skip to Main Content

ফিচার I ঘ্রাণবাণিজ্য

খাদ্য ব্যবসায় মুনাফালোভীরা বেছে নিচ্ছে ভিন্ন এক পথ। মানে কৃত্রিম সুবাসের কারবার। লিখেছেন রাইসুল রাণা

ঘ্রাণং অর্ধং ভোজনং। রসনাবিষয়ক প্রবাদ। খাবারে সুবাসের গুরুত্ব চিরকালই অনুভব করেছে ভোজনরসিকেরা। বিশ্বজুড়েই। শুধু রসনা তৃপ্তিতেই ঘ্রাণের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি। খদ্দের টানতেও এটি ব্যবহার করেছে খাদ্য-ব্যবসায়ীরা। ঘ্রাণ ছড়িয়ে ক্রেতাকে রেস্তোরাঁয় আসতে প্রলুব্ধ করার বিষয়টি নতুন নয়। কৃত্রিম গন্ধে ভোজনরসিকদের বিভ্রান্ত করা এখন বিপণন কৌশলের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। তবে আগে ঘ্রাণবাণিজ্য প্রতারণার পর্যায়ে পড়ত না। বাবা-দাদাদের মুখে পুরোনো বেকারি, রেস্তোরাঁ কিংবা ক্যাফের গল্প শুনলে তা আঁচ করা যায়। সেকালের তন্দুর রুটি তৈরির দোকানের সামনে দিয়ে গেলে কিংবা কোনো বেকারির পাশে হাঁটলে ঘ্রাণে মন আকুল হয়ে উঠত, সেটিতে কোনো বিপণন উদ্দেশ্য বা কৃত্রিমতা ছিল না। বিশ-ত্রিশ বছর আগে কেউ ইউরোপের কোনো দেশে গেলে তারা নাকি কফি শপের সামনে থমকে দাঁড়াত। কফি বিনের টাটকা গন্ধের কারণে সেখানে থামতেই হতো। এমন সুগন্ধি কফি চেখে না দেখলে কি চলে! ঢুঁ মেরে এক মগ পান করে আসত অনেকেই। এতে বিক্রেতার পকেটও ফুলে-ফেঁপে উঠত। খাবারের সেই সুবাস যেমন ক্ষুধার উদ্রেক ঘটাত, তেমনি নিবারণও করত। সে কারণেই ঘ্রাণং অর্ধং ভোজনং-এর মতো প্রবাদের উৎপত্তি। সেই কফি, তন্দুর কিংবা বেকারিতে কৃত্রিমতার বালাই ছিল না। ওই ঘ্রাণ ছিল খাঁটি। কিন্তু এখনকার খাদ্যদ্রব্য থেকে সত্যিকারের সেই সুবাস মেলে না। ফলে আগের মতো ক্রেতা আকৃষ্টও হয় না। এই শূন্যতা পূরণে ছোট-বড় বাজার ও রেস্তোরাঁগুলো ব্যবহার করছে কৃত্রিম সুবাস। ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারজুড়ে। ক্রেতারা সেখানে ঢুকে মনে করছে- বাহ্! বেশ খাঁটি জায়গায় চলে এলাম। আসলে সবই কৃত্রিম ঘ্রাণের কারসাজি।
ঘ্রাণবাণিজ্য খাদ্য ব্যবসায় নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। নেতৃত্বে আছে জাপান। ঠিক কবে থেকে তা শুরু হয়েছিল, সেটি জানা যায় না। তবে বিশ্বের কিছু অঞ্চলে শত বছর ধরে বেকারিশিল্পে এর চল আছে বলে ধারণা করা হয়। সম্প্রতি ‘স্টারবাকস’-এর হাত ধরে কফি ও স্যান্ডউইচে ঘ্রাণবাণিজ্যের শুরু। সালটি ২০০৮। তবে তারা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে পাওয়া সুবাস ব্যবহার করত। এখন অবশ্য তা কমে গেছে। তার বদলে কৃত্রিম ঘ্রাণে বাজার সয়লাব। ব্যবহৃত ঘ্রাণের সঙ্গে পণ্যের আদতে কোনো সম্পর্কই নেই। হয়তো কোনো সবজির দোকানে ভুড়ভুড় করছে তাজা ঘাসের ঘ্রাণ। কিন্তু সেটা কৃত্রিম। এই সুবাস মানুষের স্নায়ু ও আবেগের ওপর কাজ করে; যা বিক্রেতাবান্ধব। তাই রেস্তোরাঁগুলো এখন কৃত্রিম গন্ধকে বেশ সমাদর করছে। বিজনেস ট্রিকস হিসেবে গ্রহণ করেছে ঘ্রাণকে। তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় বাড়ছে প্রতিযোগিতা। বাজারে টিকে থাকতেই তারা এসব কৌশল প্রয়োগে বাধ্য হচ্ছে। এত দিন অনলাইনে খাবারের সুন্দর সুন্দর ছবি, পথেঘাটে পোস্টার কিংবা বিরাট বিলবোর্ড দিয়ে কাজ সারা গেলেও এসব মার্কেটিং এখন খুব একটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। মানুষ এখন খাবারকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। বুঝতে চায় সেই খাবারটি টাটকা কি না। কিন্তু উৎপাদন ও বিপণনের মধ্যখানে থাকা লম্বা পথ ও সময় খাবারকে বাসি করে ফেলতে পারে। তাই যে করেই হোক, সেই খাবারে তাজা ভাব ধরে রাখতে হবে। নয়তো ব্যবসা উঠবে লাটে। সেই ঝুঁকি থেকে বাঁচতে অনেকেই গোপনে কৃত্রিম ঘ্রাণের সাহায্য নেয়। শোনা যায়, সেগুলো খোলামেলাভাবে খুব একটা বিকিকিনিও হয় না।

রেস্তোরাঁর এই ঘ্রাণবাণিজ্যকে যতটা সরল মনে হয়, আসলে ততটা নয়। রেস্টুরেন্টের ডেকোরেশনের ওপর নির্ভর করে এসব কৃত্রিম ঘ্রাণ ভোজনরসিক অতিথিদের ওপর প্রভাব ফেলবে কি না। ঘ্রাণ নিজেই রেস্তোরাঁ মার্কেটিংয়ের একটি বড় উপাদান। এর সঙ্গে আরও কিছু যোগ হলে ব্যবসার প্রসারের ক্ষেত্রে সেটি হতে পারে একটি শক্তিশালী নিয়ামক। সুন্দর করে আলোকবাতি দিয়ে সাজানোর পাশাপাশি ক্রেতাদের জন্য মিউজিকের ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে। আবার, স্বাদ ও গন্ধ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাই শুধু সুবাসে মুখরিত করে রাখলেই হয় না। রেস্তোরাঁর অতিথিরা ঘ্রাণের সঙ্গে মানানসই খাদ্যই প্রত্যাশা করে। তাই শতভাগ স্বাদের নিশ্চয়তা না দিতে পারলেও কাছাকাছি দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। নয়তো শুধু কৃত্রিম ঘ্রাণের ওপর নির্ভর করে রেস্তোরাঁ টেকে না। নেতিবাচক রিভিউ আসে। অবশ্য একালের রেস্তোরাঁগুলো তাদের খাবারের সঙ্গে মিল রেখেই কৃত্রিম ঘ্রাণ ব্যবহার করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, খাবারে কৃত্রিম ঘ্রাণ ব্যবহার করে রেস্তোরাঁগুলো বেশি মুনাফা করতে পারছে কি না। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, হ্যাঁ, লাভ হচ্ছে; কারণ, ক্রেতারা সেসব গন্ধে প্রলুব্ধ। এ কারণে রেস্তোরাঁর পাশাপাশি পাব, বার এবং সুপারশপগুলো এ ধরনের ঘ্রাণ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। রেস্তোরাঁয় পুরোনো অতিথিদের চেয়ে নতুনেরা পাঁচ গুণ বেশি টাকা খরচ করে বলে জরিপে উঠে এসেছে। নতুনদের আকৃষ্ট করতে ঘ্রাণ একটি বিশেষ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
রেস্তোরাঁয় সুবাসকে কার্যকর করতে অপ্রয়োজনীয় গন্ধ দূর করার প্রতি নজর দিতে হয়। নয়তো বিভিন্ন উপাদানের ঘ্রাণ মিলেমিশে উটকো গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন লিম্বার্গার ও টেলগজিও চিজের ঘ্রাণ কাস্টমারদের অনাগ্রহী করে তুলতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রথমে লেবুর ঘ্রাণ ছড়িয়ে অপ্রয়োজনীয় গন্ধ দূর করে নেয় কর্তৃপক্ষ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৪৪ শতাংশ গ্রাহক শুধু সুঘ্রাণের জন্যই রেস্তোরাঁয় নিয়মিত হয়। তাই কাস্টমার বাড়াতে ব্যবসায়ীরা সুবাসকে বিশেষ প্রাধান্য দিচ্ছে। তা ছাড়া, ভালো ঘ্রাণ যুক্ত রেস্তোরাঁয় অতিথিরা বেশিক্ষণ থাকতে পছন্দ করে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top