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল পিতৃতন্ত্রকে।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: সংগ্রহ