ফিচার I চাপাটি ও সিপাহি বিদ্রোহ
ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই খাদ্যের আলাপ বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। সিপাহি বিদ্রোহের আগে এটি ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ব্রিটিশদের কাছেও ছিল রহস্যময়। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
১৮৫৭ সালের মার্চ। উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে সিপাহি জনতার বিদ্রোহ। কোম্পানির ডাক্তার গিলবার্ট হ্যাডো তার বোনকে চিঠি লিখলেন, ‘ভারতজুড়ে খুবই রহস্যময় একটা ঘটনা ঘটছে, এর অর্থ কেউই খুঁজে বের করতে পারছে না…কোথা থেকে এর শুরু হয়েছে, কারা করছে, আর উদ্দেশ্যই-বা কী…এটা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা কোনো গোপন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। ভারতীয় পত্রিকাগুলো নানা রকমের অনুমান করে চলেছে। এটাকে সবাই চাপাটি আন্দোলন বলছে।’
জে জি ফ্যারেলের বুকার বিজয়ী ‘দ্য সিজ অব কৃষ্ণপুর’ বইতে বলা হয়েছে, ‘১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষে কৃষ্ণপুর থেকেই প্রথম মোটা আটার তৈরি চাপাটির বিতরণের কথা জানা যায়, যার আকৃতি আর পুরুত্ব ছিল বিস্কুটের মতো। আর এটাই পুরো ভারতে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে।’
ট্রোজান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আপেল থেকে, ফরাসি বিপ্লব মারি আন্তুয়ানেতের কেক থেকে আর ভারতের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ চাপাটি দিয়ে।
যদিও কেউ এখন পর্যন্ত সিপাহি বিদ্রোহে চাপাটির ভূমিকা নিয়ে সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবে এর ভূমিকা যে একদমই ছিল না, তা বলা যাবে না। কারণ, অনেক প্রতিবেদনেই এর উল্লেখ রয়েছে। ১৮৫৭-র শুরু থেকে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা এই চাপাটি বিতরণের উল্লেখ করে এসেছেন, স্থানীয় প্রহরা-চৌকির পুলিশ বা চৌকিদারেরা উত্তর ভারতের গ্রামের পর গ্রাম রুটি বিলাচ্ছে বলে। স্থানীয়দের কাছে রুটি পৌঁছানোর পর, তারা আরও কিছু রুটি তৈরি করে পাশের বাড়ি পাঠাচ্ছে, এভাবে গ্রামের পর গ্রাম, পূর্ব থেকে পশ্চিমে চাপাটি সরবরাহ হয়ে চলেছিল।
উইলিয়াম ড্যালরিম্পল, দ্য লাস্ট মোগলে উল্লেখ করেছেন, উর্দু পত্রিকাগুলোতেও এই ঘটনার বিবরণ রয়েছে, তাই এটা কেবল ব্রিটিশদের কল্পনাপ্রসূত ভাবাটা ভুল হবে। ‘নূর-ই-মাগরিবি পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে ফেব্রুয়ারিতে বুলান্দশহরের কাছের গ্রামগুলোতে, মার্চের শুরুতে আগ্রার প্রধান সড়কে মথুরায় পৌঁছে গিয়েছিল বলে উল্লেখ রয়েছে।’ কিন্তু ড্যালরিম্পল বলেছেন, চাপাটিগুলোর গন্তব্য বিপ্লবের কেন্দ্র দিল্লিতে ছিল না, সেগুলো সেখানে পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি: ‘অনেকেই নিশ্চিতভাবে সেগুলোকে নাটকীয় উত্থানের সংকেত ভেবেছিল, যা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, কিন্তু তেমন কোনো প্রমাণ নেই যে সেগুলো দিল্লির মানুষের চেতনায় কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছিল।’
বিপ্লবের তেজ স্তিমিত হয়ে এলে চাপাটির গল্প ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ভয়ে কেঁপে ওঠা ব্রিটিশরা নিজেদের জৌলুশ বাড়াতে বলতে থাকে- জনতার এই উত্থান কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার ছিল না, এটা ছিল বাহাদুর শাহ জাফর ও তার অনুসারীদের পরিকল্পিত প্রচারণা। আর এই তত্ত্বে চাপাটি ও পদ্ম বেশ ভালোভাবেই মিলিয়ে দেওয়া যায়। জন কায়ের মতো ইতিহাসবিদেরাও এটাকে বিপ্লবের সংকেত বলেই মত দিয়েছেন, কিন্তু কেউ চূড়ান্তভাবে বলতে পারেননি কে এটা সংগঠিত করেছিলেন বা যখন বিদ্রোহ শেষ হলো এমন সংগঠন কোথায় হারিয়ে গেল।
প্রতীক হিসেবে চাপাটি আর পদ্ম উপেক্ষা করার মতো নয়, আর সেটা বিদ্রোহের গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়। পাল্প নভেলগুলোয় যাকে সোজা বাংলায় বাজারি উপন্যাসিকা বলা যেতে পারে, সেগুলোয় ‘চাপাটি রানার’ বা এটি বহনকারীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে জন মাস্টারের নাইটরানার্স অব বেঙ্গলের কথা বলা যেতে পারে। সেখানে বলা হচ্ছে ‘পশুপতি প্রথমে দুটো চাপাটি তৈরি করলেন, পূর্ব দিকে, একটায় যম আর অন্যটায় বরুণ…যখন আমি গ্রামের সীমানায় গিয়ে দাঁড়াই, তখন টহলদারকে ডাক দিই আর যখন সে আসে, বলে ‘পূর্ব দিক থেকে-উত্তরে, পশ্চিমে আর দক্ষিণে।’ তারপর আমি তাকে প্রথম চাপাটি পাঁচটি সমানভাগে ও দ্বিতীয়টি ১০টি সমান ভাগে বিভক্ত করে দিই।’
এই গল্প থেকে একটা অর্থ বের করা যায়, পঞ্চম মাসের দশম দিনের- ১০ মে, মিরাটে যখন সিপাহিরা বিদ্রোহ করেছিল প্রথমবারের মতো। এটা যদি আসলেই পরিকল্পিত হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই ভালো কৌশল ছিল আর অ্যামওয়ের বিভিন্ন স্তরে বিপণন কৌশলের আদিতম উদাহরণও হতে পারে। কিন্তু এই চাপাটির গল্পের কোনো প্রমাণই আমাদের হাতে নেই, বা মিরাটে বিদ্রোহের সময়ে যে এটা খুব পরিকল্পিত ছিল, তারও প্রমাণ মেলে না। প্রকৃতপক্ষে চাপাটি যদি আসলেই কিছু সে সময়ে করে থাকে, সেটা হলো ব্রিটিশদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া।
প্রথমে ‘সাদা নবাবদের’ সময়ে যখন কোম্পানির কর্মকর্তারা ভারতীয় রীতি-রেওয়াজ অনুসরণ করতেন, তখন তাদের এই রুটি-চাপাটি নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তারা আবারও পশ্চিমা ‘সাদা সাহেব’ হয়ে উঠলেন। ডেভিড বার্টন তার রাজ অ্যাট টেবিল বইয়ে লিখেছেন, ব্রিটিশরা এখন খুব কমই চাপাটি পছন্দ করে, ‘দুর্গতির সময়ে’ মফস্বল এলাকায় যেখানে ব্রিটিশ বেকারির অভাব রয়েছে, কেবল সেখানেই খাওয়া হয়। যখনই তারা এ ধরনের বেকারি শুরু করেছে, চাপাটি নির্বাসনে চলে গেছে প্রান্তজনের খাবারের টেবিলে, বিশেষত নার্সারিগুলোয় যেখানে আয়ারা বাচ্চাদের জন্য এটা বানাত। চাপাটির ওপরে মাখন আর চিনির প্রলেপ দিয়ে খাওয়া ছিল সকালের নাশতার জনপ্রিয় চল।
ভারতীয়দের চোখেও চাপাটির গুরুত্ব দ্বিধাবিভক্ত। উত্তর ভারতে সাধারণত এভাবেই খাওয়া হয় শস্যদানার গুঁড়া। খাবারের দস্তরখানের ঐতিহ্যে এখনো চাপাটি আভিজাত্যের ধারণা দেয়। ধর্মীয় রীতি আর নিবেদনে সব সময় চালের ব্যবহার দেখা যায়, রুটির নয়। এখান থেকে রুটি খাওয়ার প্রথা যে নিম্নবর্গীয়দের মধ্যেই কেবল ছিল, তার প্রমাণ মেলে। কেটি আচায়া দেখিয়েছেন, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে গমের চাষের বিবরণ থাকলেও কোনো দিন তা ধানের সমান মর্যাদায় উন্নীত হতে পারেনি। একই কথা প্রযোজ্য জোয়ার বা বাজরার মতো অন্যান্য শস্যের ক্ষেত্রেও, যেগুলো থেকে চাপাটি বা রুটি বানানো যেত। আমরা জানি, সেগুলো খানিক মোটা ধরনের হয়, আর তা কেবল দরিদ্ররাই খেত।
বিদ্রোহ যে দরিদ্র-নিম্নবর্ণের কৃষকেরাই পরিচালিত করেছিল, এই তত্ত্ব সেই মতবাদকে পোক্ত করে। আমাদের যদি আগে থেকে জানা না থাকত যে তারা ব্রাহ্মণ, বা নিজেরা নিজেদের উঁচু ভাবত, তার প্রমাণ মেলে গরুর চর্বি লাগানো কার্তুজের ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানানোর ভেতর দিয়ে। আবার রুটিতত্ত্বের আরেকটি দিক ভাবা যেতে পারে- চাপাটি ছিল জাতীয়তাবাদের প্রতীক, ইউরোপীয় ঘরানার রুটির মতো ইস্ট দিয়ে ফোলানো নয়। হতে পারে পুরোটাই স্রেফ কাকতাল, তখনকার বিদ্রোহের সঙ্গে লোকমুখেই গুজবের মতো এই খাদ্য জড়িয়ে গেছে।
ছবি: ইন্টারনেট