ফিচার I বিতর্কিত পেঁয়াজ-রসুন
সেমিটিক কিংবা নন-সেমিটিক- সব ধর্মেই ছিল এর দুর্নাম। খাদ্যমর্যাদায়ও তলানিতে। কেননা, দুটোতেই জড়িয়ে আছে নেতিবাচক মিথ। জানাচ্ছেন শিবলী আহমেদ
তুরস্কের লোকশ্রুতিতে রয়েছে, শয়তানকে বেহেশত থেকে ছুড়ে ফেলার পর তার বাম পা যেখানে পড়েছে, সেখানে গজিয়েছে রসুন; ডান পায়ের স্থানে পেঁয়াজ। নন-সেমিটিক ধর্মগুলোতে এই দুই ফসল নিয়ে মিথ আছে। যেমন ভগবান বিষ্ণু যখন মোহিনী অবতাররূপে দেবতাদের অমৃত দেওয়ার জন্য আবির্ভূত হন, তখন রাহু ও কেতু নামে দুই অসুর লুকিয়ে দেবতাদের সারিতে বসেছিল। এরপর ভগবান উভয়ের মুখে অমৃত দেন। ঠিক তখনই চন্দ্র ও সূর্যদেব ভগবানকে জানান যে, ওই দুজন হচ্ছে অসুর। এ কথা শুনে তখনই তিনি রাহু ও কেতুর মাথা কাটেন। অমৃত তখনো তাদের গলা বেয়ে পাকস্থলীতে ঢুকতে পারেনি। মুখের ভেতরেই ছিল। ফলে তা বেরিয়ে মাটিতে পড়ে। দুই অসুরের গলা থেকে ভূপতিত রক্তমেশা অমৃত বিন্দু থেকেই পেঁয়াজ ও রসুনের উৎপত্তি। অসুরদের উচ্ছিষ্ট থেকে সৃষ্ট হওয়ায় এই মসলাজাতীয় এই সবজি দুটি ভগবানের সেবায় ব্যবহৃত হয় না। বৈষ্ণবধর্ম মতে, একজন ঋষির গোমেধ যজ্ঞের আয়োজনকালীন তার স্ত্রী গর্ভবতী হন। সেই প্রসূতি গরুর মাংসের প্রতি লোভাতুর হয়ে স্তূপ থেকে এক টুকরা মাংস লুকিয়ে ফেলেন। কিন্তু যজ্ঞ শেষে ঋষি মন্ত্র পড়ে মাংসগুলো একত্র করে আবারও বাছুর সৃষ্টিতে মনোনিবেশের সময় দেখা গেল, সেটির শরীরে এক টুকরা মাংস কম পড়েছে। প্রসূতি বুঝতে পারল, ঋষির সন্দেহের তীর তার দিকেই। ফলে তিনি মাংসের টুকরাটি দূরে ছুড়ে ফেলেন। সেটি গিয়ে পড়ে কোনো এক মাঠে। ঋষির মন্ত্রবলে ওই মাংসপিন্ডে প্রাণের সঞ্চার হয়। ফলে নতুন যে গরু উৎপন্ন হয়, সেটির মাংস থেকে জন্মায় পেঁয়াজ; হাড় থেকে রসুন।
লোকশ্রুতি মেনে নিলে বলা যায়, এই দ্রব্যদ্বয়ের উদ্ভব ভীষণ নেতিবাচক প্রক্রিয়ায়। সে কারণে প্রাচীনকালে পেঁয়াজ-রসুন খাওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। যেমন ব্রাহ্মণেরা তা খেতেন না। এমনকি ঘরে আনাও বারণ ছিল। অন্যদিকে আয়ুর্বেদশাস্ত্র মানুষের খাদ্যকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে- সত্য, রাজস ও তামস। পেঁয়াজ ও রসুন হচ্ছে দ্বিতীয় বিভাগের খাবার। যা খেলে চিত্ত অশুভ হয়ে ওঠে, রাগ বাড়ে এবং মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই ব্রাহ্মণেরা রাজস বিভাগের এই খাদ্যদ্বয় এড়িয়ে চলতেন। তখন প্রচলিত ছিল- পেঁয়াজ ও রসুন মানুষের চেতনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ দুয়ের মধ্যে রজঃ ও তমঃ বৈশিষ্ট্য প্রবল, যা চিত্ত চঞ্চল করার পাশাপাশি উত্তেজনা বাড়ায়।
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় আছে, রজঃ বৈশিষ্ট্য থেকে উদ্ভূত কামই মানুষকে পাপে প্রবৃত্ত করে। তা থেকেই লোভের উৎপত্তি। তা ছাড়া তমঃ বৈশিষ্ট্য থেকে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ তৈরি হয়। ফলে, রজঃ ও তমঃর প্রভাবে পাপে প্রবৃত্ত না হওয়ার উদ্দেশ্যে শাস্ত্র অনুসারীরা পেঁয়াজ-রসুন পরিত্যাগ করত।
বেদ ও উপনিষদে পেঁয়াজের উল্লেখ মেলে না। এ দুটি ছিল ‘যবন ও ম্লেচ্ছদের খাবার’। পেঁয়াজ ও রসুনকে জৈবিক উত্তেজনাবর্ধক হিসেবে জানত মানুষেরা। তাই ছাত্র ও বিধবাদের জন্য সেসব খাওয়া কড়াকড়িভাবে বারণ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৬০০ অব্দে চরক সংহিতায় পেঁয়াজের গুণ বর্ণিত হয়েছিল; ভেষজ ওষুধ হিসেবে। তবু সে সময় ভারতবর্ষে ফসলটি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তার ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন, ভারত ভ্রমণের সময় কোথাও তিনি পেঁয়াজের ব্যবহার দেখেননি। আরেক চৈনিক পর্যটক হিউয়েন-সাং অবশ্য এই অঞ্চলে এর ব্যবহার দেখেছিলেন। তবে তিনি এ-ও দেখেছিলেন, যারা পেঁয়াজ খেত, তাদেরকে শহরের সীমানার বাইরে নির্বাসিত করা হতো। মনুসংহিতায়ও মনু মানবজাতিকে পেঁয়াজ-রসুন খেতে বারণ করেছেন। তার মতে, এগুলো খেলে কৃচ্ছ্রসাধন করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। মানে, এক রাত পূর্ণ উপবাস করা লাগে। জৈনধর্মের অনুশাসনে মূলজ উদ্ভিদ খাওয়া নিষেধ। ফলে পেঁয়াজ ও রসুন এড়িয়ে চলেন এই ধর্মাবলম্বীরা।
চার শতকে তাওবাদীরা তীব্র গন্ধযুক্ত মোট পাঁচটি সবজির ব্যবহার নিষেধ করে দিয়েছিল। সেগুলোর একটি ছিল পেঁয়াজ। ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর, আগ্রাসী স্বভাব এবং যৌন উদ্রেক বাড়ায় বলে বৌদ্ধদের মধ্যে অনেকেই এখনো পেঁয়াজ ও রসুন খায় না। মিসরের ফেরাউনরা মমিতে পেঁয়াজ-রসুন ব্যবহার করলেও সে দেশের কিছু পুরোহিত দল এটিকে এড়িয়ে চলত। সেই শ্রেণিটির বিষয়ে গ্রিক লেখক প্লুটার্ক লিখেছেন, ‘তারা মনে করত, পেঁয়াজ-রসুন উপবাসের উপযুক্ত নয়, ভোজ উৎসবের উপযুক্তও নয়। কারণ, একদিকে এটা তৃষ্ণা বাড়ায়, অন্যদিকে চোখের পানির উদ্রেক করে।’
গ্রিকদের কাছে একসময় রসুনের গন্ধ ছিল আভিজাত্যবিরোধী। শেকসপিয়ারের ‘আ মিডসামার নাইটস ড্রিম’-এ বটম তার নাট্যদলকে উপদেশ দেন এভাবে, ‘কদাচ পেঁয়াজ খেয়ো না, রসুনও নয়, আমাদের উচ্চারণে যেন মিষ্টি বাতাস বয়’। তৎকালীন গ্রিসে রসুনের গন্ধযুক্ত কাউকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। ইসলামেও কাঁচা পেঁয়াজ খেয়ে মসজিদে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞামূলক হাদিস রয়েছে। তবে রান্না করে খাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই ধর্মটিতে। সেমিটিক সব ধর্মে ‘মান্না-সালওয়া’র ঘটনা রয়েছে। কাহিনিটি পেঁয়াজ ও রসুন-সংশ্লিষ্ট। ঘটনা হলো, মুসা নবীর অনুসারীরা দুর্ভিক্ষে পতিত হওয়ার পর, খোদা বেহেশত থেকে তাদের জন্য খাবার পাঠাতেন। চল্লিশ বছর ধরে এমন ব্যবস্থা চলেছিল। কিন্তু তারপর অনুসারীরা সেই খাবারের স্বাদের সমালোচনা শুরু করে। পেঁয়াজ ও রসুন না থাকায় সেসব আহার্য তাদের কাছে আর ভালো লাগছিল না। ফলে নীল নদের তীরে এই দুটি ফলিয়ে তা বেহেশতি খাবারে মিশিয়ে খাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল তারা। এতে খোদা রুষ্ট হয়ে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
মধ্যযুগজুড়েই ছিল পেঁয়াজের নিন্দা। তখন অনেকেই ভাবত, সেটি খেলে গায়ের রং নষ্ট হয়। খুব সস্তা ছিল বলে পেঁয়াজকে গেঁয়ো খাবার ভাবা হতো। ফরাসি ঐতিহাসিক ব্রুনো লরিয়োর মতে, খাবার মেলে এমন উদ্ভিদগুলো মাটির ওপরে কতটা বেড়ে ওঠে, সেটিতেই নির্ভর করে ওই খাদ্যের মর্যাদা। যেমন বৃক্ষে জন্মানো ফলগুলো ছিল বেশ সম্মানের। ঝোপঝাড়ে হওয়া ফলমূলগুলোর মর্যাদা আরেকটু নিচে। তারও তলানিতে ঠাঁই পায় মটরের মতো শস্যগুলো, যা গাছের কান্ডে জন্মায়। এরপর হলো মূল থেকে পাওয়া খাবারের মর্যাদা; যেমন পালংশাক। সবশেষে মূলজ খাদ্যের স্থান। মানে পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি। অর্থাৎ, সে সময় পেঁয়াজ ও রসুন ছিল সবচেয়ে কম মর্যাদাসম্পন্ন খাবার।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে পেঁয়াজ-রসুনের নিন্দা থাকলেও এখন রোগবালাই ছাড়া সেগুলো খাওয়ায় খুব একটা বারণ নেই। এর সঙ্গে মর্যাদারও যোগ-বিয়োগ হয় না। তবে অতীতে বিশ্বজুড়ে এই ফসলদ্বয়ের নিন্দা থাকলেও স্তুতি কম ছিল না।
ছবি: ইন্টারনেট