ফিচার I ব্রতচারী
সমাজ পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক জাগরণের লক্ষ্যে এই ধারণার উদ্ভব। যা হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পথ ও প্রেরণা। লিখেছেন মনোজ দেব
‘ব্রতচারী’ একটি শিক্ষা আন্দোলন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনীষী গুরুসদয় দত্তের ভূমিকা। ‘ব্রত’ শব্দের অর্থ কর্ম, পুণ্যলাভ বা ইষ্টলাভ, পাপক্ষয় প্রভৃতির জন্য অনুষ্ঠিত ধর্মকার্য, ধর্মানুষ্ঠান। এর সঙ্গে ‘চারী’ যোগে অর্থ দাঁড়িয়েছে ব্রত পালনকারী। কিন্তু গুরুসদয় দত্ত এটিকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘…এখানে যে ব্রতের কথা আমরা বুঝি, তা জীবনের যেকোনো একটি অভীষ্ট-সিদ্ধির ব্রত নয়। মানুষের জীবনকে সব দিক থেকে সকল প্রকারের সফল, সার্থক ও পূর্ণতাময় করে তোলবার অভীষ্ট নিয়ে যাঁরা ব্রত ধারণ করেন, ব্রতচারী বলতে আমরা এখানে তাঁদের কথাই বুঝব। এর চেয়ে বড় বা ব্যাপক অভীষ্ট সংসারে মানুষের হতে পারে না।’
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলার তরুণ ও যুবসমাজকে নিজের শক্তিতে বলীয়ান করে শুদ্ধাচারী হয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। যার রূপকার বা সংগঠক সিলেটের কৃতী ব্যক্তি গুরুসদয় দত্ত। ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সে সময়ের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়ি শহরে বাংলা অঞ্চলের জাতীয় নৃত্য-গীত শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ‘বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতি’। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত পরিশীলনে ব্রতচারী আন্দোলনের প্রয়াস প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এটির নাম হয় ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’। এর সদস্যরা অভিহিত হন ব্রতচারী নামে।
গুরুসদয় দত্ত আইসিএস অফিসার হলেও তিনি বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। স্বদেশ ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে তিনি বীরভূমের জেলা প্রশাসক থাকাকালীন সেখানকার বিলুপ্তপ্রায় ‘রায়বেঁশে নৃত্য’ পুনরাবিষ্কার করেন। তার আগে, ১৯২৯ সালে, তিনি ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকালে সেখানকার লোকনৃত্য, লোকগীতি সংরক্ষণ ও বিকাশে সংগঠন গড়ে তোলেন। এসব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ছান্দসিক সাধনার মধ্য দিয়ে শরীর, মন ও বাক্যকে আত্মার বশে আনার পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। এটিই মূলত ব্রতচারী।
এর মূল ব্রত পাঁচটি- জ্ঞানব্রত, শ্রমব্রত, সত্যব্রত, ঐক্যব্রত ও আনন্দব্রত। এ ছাড়া রয়েছে ষোলোটি প্রতিজ্ঞা ও সতেরোটি নিষেধ। এগুলো ছন্দোবদ্ধভাবে রচিত এবং নৃত্যের তালে তালে আবৃত্তির মাধ্যমে অনুশীলন করতে হয়। ব্রতচারীরা নিজেদের গড়ার পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মে মুক্তি খোঁজার অনুপ্রেরণা পায়। এটি মানুষের মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা ঘোষণা করে সব বিভেদ ভুলে মানবকল্যাণ এবং দেশের কাজে উদ্বুদ্ধ করে। আনন্দময়তার মধ্য দিয়ে জীবন গড়ার শিক্ষা দেয়।
এই আন্দোলনের কয়েকটি বৃত্ত রয়েছে। এগুলো মূলত বয়স ও নারী ব্রতচারী। ছোটদের ব্রতচারীর তিনটি পণ : ‘ছুটব খেলব হাসব/ সবায় ভালোবাসব/ আনন্দতে নাচব।’ শিশুর বিকাশের জন্য এর চাইতে গঠনমূলক আর কী হতে পারে? শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করা ব্রতচারীদের রয়েছে ওই তিনটিসহ বারোটি পণ। বাকি নয়টি হলো : ‘গুরুজনকে মানব/ লিখব পড়ব জানব/ জীবে দয়া দানব/ সত্য কথা বলব/ সত্য পথে চলব/ হাতে জিনিস গড়ব/ শক্ত শরীর করব/ দলের হয়ে লড়ব/ গায়ে খেতে বাঁচব।’ বয়স বাড়ার সঙ্গে ছোটদের দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া, চরিত্র গঠন, জীবে দয়া থেকে নিজের শরীর গঠন- সবই এই পণের মধ্যে রয়েছে। আর পূর্ণাঙ্গ বা বড় ব্রতচারীদের রয়েছে ষোলোটি পণ এবং সতেরোটি নিষেধ।
গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারীর যে আদর্শের কথা বলেছেন, তার দুটো মুখ। তার ভাষায়, ‘একটা হচ্ছে ব্যক্তিমুখ আর একটা সমাজ বা সমষ্টি মুখ।’ প্রথমটি হলো, ‘নিজের দিক দিয়ে নিজের জীবনকে অর্থাৎ চরিত্রকে, চিন্তাকে, কর্মকে ও দেহকে পূর্ণ করে’ তোলে। দ্বিতীয়টি ‘সমগ্র মানুষের দিক থেকে অর্থাৎ নিজের চিন্তা, কর্ম ও আচরণের দ্বারা অপর মানুষের জীবনকে, সফল, সার্থক ও পূর্ণতাময় করে তুলবার যে কর্তব্য, তা পালন করার চেষ্টা।’ এভাবে ‘সামাজিক সম্পর্কের সামগ্রিকতা’র এই বোধকে তিনি ধারণ করেছিলেন। সাত কোটি সন্তানকে ‘মানুষ’ না করে কেবল ‘বাঙালি’ করে রেখেছিল বলে রবীন্দ্রনাথ যেমন বঙ্গমাতার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, তেমনি গুরুসদয় দত্তও মনে করেছিলেন, শুধু ‘মানুষ’ নয়, ‘বিশ্বমানুষ’ হয়ে উঠতে হবে। সে জন্য তিনি ‘শাশ্বত বাঙালি’ হয়ে ওঠার কথা বলেছেন। অর্থাৎ আবহমান বাঙালির সদর্থক ঐতিহ্যকে চেতনা ও আচরণে ধারণ করা। মানুষ হয়ে ওঠার এই ব্রতই তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে, ‘মানুষ হ, মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ।… বিশ্ব মানব হবি যদি, শাশ্বত বাঙালি হ।’
মানুষ হয়ে ওঠার মূলমন্ত্র এখানে ‘কায়মনে বাঙালি’ হওয়া। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে বাঙালি ছাড়া অন্যদের কী হবে? উত্তরে বলা যায়, ব্রতচারী তো কেবল বাঙালির জন্যই। অন্য জাতির সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে কি? আসলে, প্রতিটি জাতির জনগোষ্ঠীরই জাতীয় ঐতিহ্যের মাটিতে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আত্মসমীক্ষণ ও আত্মগঠনে ব্রতী হওয়া দরকার। ব্রতচারী হবে বাঙালি থেকে শুরু করে এ দেশের চাকমা, মগ, মুরং, হাজং, কোচ, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, টিপরা, মুন্ডা প্রভৃতি গোত্র ও গোষ্ঠীর মানুষ। ষোলোটি পণ, সতেরোটি নিষেধ এবং কয়েকটি ‘প্রনীতি’ ও ‘প্রনিয়ম’ অনুশীলনের লক্ষ্যই হলো ‘মানুষ’, ব্যাপক অর্থে ‘বিশ্বমানুষ’ হয়ে ওঠা।
২
গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তন করলে ময়মনসিংহসহ টাঙ্গাইলেও এর অনুশীলন শুরু হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে শিল্পী কামরুল হাসান ঢাকায় ব্রতচারী ক্যাম্প ও দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান কচি-কাঁচার মেলার শিক্ষা শিবিরে এটির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। কামরুল হাসান এই আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার উডকাঠে করা ‘ব্রতচারী’ শীর্ষক শিল্পকর্মটিও তখন অনেক তরুণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা এর পরিচর্যা করে। তখন কচি-কাঁচার টাঙ্গাইল শাখাগুলোর মাধ্যমে এ জেলায়ও ব্রতচারীর প্রসার ঘটে এবং বেশ কয়েক বছর তার অনুশীলন চলে। ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত কচি-কাঁচার জাতীয় শিক্ষা অনুষ্ঠানে টাঙ্গাইল বৈশাখী মেলার সদস্যরা ব্রতচারীর ওপর প্রশিক্ষণ নেন। প্রায় দুশ জনের দল গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া এই অঞ্চলের পোড়াবাড়ি সূর্যমুখী মেলা, সয়াচাকতা অগ্রণী মেলা, করটিয়া মিতালি ও মৈত্রী মেলাসহ কয়েকটি শাখার উদ্যোগে চর্চা অব্যাহত ছিল। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই ধারাবাহিকতা আর বজায় থাকেনি। অথচ তা ছিল সমাজ, দেশ ও মানুষের স্বার্থেই আবশ্যকীয়।
তবে আশার কথা, দীর্ঘদিন পর ব্রতচারী আন্দোলনের চর্চা শুরু করেন ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক। তার প্রতিষ্ঠিত নালন্দা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এই অনুশীলন করানো হয়। এর বাইরেও কোথাও কোথাও ব্রতচারী চর্চার খবর মেলে; যেমন- ঢাকার তক্ষশীলা বিদ্যালয়, টাঙ্গাইলের সোনার তরী সাংস্কৃতিক স্কুল ও আনন্দ পাঠ শিশু বিকাশ বিদ্যালয়।
৩
সমাজ ও জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা নিয়েও ভেবেছিলেন গুরুসদয় দত্ত। তিনি মনে করেন, নারী ঘরের শক্তির উৎস। মাতৃজাতি শক্তিময়ী হলে সন্তানেরাও শক্তিমান হবে। বিশ্বসভায় স্থান করে নিতে হলে নারীকে সঙ্গে নিয়েই করা দরকার। নারীর কাজ হবে ঘর এবং বাইরের সমন্বয় করে দেশের সত্যিকারের মানুষ গড়ার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করা। তারা সব কুসংস্কারের গ-ি ভেঙে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে সমাজের অন্ধকার দূর করবে। তাদের লক্ষ্য হবে- দেশের সার্বিক উন্নতি, সুস্থ, স্বাস্থ্যবান, সংস্কৃতিপরায়ণ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টি করা, যারা আবার তাদের পাশে থেকে দেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করতে হয়ে উঠবে সহায়ক।
এটি কেবল গুরুসদয় দত্তের কথা ছিল না, কাজেও তিনি তার প্রমাণ রেখেছিলেন। স্ত্রী সরোজনলিনীর মৃত্যুর পর তার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সরোজনলিনী দত্ত নারী মঙ্গল সমিতি’। এখানে চালু হয় নারীর জন্য নানা রকম কাজের শিক্ষা। তাদের সেবা ও কর্মের মাধ্যমে দেশ এবং সমাজের কাজে ব্রতী হওয়ার প্রেরণা দিলেন তিনি। দুস্থ মেয়েদের যেন অন্যের ওপর নির্ভর করতে না হয়, সে জন্য তাদের বিভিন্ন কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন। শেখালেন ব্রতচারী।
৪
ভুলে গেলে চলবে না যে, গীত, নৃত্য ও বাদ্য ব্রতচারীর সাধনপন্থা মাত্র। এমনকি গীতনৃত্য প্রধান কৃত্যও নয়। অনেকে মনে করেছিলেন, এটা একটি বিশেষ ‘নৃত্যপদ্ধতি’। এ কারণে সে-সময় সরলা দেবী চৌধুরাণীকে বলতে হয়েছিল, ‘নৃত্য ব্রতচারী প্রগতির বাইরের শরীরটা মাত্র; তার ব্রতগুলো হচ্ছে তার ভিতরের আত্মা।’ বাংলায় শুরু হওয়া এই আত্মার শক্তিই একসময় গোটা ভারতবর্ষেই প্রভাব বিস্তার করেছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল। শোনা যায়, ইউরোপের কোনো কোনো দেশ গ্রহণ করেছে এই পদ্ধতি।
ছবি: ইন্টারনেট