skip to Main Content

ফিচার I শাড়ির নামবৈচিত্র্য

সেলাইবিহীন পরিধেয় হিসেবে কেবল এই বস্ত্রটিই এখনো টিকে আছে। বিচিত্র পরিচয়, রঙ আর কারুকাজে। লিখেছেন মনীষা উজ্জয়িনী

সংস্কৃত ‘শটী’ থেকে শাড়ি শব্দের উদ্ভব। এই বস্ত্রের উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় পুরোনো লেখমালা, মূর্তি, বিগ্রহ, স্থাপত্য, পোড়ামাটির শিল্প এবং বিচ্ছিন্ন কিছু সাহিত্য-উপাদানে। যেমন চৌদ্দ শতকের গুরুত্বপূর্ণ কবি চণ্ডীদাসের কবিতায় রয়েছে শাড়ির উল্লেখ:

নীল শাড়ি মোহন কারী
উছলিতে দেখি পাশ।
কি আর পরানে সঁপিনু চরণে
দাস করি মনে আশ ॥

তবে শাড়ির আদি রূপও এক বা দুই খ- বস্ত্র। আকৃতি যেমনই হোক, এর নামেরও রয়েছে নানান বৈচিত্র্য। অযোধ্যার সীতাদেবী যে সূক্ষ্ম বস্ত্রটি পরতেন, তার নাম ‘অমুকা’। কৃষ্ণের সঙ্গে অভিসারে রাধার পরনে ছিল রুপালি জরিকাজের মেঘবরণ শাড়ি। কবি রাজশেখর এই বস্ত্রের নাম দিয়েছেন মেঘাম্বরী শাড়ি। তার নাটকের ভ্যাম্প বা খল চরিত্রের নারীরা পরেছে ‘অগ্নিপট্ট’। নাটকের উৎসব-দৃশ্যে সৎ নারীর পরনে ছিল সুদৃশ্য মনোজ-পুষ্প শাড়ি। এই কবির কাব্যনাট্যের নারী চরিত্রের পরিধেয়র নানা রকম নাম পাওয়া যায়। যেমন ময়ূরকণ্ঠী। এটি পরেছে তরুণী রানি। রামধনু রঙ শাড়ির নাম ধনুশ্রী। সাদা শাড়ির নাম রাজবেলি। হংস বলাকার ছবি আছে- এমন শাড়ির নাম হংসলক্ষ্মী।
আর সি মজুমদার ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ বইতে জানিয়েছেন, অর্থশাস্ত্রবিদ কৌটিল্যের সময়ে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমলে চার রকমের শাড়ি তৈরি হতো- দুকূলা, কুসুম, কার্পাসিকা, পত্রোনা। এসবের বেশির ভাগই তৈরি হতো উত্তরবঙ্গ, বিক্রমপুর, সিলেট ও আসাম অঞ্চলে।
প্রাচীনকালের নারীরা বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও অনুষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন শাড়ি পরত। সেসবের নামের বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। যেমন প্রথম মা হলে বা হতে গেলে পরিবার অথবা প্রিয়জন শাড়ি উপহার দিতেন। তার নাম অধ্যয়া। রং লাল। প্রথম সন্তানসম্ভবা নারী বা প্রথম সন্তাবতীকে এই বস্ত্র দেওয়ার রেওয়াজ আজও আছে তবে তার জন্য কোনো নাম বা রং নির্ধারিত নেই। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিধেয় ছিল নীল পাড়ের হলুদ শাড়ি। এর নাম ব্রশতী। স্বামী তীর্থধর্ম সেরে ফিরলে তার সম্মানে উৎসব হতো, তাতে স্ত্রী বীরাঞ্জলি নামের এক বিশেষ ধরনের শাড়ি পরত। পদ্মলতা শাড়ি পরত কেবল বিবাহিতরাই। নতুন স্ত্রীকে পরানো হতো দুমাথাওয়ালা মাছ ও ফুলের নকশা-তোলা মৎস্য-পুষ্প শাড়ি। এখনো বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে মাছ-ফুল আঁকা নকশা মঙ্গলচিহ্নের স্মারক।
আরও কিছু শাড়ির নাম উল্লেখ করেছেন কবি জসীমউদ্দীন। তার ‘পূর্ববঙ্গের নক্সী কাঁথা ও শাড়ি’ প্রবন্ধে ময়মনসিংহ অঞ্চলে গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকে প্রচলিত এসব বস্ত্রের নাম হলো কাদিরের শাড়ি, জামের শাড়ি, ফরাসি শাড়ি, লক্ষ্মীবিলাস, কৃষ্ণ নীলাম্বরী, সোনাঝুরি, মধুমালা, কলমীলতা, গোলাপ ফুল, কুসুম ফুল, রাসমঙ্গল, জলে-ভাসা, এক-পাছুল্লা, কাচ পাইড়, কালপিন, গাল পাইড়, কুনারি, বাঁশি পাইড়, চোদ্দরসী, কাঁকড়ার ছোপ, আয়না ফোঁটা ইত্যাদি। প্রবন্ধটিতে কবির সংগৃহীত ওতলা সুন্দরীর পালাগানেও রয়েছে কিছু শাড়ির নাম। যেমন রাজকন্যাকে বিয়ের সময় তার সখীরা বস্ত্রটি পরাচ্ছে:

প্রথমে পরলি শাড়ি, পিনল বড় ঠাটে
নীমা শামের কালে যেমন সূর্য বইল পাটে।
এ শাড়ি পরিয়া কন্যা শাড়ির পানে চায়।
মনমত না হইলে দাসীকে পিন্দায়।
তারপরে পরিল শাড়ি নামে গঙ্গাজল
হাতের উপর থইলে শাড়ি করে টলমল।

এ ছাড়া দুতি বা হিয়া নামের শাড়ির উল্লেখও এই পালায় রয়েছে। বস্ত্রটি সুতি, সিল্ক, সিনথেটিক ইত্যাদি টেক্সচারের সঙ্গে রং ও নক্সার বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। পাড়ে, জমিনে, আঁচলে কারুকাজের ধরনের জন্য পরিধেয়টির স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। এসব কাজের উপকরণের বিভিন্নতাও রয়েছে- সুতা, জরি, চুমকি, কাচ, পুঁথি ইত্যাদি শাড়ির বিকাশ ও বিন্যাসে এখন আরও নতুন হয়ে উঠছে। ডিজাইনার এবং এলাকাভেদেও নকশা বা উপকরণের বিভিন্নতা দেখা যায়। রয়েছে নামেরও আলাদা বিশেষত্ব। যেমন- কাতান: মিরপুরী, ববি, পাল্লু, ব্রোকেট, ফিগার, ডিনার, বাঁশ, বার্মিজ, সাইমন, ইরানি, টিস্যু কাতান। আবার সিল্ক : রাজশাহী, স্ক্রিনপ্রিন্ট, ওয়ার্প প্রিন্ট, বেনারসি, টাঙ্গাইল, গাজি, কাঞ্চু, জামদানি, শিবগঞ্জ সিল্ক, ঠাকুরগাঁও সিল্ক, পেপার সিল্ক ইত্যাদি। এ ছাড়া টিস্যু বেনারসি, টিস্যু কোটা, টাঙ্গাইল তাঁত, আমেরিকান জর্জেট, ফ্রেঞ্চ জর্জেট, উলি শিফন, স্কিস ফোর কোর, রূপায়ণ, সলিড গোল্ড, শোলে জর্জেট, শ্রী দেবী, পদ্মিনী কোলাপুরী, সিলসিলা, ক্লিওপেট্রা, অর্গেঞ্জা, যোশী নীলাকাশ, মেঘদূত, লেডি হ্যামিলটন, সেনে ডলার, ধনেখালি, ঢাকাই ভিটি, ব্লক, ব্রাশ প্রিন্ট, মণিহার, সুজনসখী, আনারকলি, ডাই মসলিন, মিরপুর তানচুই, ঢাকেশ^রী, রাজশাহী গরদ, তসর ইত্যাদি।
দেখা যাচ্ছে, শাড়ির এসব নাম কখনো অঞ্চল এমনকি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় তারকা এবং ব্যবসা সফল সিনেমার নামানুসারেও রাখা হয়েছে।
শাড়ির এসব নামকরণে সমকালীনতার ছোঁয়া আছে। উপকরণ, ডিজাইন, রং এবং বিন্যাসেও এসেছে বৈচিত্র্য। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আধুনিক হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়াতে আগেকার সেই কাব্যিক নামগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে বা গেছে। যেমন- হংসমিথুন, অগ্নিপট্ট, মেঘডুমুর, বলাকা, ধনুশ্রী, পদ্মাবতী, গঙ্গাজলী ইত্যাদি।
শাড়ির নামের এই বিবর্তনের ধারা সময়, মূল্যবোধ ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক। আগে শাড়ির নামে উদ্দেশ্যের প্রতিফলন থাকত, এখন তা আর নেই। তাই নামের মাধুর্যে এই পরিধেয়র সুন্দরতর ও বিশেষভাবে চিহ্নিত করার ইচ্ছাটাও চলে গেছে। তবে, এটা ঠিক যে, কিছু আনুষ্ঠানিকতা মেনে শাড়ির বিশেষ রং ও ধরনের বস্ত্রের ব্যবহার ফিরে এসেছে। যেমন গায়েহলুদ, একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা ফাল্গুন ও বৈশাখ। যদিও বিয়েতে নির্দিষ্ট রঙের শাড়ি পরার কোনো নিয়ম নেই, বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা সেখানে রয়েছে। তবে লক্ষ থাকে পরিধেয়টি যেন জমকালো নকশার হয়। একটা সময় বিয়ের শাড়ি মানেই ছিল টিস্যু, কাতান, জামদানি, বেনারসি, শিফনের ওপর ঘন জরির কাজ। এখন কনের জন্য চিরায়ত ‘বেনারসি’ও অপরিহার্য নয়। অবশ্য কাতান বা বেনারসির আধিপত্য এখনো টিকে আছে। আগের সেই ভারী কাপড়ের পরিবর্তে সেসবের স্থান দখল করেছে ওজনে হালকা, বৈচিত্র্যময় রং এবং সমকালীন নকশার নানান শাড়ি। সেখানে সুতি থেকে নেটের কাপড়ও প্রাধান্য পাচ্ছে। উপাদান যা-ই হোক, উজ্জ্বল রং আর জাঁকালো কারুকাজ থাকলেই হয়।

মডেল: মাহি, আনসা
মেকওভার: পারসোনা
জুয়েলারি: রঙবতী
শাড়ি: মাহমুদা শাড়ি হাউজ
ছবি: জিয়া উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top