skip to Main Content

এডিটরস কলাম I রুপালি শস্য

খাদ্যাভ্যাস দিয়েই বাঙালি অন্যান্য জাতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই পৃথকত্বের অনিবার্য একটি উপাদান হচ্ছে মাছ। তার পরিচয়জ্ঞাপক মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবাদ থেকে এটি সুস্পষ্ট

সংস্কৃতি চটজলদি কোনো বিষয় নয়। বহুদিনের জাতিগত অভ্যাসেই তা গড়ে ওঠে। এর ভিত্তি হলো অর্থনীতি ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জীবনধারা। আবহাওয়া, ভূপ্রকৃতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, সামষ্টিক আবেগ ইত্যাদি সংস্কৃতির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তবে জীবনধারা বদলে গেলে সংস্কৃতিও পাল্টে যায়। তবু ঐতিহ্যের কোনো কোনো উপাদান টিকে থাকে। বিশেষ দিনে সেগুলোর উপস্থিতি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। যেমন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে বিকশিত বাঙালির একসময়ের সকালই শুরু হতো রাতে পানিতে ভেজানো উদ্বৃত্ত ভাত বা‘পান্তা’নামের খাবার দিয়ে। সঙ্গে থাকত পেঁয়াজ-মরিচকুচি অথবা কোনো ভর্তা। বাসি তরকারিও থাকত। প্রযুক্তির বিস্তার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলের গ্রামীণ জীবন আর আগের মতো নেই। এ কারণে দিন শুরুর সেই খাবারটিও আজ প্রায় অপসৃত। কিন্তু বাংলা সনের প্রথম দিনে এটি ফিরে আসে। আমাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, একসময় এই অঞ্চলের জীবন কেমন ছিল। এটি তখন আর প্রতিদিনের সেই আহার থাকে না, উৎসবের প্রধান একটি অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। প্রতিভাত হয় উদ্যাপনের উপাদান হিসেবে। তবে নতুন রূপে। যদিও পরিবেশনে সেই মাটির সানকির উপস্থিতি আমরা দেখি।


নববর্ষ উদ্যাপনে বেশ কবছর ধরে শহুরেরা সকালের খাবারে পান্তার সঙ্গে নতুন একটি উপাদান যোগ করেছে। সেটি হলো ইলিশ, যেটি আগে কখনোই ছিল না। বরং ছিল টাকি মাছের ঝোল বা ভর্তা, শুঁটকিভর্তা, মলা-ঢেলা মাছের চচ্চড়ি। পান্তায় ইলিশের যুক্ত হওয়ার পেছনে নাগরিক সমাজ একটা যুক্তি দাঁড় করিয়েছে। তা এই- মাছটি বাঙালির জাতীয় ঐতিহ্যের পরিচয়বাহী একটি অনুষঙ্গ। উচ্চমাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ। কবি বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় ‘রুপালি শস্য’। সুস্বাদু এই মাছের দেখা মেলে না পৃথিবীর অন্য অঞ্চলে। পান্তার সঙ্গে ইলিশ যুক্ত হয়ে বছর শুরুর এই ভোজন উপভোগ্য হয়েছে শহুরে বাঙালির কাছে। ফলে বৈশাখ শুরুর দু-সপ্তাহ আগে থেকেই ইলিশের দাম নাগালের বাইরে চলে যায়। বলতে গেলে মধ্যবিত্তের সামর্থ্যরে সীমা অতিক্রম করে। যদিও সর্বত্র এটি পাওয়া যায়। কিন্তু এই ইলিশ মোটেও টাটকা নয়, বরং বেশ কয়েক মাস বরফে সংরক্ষণের পর সেটি বাজারে আসে। নববর্ষ উপলক্ষেই।


খাদ্যাভ্যাস দিয়েই বাঙালি অন্যান্য জাতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই পৃথকত্বের অনিবার্য একটি উপাদান হচ্ছে মাছ। তার পরিচয়জ্ঞাপক মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবাদ থেকে এটি সুস্পষ্ট।এই প্রবাদে মাছ বলতে কেবল ইলিশই বোঝানো হচ্ছে তা নয়। অন্যান্য মাছও রয়েছে। তবে এই খাদ্যসংস্কৃতি ক্রমেই ক্ষীণ হতে বসেছে। বিশেষত ইলিশ এখন আর আগের মতো সব অর্থনীতির মানুষের কাছে সহজলভ্য নয়। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, অপরিকল্পিত নদীশাসন, তলদেশে পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়া, প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলা, শুষ্ক মৌসুমে জেলেদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা না থাকা। ইলিশ ডিম পাড়ার উদ্দেশ্যে নদীর যতটা গভীরতায় চলাচল করে, সেই গতিপথও বদলে গেছে। তা ছাড়া অন্যান্য ঋতুতে মাছটি পেতে মুনাফালোভীরা অনেক সময় জাটকাও ধরে নির্বিচারে। মাতৃ ইলিশও রেহাই পায় না। ফলে পূর্ণাঙ্গ ও পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। যেমন কিছুদিন আগেও গোয়ালন্দ এবং কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সন্নিহিত এলাকায় পাওয়া যেত প্রচুর ইলিশ। এখন সেসব কেবলই গল্প। এতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। আমরা হারাচ্ছি এই রুপালি শস্য। অথচ ইলিশ রক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এখান থেকেই বাংলাদেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের চাহিদাও মেটানো যায়।


আগেই বলা হয়েছে, জীবনধারা পাল্টে গেলে সংস্কৃতিও বদলে যায়। তাতে তৈরি হয় নতুন এক ঐতিহ্যের সূচনামুখ। কিন্তু এই পরিবর্তন সবক্ষেত্রে সব সময়ের জন্য কি ইতিবাচক, কিংবা প্রীতিকর? পান্তার সঙ্গে ইলিশ যুক্ত হওয়ার নতুন শহুরে রীতিটি নিয়ে এমন প্রশ্ন আজকাল উঠছে। কেবল হিমায়িত এই মাছে অনেকেরই তৃপ্তি হচ্ছে না। টাটকা খাওয়ার আশায় তারা জাটকা বা অপরিণত ইলিশ পাতে তুলছে। এটা প্রতিরোধের জন্য আইন হচ্ছে বটে, কিন্তু তা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগের নজির কমই মিলছে। জনসচেতনতারও অভাব রয়েছে। একদিকে ইলিশ বিচরণের জলপ্রবাহ সংকুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে যে সীমিত জায়গাটুকু রয়েছে, তাতেও মাছটি রেহাই পাচ্ছে না। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য যত আইন হোক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত একে নিজের সম্পদ মনে না করব, ততক্ষণ এটি রক্ষা ও সংরক্ষণে আমরা মনোযোগী হব না।

ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top