বিশেষ ফিচার I ইলিশের বিকল্প
এ মাছের বদলে পাতে তোলা যেতে পারে সমতুল্য কিছু। আজকাল সেসব দুষ্প্রাপ্যও নয়। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
বৈশাখ খরার মাস। এ সময় কোনো ফসল হতো না। কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকত না। তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়াও কঠিন ছিল। নববর্ষ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ খেয়ে বছর শুরু একটা মিথ বলেই ধারণা করেন ইতিহাসবিদেরা।
গ্রামবাংলায় বর্ষবরণ উৎসব ছিল খুব ছোট আকারে। কৃষাণী আগের রাতে একটি নতুন ঘটে কাঁচা আমের ডাল ও চাল ভিজিয়ে রাখত। সকালে কৃষক সেই চাল-পানি খেত এবং কৃষাণী কিছুটা পানি কৃষকের শরীরে ছিটিয়ে দেওয়ার পর সে হালচাষে বেরিয়ে পড়ত। দুপুরবেলায় তারা পান্তা খেত কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে। কখনো কখনো একটু শুঁটকি, বেগুনভর্তা কিংবা সামান্য আলুভর্তা দিয়ে চলত খাবারের পর্ব। ফলে বাঙালি কৃষকের হাজার বছরের ইতিহাস বা সংস্কৃতির সঙ্গে পান্তা-ইলিশের কোনো সংযোগ পাওয়া যায় না।
বর্ষবরণের প্রথম দিনে এক টুকরো ইলিশ ভাজা পাতে থাকা কতটা জরুরি, সেটা তর্কের বিষয় হলেও খাদ্যতালিকায় সবাই পদটির উপস্থিতি হয়তো অপরিহার্য মনে করে। কিন্তু জেনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশে এ জাতীয় মাছের এটাই প্রজনন মৌসুম। এ সময় ইলিশের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে মা-মাছ ও জাটকা ধরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তার স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া। চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে না পারায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেআইনিভাবে ইলিশ ধরে এবং স্বাভাবিক উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করে। বর্ষবরণ উৎসব ঘিরে খোঁজা যেতে পারে ইলিশের বিকল্প কিছু, যা মাছটির স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া বজায় রেখে বাঙালির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে।
অবিকল ইলিশের চেহারার একটি মাছ হলো ‘চন্দনা’। এর অন্য নাম ‘সার্ডিন’, ‘চাকোরি’, ‘কলোম্বো’ বা ‘শ্যাড ফিশ’। মূলত উরুগুয়ের একটি মাছ। দেশটির গভীর সমুদ্রে এদের পাওয়া যায়। উত্তর আমেরিকায় সব সময় ইলিশ পাওয়া যায় না বলে সেখানকার বাঙালি অধিবাসীরা এই মাছটিকে ইলিশের বিকল্প হিসেবে রান্না করে থাকে। গুণে-মানে ইলিশের কাছাকাছি না হলেও এটি রাজধানীর বাজারজুড়ে ‘ইলিশ’ নামেই বিক্রি হয়। গায়ের রং ইলিশের মতো সাদা হলেও পিঠ সুরমা রঙের নয়। চোখ বড়। ইলিশের মতো ততটা চ্যাপ্টাও নয়। দেখতে অনেকটাই ইলিশের কাছাকাছি, আকারও একই রকম। মাছটি সমুদ্রে জেলেদের জালে ধরা পড়ে। কেউ কেউ একে ‘ফুইট্টা ইলিশ’ বা সামুদ্রিক ইলিশও ডেকে থাকে। ওজন ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। দাম ইলিশের চেয়ে অনেকটাই কম, প্রতি কেজি ২৫০-৩০০ টাকা।
দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে ইলিশের বদলে খাওয়া যেতে পারে চ্যানস চ্যানস বা মিল্ক ফিশ। এটি বড় হলে ৫-৬ কেজি ওজনের হয়। অন্যান্য সুস্বাদু মাছের মতো এতেও কাঁটা থাকে, যেগুলো লম্বায় এক মিটারের বেশি হয় না। মাছটির জন্ম মূলত প্রশান্ত মহাসাগরের নোনা জলে। তবে মিষ্টিপানিতেও এরা স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠে। মাছটি ডেকান হিলসা বা দাক্ষিণাত্যের ইলিশ নামেও পরিচিত। ইলিশের আচরণের সঙ্গে এদের বেশ কিছু মিল রয়েছে। যেমন- এরা ঝাঁক বেঁধে ঘোরে। ডিম পাড়ার সময়ে মিষ্টি পানির খোঁজে দলে দলে মোহনার দিকে উঠে আসে। মৎস্যবিদদের দাবি; ইলিশ যেভাবে দিন দিন বাঙালির নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাতে ফিলিপাইনের এই মাছ একসময় বাঙালির ইলিশের সঙ্গে টেক্কা দেবে। বাজারে মাছটি ৪০০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যায়।
ইলিশের বিকল্প হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিভাগ দীর্ঘ সময় ‘মণিপুরি ইলিশ’ বা ‘পেংবা’ চাষ করছে। পুকুরেই। মণিপুরি রাজ্যের জলাশয়ে পেংবা মাছের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। গড়নে পুঁটির মতো। অঞ্চলটিতে পেংবা ‘স্টেট ফিস’ হিসেবে স্বীকৃত। মাছটি সেখানে ইলিশের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মণিপুরি রাজ্যে শুরু হলেও এখন পশ্চিমবঙ্গ, বর্ধমান ও উড়িষ্যার বিভিন্ন জায়গায় মাছটির চাষ হচ্ছে। চীন ও মিয়ানমারের চিন্দুইন নদীতেও এর বিচরণ রয়েছে। পেংবার আকার ইলিশের চেয়ে ছোট, তবে স্বাদ ও গন্ধে প্রায় সমতুল্য। মৎস্যবিদেরা আশা করছেন, পাতে ইলিশের অভাব দূর করবে এই মাছ। বাংলাদেশের ঝিনাইদহের মহেশপুরেও শুরু হয়েছে এর চাষ। বাজারে ২৫০-৩০০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যায়।
ইলিশের বিকল্প হিসেবে খাওয়া যেতে পারে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ। আমাদের চারপাশে সেসব খুব সহজেই পাওয়া যায়। পমফ্রেট, সার্ডিন, সুরমা, টুনা, সলোমন, লাল কোরালের মতো সামুদ্রিক মাছে রয়েছে ওমেগা থ্রি, যা হার্টকে দীর্ঘদিন তরতাজা রাখে, রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা কমায়। এ ছাড়া ব্রেস্ট ক্যানসার, কোলন ক্যানসার ও প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। ডায়াবেটিস রোগীদের দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখতে ওমেগা থ্রি অত্যন্ত উপকারী।
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে সুরমা বেশ সুস্বাদু। এটিতে কাঁটা খুবই কম এবং পেশি বেশি থাকে। মাছটি বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। এর কোপ্তা খুব মজাদার। এ ছাড়া এ মাছের গ্রিলও চমৎকার হয়। কাঁটা খুব কম বলে শিশুরাও পছন্দ করে। বাজারে সুরমার কেজি ৫৫০-৬০০ টাকা।
টুনা বিদেশি মাছ হলেও বাঙালির খাদ্যতালিকায় আস্তে আস্তে স্থান করে নিয়েছে। সুপারশপগুলোতে ক্যানে থাকা বা ফ্রোজেন টুনা পাওয়া যায়। দুধরনের টুনাই উপকারী। মাছটি দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সহায়ক, পেটে অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং চুল ভালো রাখে। টুনা মাছ ৫৩০-৭০০ টাকা কেজি।
লাল কোরাল খুবই সুস্বাদু। সামুদ্রিক এই মাছ ১ থেকে ৮-৯ কেজি পর্যন্ত হয়। এর স্থানীয় নাম ‘লাল পানসা’ বা ‘রাঙ্গা ছইক্কা’। একে ‘রেড স্ন্যাপার’ও বলা হয়। প্রতি কেজি লাল কোরালের দাম ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা হতে পারে।
ইলিশ জোগাড় করতে না পারলে পয়লা বৈশাখের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে, এমনটি হতে দেওয়া যায় না। তাই ইলিশ না পেলেই চেখে দেখা যেতে পারে ইলিশসদৃশ মাছ অথবা বিভিন্ন সামুদ্রিক মৎস্য। নববর্ষ উদ্্যাপনে ইলিশের অভাবে মাছে-ভাতে বাঙালির উৎসব ফিকে না হয়ে বরং আরও বেশি বর্ণিল হয়ে উঠতে পারে বিভিন্ন মাছের স্বাদে।
ছবি: ইন্টারনেট