ফিচার I অগ্নি-উৎসব
আবিষ্কারের পর থেকেই আগুন আর ত্রাতা মানুষের কাছে সমার্থক হয়ে উঠেছিল। ফলে একে ঘিরে বিকশিত হয়েছিল তার পূজা-প্রার্থনা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকা-। লিখেছেন মনোজ দেব
মানুষের আদিম অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছিল আগুন আবিষ্কার। তারপর সেটি খাদ্য প্রস্তুত, শীত নিবারণসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন পার্বণ ও উৎসব উপলক্ষে মানুষ আগুন জ্বালিয়েছে। অগ্নির চারপাশে তারা নাচে, লাফায়। এসব পার্বণের প্রাচীনতম দৃষ্টান্তের উল্লেখ রয়েছে অষ্টম শতাব্দীতে খ্রিস্টান যাজক সভার বৃত্তান্তে। কৃষিসমাজে অগ্নি-উৎসবের বিষয়টি ছিল। তা ছাড়া অগ্নিকুন্ডে কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর চল ছিল, এমনকি তখন জ্যান্ত মানুষ দাহ করার ভানও করা হতো। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শবদেহ পুড়িয়ে সৎকারের রীতি তো রয়েছেই। একসময় সতীদাহ ছিল ভারতবর্ষে। কিন্তু তা উৎসব নয়, ধর্মীয় অনুশাসন বা সংস্কৃতির অংশ। তবে অতীতে জ্যান্ত মানুষ পোড়ানোর আনুষ্ঠানিকতার কিছু প্রমাণও কোথাও কোথাও মিলেছে।
সাধারণত বসন্ত বা মধ্য-গ্রীষ্মকালে বহ্ন্যুৎসব হতো। কোথাও আবার শরৎ শেষে অথবা শীতেও, বিশেষ করে হ্যালো ইভনে, ক্রিসমাসে এবং টুয়ালফথ ডে-র সন্ধ্যাকালে। বসন্তের অগ্নি-উৎসবটি সাধারণত লেন্ট পর্বের প্রথম রোববার অনুষ্ঠিত হয়, ইস্টার সন্ধ্যায়।
লেন্ট পর্বে বহ্ন্যুৎসবের প্রথা চালু আছে বেলজিয়াম, উত্তর ফ্রান্স ও জার্মানির বেশ কিছু অঞ্চলে। বেলজিয়ামের আর্ডেন মালভূমিতে যেমন বলা হয় ‘মহাবহ্নির দিন’। এর এক সপ্তাহ বা পনেরো দিন আগে কিশোর-কিশোরীরা খামারে ঘুরে ঘুরে জ্বালানি সংগ্রহ করে। গ্র্যান্ড হ্যালিউর সময় কেউ যদি তাদের অনুরোধ না রাখে, তাহলে পরদিন বাচ্চারা সেই বাড়িতে গিয়ে নিভন্ত চুলার ছাই ও কয়লা দিয়ে তার মুখ কালো করে দেয়। দিনটি উদ্যাপনের জন্য তারা ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করে, সেসবও জ্বালানো হয় পাহাড়ে পাহাড়ে। প্রচলিত আছে, দাবানল থেকে গ্রামকে বাঁচাতে চাইলে অন্তত সাতটি বহ্ন্যুৎসব দরকার। গ্রান্ড হ্যালিউ উৎসবে একটি বাঁশ পোঁতা হয়, যার নাম মাকরাল বা ডাকিনী। তাতে সদ্য বিবাহিত কোনো ব্যক্তি আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মোরলান ওয়েলজের পাশর্^বর্তী অঞ্চলে খড়মানবকে পোড়ানো হয়। আর তরুণ-তরুণী-শিশুরা অগ্নিকুন্ড ঘিরে নাচে, গান করে এবং জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে লাফায়।
ফরাসি আর্ডেনেসে গ্রামবাসী গনগনে আগুন ঘিরে নাচত ও গাইত। এখানেও গ্রামের যে নারী বা পুরুষ সবে শেষে বিয়ে করেছে, তাকেই মশাল জ্বালতে হতো। এই রীতি সেখানে আজও কিছুমাত্রায় প্রচলিত আছে। একসময় ওই আগুনে জ্যান্ত বিড়াল পুড়িয়ে হত্যা করার চল ছিল। তখন রাখালেরা তাদের গবাদিপশু নিয়ে বিড়াল পোড়ানোর ধোঁয়া আর অগ্নিশিখার পাশ দিয়ে চলাচল করত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে গৃহপালিত পশু রোগবালাই ও জাদুমন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে।
দক্ষিণ মধ্য ফ্রান্সের অভার্ন অঞ্চলে প্রতিটি গ্রামে এই দিন আগুন জ্বালানোর রীতি ছিল। উঁচু ভূখন্ডে, নিচু উপত্যকায় সেখানকার লোকেরা মশাল জ্বালিয়ে সেটি হাতে নিয়ে ছুটে বেড়াত জমিনে, ফলের বাগানে। গানে গানে তারা প্রার্থনা করত ভালো ফসল ও ফল উৎপাদনের জন্য। তাদের বিশ্বাস ছিল মশালের ছাই যেখানে পড়বে, সেই ক্ষেত ও বাগান শস্য এবং ফলে হয়ে উঠবে ভরপুর। এমনকি তারা মুরগির খোপেও দিত মশালের ছাই। মনে করা হতো, এতে মুরগি সারা বছর ডিম দেবে। তারপর তারা বাড়ি ফিরে ভূরিভোজ করত।
জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডেও প্রায় একই রীতি প্রচলিত ছিল। জার্মানির কোনো কোনো গ্রামের লোকেরা এই উৎসব উপলক্ষে খড়বিচালির বিশাল একটি চাকা বানাত। সেটি তিনটা ঘোড়ায় টেনে নিয়ে যেত পাহাড়ের ওপর। তারপর রাতে গ্রামের লোকেরা চাকায় আগুন ধরিয়ে গড়িয়ে দিত পাহাড়ের ঢালে। লুক্সেমবার্গের এখটারনাকে এই উৎসবের নাম ডাকিনী দহন। আবার টাইরলের ভোরালবার্গে লেন্টের প্রথম রোববার একটি কচি চিকন ফারগাছের চারধারে খড়বিচালি ও জ্বালানি কাঠ রাখা হতো। গাছটির মাথায় টাঙানো হতো মানুষের মূর্তি। যাকে বলে ডাকিনী। মূর্তিটি তৈরি করা হতো পুরোনো কাপড়ে আর ভেতরে ঠাসা থাকত বারুদ। রাতে সেই গাছে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে সকলে নাচ-গান করার রীতি ছিল। ডাকিনী যখন পুড়ছে তখন সবাই কাঠের তৈরি একটা জ্বলন্ত চাকা শূন্যে ছুড়ে দিত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে অশুভ আত্মা বা ডাকিনীর খারাপ প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।
সুইজারল্যান্ডেও পালিত হতো ডাকিনী হত্যার উৎসব। এতে ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঠ ও খড়বিচালি সংগ্রহ করত। তারপর সেগুলো কোনো পাহাড় বা টিলার ওপর পুঁতে রাখা খুঁটির চারপাশে জড়ো করা হতো। খুঁটিতে আটকানো থাকত একটি কুশপুতুল বা ডাকিনী। সন্ধ্যার পর তাতে আগুন ধরিয়ে নাচত, কেউ সপাং সপাং চাবুক পেটা করত, ঘণ্টি বাজাত। আগুন নিস্তেজ হয়ে এলে চলত লাফালাফি। কোনো অঞ্চলে একটা চাকায় কাঁটালতা জড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে দেওয়ার রীতি ছিল। যত বেশি অগ্নিবলয়, আগামী বছরে সাফল্যের সম্ভাবনা তত। এই ছিল তাদের বিশ্বাস।
অগ্নি-উৎসবের আরেকটি পর্ব পালিত হয় ইস্টার সানডের আগের দিন। ক্যাথলিক দেশগুলোতে এই রীতি অনুসারে সেদিন গির্জার সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। পরে চকমকি পাথর ঠুকে, লোহা ঘষে অথবা আতশি কাচ দিয়ে আগুন জ্বালানোর নিয়ম। এই বহ্ন্যুৎসবে খ্রিষ্টের পুনরভ্যুদয়ের বা ইস্টার মোমবাতি জ্বালানো হয়। সেটি থেকেই প্রজ্বলিত করার রীতি অন্য সব মোম। জার্মানির অনেক অঞ্চলে লোকেরা চার্চের আশপাশে উন্মুক্ত স্থানে ওক, আখরোট এবং বিচগাছের লাঠি সংগ্রহ করে সেগুলো আগুনে পোড়ায়। পরে সেসব অর্ধদগ্ধ কাঠি বাড়িতে নিয়ে নতুন আগুন জ্বালানো হয়। সঙ্গে থাকে প্রার্থনা- যেন ঈশ্বর অগ্নিকান্ড, বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি থেকে বাড়ি রক্ষা করে। আবার জমিতে বা বাগানেও সেগুলো রাখা হয় ফসলের ভালো উৎপাদনের আশায়।
কোনো অঞ্চলের লোকের বিশ্বাস ছিল, যতদূর ইস্টার বহ্ন্যুৎসব দেখা যাবে, ততটা এলাকা সারা বছরই শস্য ভালো জন্মাবে এবং অগ্নিকান্ড ঘটবে না। হার্জ পার্বত্য অঞ্চলে একটি গ্রাম ব্রাউনরোড, সেখানে ইস্টার আগুনে কাঠবিড়ালি পোড়ানো হতো। উত্তর ফ্রাঙ্কেনের কোনো কোনো গ্রামে খড়ের তৈরি মানুষকে বলা হতো ‘জুডাস’। সেটি গির্জা প্রাঙ্গণে জ্বালিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল। মূর্তি পোড়ানো কাঠের জোগান দিত সারা গ্রামের মানুষ। পরে তারা পোড়া কাঠগুলো জমিতে পুঁতে দিত, যেন ক্ষেতের গম ও অন্যান্য শস্য পোকামাকড় এবং ছত্রাকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
স্কটল্যান্ডের সেন্ট্রাল হাইল্যান্ডসের অগ্নি-উৎসবকে বলা হয় বেলটেন হোমাগ্নি। ১ মে পালিত এই পর্বে সেখানে নরবলি দেওয়ার প্রমাণও মিলেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও ওই বহ্ন্যুৎসব অনেক অঞ্চলে টিকে ছিল। এর বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় জন রামসের লেখায়। পশ্চিম পার্থশায়ারের যাজকপল্লি কালান্ডারে ওই শতকের শেষ দিকেও বেলটেন উৎসব পালন করা হতো। সেখানকার জনৈক যাজকের বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, এই অমানবিক উৎসর্গ সেই দেশ এবং পূর্বাঞ্চলেও চালু ছিল।
এখন আর মানুষ উৎসর্গ করা হয় না। তবে কোথাও কোথাও চালু আছে অগ্নি-উৎসব, ভিন্ন আঙ্গিকে। যেমন পৃথিবীজুড়েই আছে কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর রীতি। রাজনৈতিক অসন্তোষ বা সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে শোষকের মূর্তি পোড়ানো হয়। তা তৈরির রীতিও আগেরই মতো। খড় দিয়ে শত্রুর অবয়ব বানিয়ে পুরোনো কাপড়ে ঢেকে তা অগ্নিদগ্ধ করার মধ্য দিয়ে জানানো হয় প্রতিবাদ। এ সময় স্লোগান দিয়ে অথবা গানে গানে শোষকের ধ্বংস কামনা করা হয়। আগেই বলা হয়েছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভারতবর্ষে একসময় ছিল সতীদাহ প্রথা। মৃত স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় তুলে দেওয়া হতো জীবিত স্ত্রীকে। গনগনে আগুনে পুড়িয়ে মারার এই ধর্মীয় আচার বন্ধ হয়েছে। তবে এই সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বণে আগুনের ভূমিকা রয়েছে। এখনো চালু আছে অগ্নিপূজা। এর মধ্য দিয়ে সব অশুভ বিনাশের প্রার্থনা জানানো হয়।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বিহারের চত্বর বা কেয়াংয়ে সন্ধ্যায় হাজার প্রদীপ জে¦লে প্রার্থনা করে। এটি অনুষ্ঠিত হয় বছরের বিশেষ দিনে। যেমন পয়লা বৈশাখ, ক্রিসমাস বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিবস উপলক্ষে। এ সময় তারা প্রজ্বলিত প্রদীপ দুই হাতের তালুর মাঝখানে রেখে উঁচু করে ধরে। তারপর হাঁটু ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রোগব্যাধি থেকে মুক্ত হওয়া এবং বিশেষ স্বপ্ন পূরণের জন্য আরাধনা করে।
মধ্যগ্রীষ্মের সন্ধ্যায় বহ্ন্যুৎসব উত্তর আফ্রিকা, মরক্কো ও আলজেরিয়ার মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত। বার্বার এবং বহু আরব জাতি বাড়ির উঠানে, চৌরাস্তার মোড়ে, ফসলের ক্ষেতে অথবা শস্য মাড়াইয়ের স্থানে আগুন জ্বালায়। যেসব গাছগাছালি পোড়ালে প্রচুর সুগন্ধি ধোঁয়া হয়, সেসবই এতে ব্যবহৃত হয়। যেমন- পুদিনা, ব্রাহ্মিকা, মৌরি, ক্যামোমিল, জেরানিয়াম ইত্যাদি। বয়স্করা এবং তাদের শিশুরা নিজেদের এই ধোঁয়ায় অভ্যস্ত করে তোলে। তাদের বিশ্বাস, এতে ফসলের উৎপাদন বাড়বে, বালামুসিবত থেকে তারা রক্ষা পাবে; এমনকি এই ছাই এঁটেল মাটির সঙ্গে মিশিয়ে মাথায় মাখলে চুল ঝরে পড়া বন্ধ হবে।
ছবি: ইন্টারনেট