ফিচার I মুদ্রাবৃত্তান্ত
প্রাচীন সেই মন্দিরের শিকেল থেকে একালের ক্রিপ্টোকারেন্সি। দীর্ঘ এই পরিক্রমায় দ্বিধা, অবিশ্বাস আর রূপান্তরের গল্প। জানাচ্ছেন শিবলী আহমেদ
সুমেরীয় অঞ্চলের উর্বরতার দেবী ইশতারের মন্দিরে গমচাষিদের ঢল। তারা একে একে এসে উদ্বৃত্ত শস্য মেপে জমা করেছে প্রার্থনালয়ের গুদামে। সঞ্চিত ফসল যাজকদের জীবনধারণে প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাবে। পাশাপাশি দুর্দিনে আর্তমানুষের সহায়তায় কাজে লাগবে। মন্দিরে গম জমা করার বিনিময়ে চাষিরা পাচ্ছেন ব্রোঞ্জের ছোট ছোট টুকরা। পয়সাকৃতির। যেটির এক পাশে গম, যব কিংবা বার্লির চিহ্ন। অপর পাশে ইশতার দেবীর প্রতিকৃতি। এমন দৃশ্য দেখা যেত ৩০০০-৩৫০০ বছর আগে। ইশতার মন্দির থেকে দেওয়া ওই ধরনের ধাতব টুকরাগুলো আজকের দিনে সুমেরীয় ব্রোঞ্জ কারেন্সি নামে পরিচিত। তৎকালে সেই অঞ্চলের মানুষ সেটিকে ‘শিকেল’ নামে ডাকত। ‘শি’ মানে গম এবং ‘কেল’ হলো এক বুশেল পরিমাণ গম। অর্থাৎ, মন্দিরে এক বুশেল গম দিলে চাষিরা পেতেন এক শিকেল। কিন্তু কী হবে তা দিয়ে? শিকেল এক প্রকার ‘কারেন্সি’, মানে মুদ্রা; আবার ‘রেওয়াজ’ও। শিকেল যতটা না মুদ্রা হয়ে উঠেছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল রেওয়াজ। কেননা, সেটি দিয়ে শুরুতে অন্য দ্রব্য কেনা যেত না। তবে উর্বরতা-দেবী ইশতারের মন্দিরে থাকা বেশ্যাদের সঙ্গে সঙ্গম করা যেত। মানে শিকেল ছিল যৌনমিলনের টিকিট। মন্দিরের গণিকাদের মনে করা হতো উর্বরতা-দেবীর প্রতিনিধি। তাদের সঙ্গে সঙ্গম কেবল মনোরঞ্জনই নয়, সেকালের জাদুবিশ্বাসে তা ছিল ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গণিকাদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে না গেলে চাষের জমিটি উর্বরতা হারাবে বলে মানা হতো। ফলে ফসল উৎপাদনে ওই সঙ্গম ছিল জরুরি। সেটাই রেওয়াজ। যেটির সঙ্গে যুক্ত ছিল শিকেল কারেন্সি। অবশ্য এমনও হতে পারে যে সেই ব্রোঞ্জখন্ডের ‘মুদ্রা’ স্বীকৃতও ছিল। কেননা, সেমিটিকদের নবী ইউসুফকে তার ভাইয়েরা দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল ২০ শিকেলের বিনিময়ে। মানে দাস বেচাকেনাতেও তা ব্যবহৃত হতো। তবে শিকেলের মুদ্রামান ছিল কি না, সেসব বিষয় বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। ধারণা করা হয়, শিকেলই হচ্ছে বর্তমান মুদ্রার আদি রূপ। আবার যিশুর জন্মের ছয় শতক আগে যে লিডিয়ান মুদ্রার প্রচলন ঘটেছিল, এখনকার মুদ্রাকে সেটিরই উন্নত ও পরিবর্তিত ধাপ মনে করেন অনেকে। এশিয়া মাইনরে উদ্ভূত লিডিয়ান মুদ্রা ধীরে ধীরে ইউরোপের প্রায় পুরোটা, ভূমধ্যসাগর অঞ্চল ও এশিয়ার নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অতীতে চীনেও ভিন্ন ধারার একধরনের মুদ্রার প্রচলন ঘটেছিল। তা ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য জনপদের মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মুদ্রা আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করেছিল। কিন্তু তারা পুরোপুরি তা গ্রহণ করেনি। সেগুলোর প্রচলন ঘটতে সময় লেগেছিল যুগ-যুগান্তর। যেমন প্রাচীন গ্রিসের স্পার্টা। মুদ্রা থাকলেও সেখানে দীর্ঘকাল তা প্রচলিত হতে পারেনি। পারস্য সভ্যতায়ও কিছু অঞ্চলে মুদ্রার ব্যবহার ছিল সীমিত। মিসর, সুমের ও হরপ্পায় প্রচলন না থাকলেও কিছু মুদ্রা উদ্ভাবিত হয়েছিল সেখানে। তা ছাড়া ধাতব টুকরার ওপর এটা-সেটার প্রতিকৃতি খোদাই করলেই তা মুদ্রা বলে গণ্য হতো না। এখনো হয় না। বিশেষ ধরনের ধাতব খন্ডের উপযুক্ত বিশুদ্ধি ও সুনির্দিষ্ট তৌলরীতির বিপরীতে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি থাকলে তাকে মুদ্রা বলে ধরে নেওয়া যায়। এ ধরনের শর্তের মারপ্যাঁচেই বিশ্ব ইতিহাসে মুদ্রার প্রচলন হতে সময় লেগেছে কয়েক হাজার বছর।
মুদ্রা উদ্ভাবনের কী প্রয়োজন ছিল? এর আগে বিনিময় প্রথায় কী এমন সমস্যা ছিল? মূলত বিনিময়ের মাধ্যমে চাহিদার সরল জোগান মিলত না। ধরা যাক, একজন তাঁতির কাছে কাপড় আছে। তার দরকার ধান। তিনি নিশ্চয়ই চাষির কাছে যাবেন। কিন্তু কৃষকের কাছে যে ধান আছে, তিনি সেটির বিনিময়ে কাপড় নয় বরং জুতা চান। আবার মুচির হয়তো তখন ধানের দরকারই নেই। তার প্রয়োজন চামড়া। ফলে দ্রব্য থাকলেই বিনিময় প্রথার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত উপাদানটি সংগ্রহ করা যেত না। সে জন্য একের চাহিদার সঙ্গে অন্যের জোগান মিলতে হতো। তা মেলানো এত সহজ ছিল না। এ ছাড়া দক্ষতার একটি সমাদর গড়ে উঠেছিল সমাজে। অভিজ্ঞ কুমারের গড়া হাঁড়ির সঙ্গে অর্বাচীনের তৈরি হাঁড়ির পার্থক্য থাকে। একই রকমের ফারাক থাকে দক্ষ ও অদক্ষ কামারের গড়া কুড়ালে। তো, অভিজ্ঞ কুমারের হাঁড়ি পেতে হলে দক্ষ কামার কয়টি কুড়াল বিনিময় করবে? কিংবা দক্ষ কামার থেকে কুড়াল নিতে হলে অর্বাচীন কুমার কয়টি হাঁড়ি দেবে? সেকালে এসব সমস্যার সমাধান মেলেনি। ফলে বিনিময় প্রথার জটিল সমীকরণের একপর্যায়ে এসে দেখা যায়, প্রচলিত এই পদ্ধতি সামাজিক অর্থনীতির অনেক জটিলতা সমাধানে পুরোপুরি ব্যর্থ। ঠিক তখনই উপযুক্ত বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু সেটি তৈরিতে ধাতুই কেন?
শুরুতে মুদ্রার ওপর মানুষের ন্যূনতম বিশ্বাস ছিল না। ফলে তা তৈরিতে এমন ধাতু ব্যবহৃত হতো, যেগুলোর বস্তুমূল্যও আছে। সে কারণেই মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহৃত হতো সোনা-রুপার মতো মূল্যবান সব উপাদান। এতে মানুষের মধ্যে সেটি গ্রহণের দ্বিধা দূর হয়। এরপর লোকজন যখন সেসবের বিনিময়ে পণ্য পেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তখন সেটির ওপর ‘বিশ্বাস’-এর প্রলেপ পড়ে। ফলে তা আর মূল্যবান ধাতু নির্মিত না হলেও চলত। বিশ্বাসের একপর্যায়ে এক টুকরা মূল্যহীন নকশি কাগজই হয়ে ওঠে মুদ্রা। যেটিকে বাঙালিরা টাকা বলে। এ জন্যই হয়তো ইসরায়েলি ইতিহাসবেত্তা ইউভাল নোয়া হারারি মত দিয়েছেন, ‘বিশ্বাসকে বস্তুতে পরিণত করে মুদ্রা’।
এবার আমাদের অঞ্চলের মুদ্রার বয়ানে আসা যাক। এখানকার বেশ কিছু অঞ্চলে এটির প্রচলন ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৬ অব্দে। বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রাগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৬-৪ অব্দের দিকে খোদাই করা হয়েছিল বলে সম্প্রতি দাবি উঠেছে। মহাস্থানগড় থেকে পাওয়া ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা যাচাই করে বাংলায় এর প্রাচীনত্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩ অব্দে। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রাচীন দলিল হচ্ছে মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপি। সেখানে গন্ডক ও কাকনিক নামে দুই ধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির মুদ্রার কথা উল্লেখ রয়েছে। যদিও কেউ কেউ মনে করেন, ওই বস্তুদ্বয় আসলে কোনো মুদ্রাই নয়; তা বিশেষ ধরনের কড়ি। বাংলায় স্বর্ণমুদ্রার সূচনাপর্ব হিসেবে কুষাণ যুগকেই ভাবা হয়। যদিও প্রাচীনবঙ্গ সরাসরি কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবু বাংলাদেশসহ পুরো ভারত উপমহাদেশেই স্বর্ণমুদ্রা প্রথম চালু করেছিল কুষাণ সম্রাটেরাই।
বাংলায় মুদ্রার শুরুটা হয়েছিল ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে। তারপর ছাঁচে ঢালা তামার মুদ্রা। ছাপ থেকে ছাঁচমুদ্রায় আসতে বাঙালিকে পার করতে হয়েছে অনেক শতক। টাকা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘টঙ্ক’ থেকে; যার মানে রৌপ্য মুদ্রা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশি মুদ্রাকে ‘টাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নোট হচ্ছে বাংলাদেশি দুই টাকা। ২০১২ সালে রাশিয়ার একটি অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট আউটলেটে পোলের মাধ্যমে সেটি নির্বাচিত হয়। দুই টাকার নোটটি চালু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে।
প্রযুক্তির উৎকর্ষে কাগজি নোটের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এখনকার মুদ্রা মূলত ডিজিটাল কিছু ডিজিট মাত্র, যা অ্যাপ থেকে অ্যাপে চলে যায়। সেই মুদ্রা ধরা যায় না, ছোঁয়াও যায় না। চাইলেই কেউ পকেট কেটে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে না। এ ধরনের মুদ্রাকে বলে ক্রিপ্টোকারেন্সি। ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় বলেই এসব কারেন্সির এমন নাম। মানে শিকেল থেকে যে অর্থনীতির শুরু হয়েছিল, সেটির প্রান্তে এসে মানুষ পেয়েছে ডিজিটাল মানি। ভবিষ্যতে আরও কত কী হয়, কে জানে!
ছবি: ইন্টারনেট