skip to Main Content

স্বাদশেকড় I মুড়ি

লোকায়ত বাংলার অতিপরিচিত খাবার। মুখরোচক বটে। তবে এটি তৈরির প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ

বাঙালির পাঁচ বেলার খাবার। যখন যেভাবে খুশি খাওয়া যায়। দরিদ্রের সাধ্য আর সচ্ছলদের শখ, তবে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুরে ফারাক ঠাহর হয় না।
বাংলার অনেক গ্রামে এক শতক আগেও প্রধান খাবার হিসেবে মুড়ির চল দেখা যেত। এটি ছিল অসচ্ছলের প্রতিদিনের মূল খাবার আর সম্পন্নের শখের ভোজ্য। সকালবেলায় দুধ দিয়ে, বিকেলে বা সন্ধ্যার আড্ডায় মুড়ি মাখা, ঘরে খাওয়ার কিছু নেই- এক বাটি ডালের সঙ্গে, এমনকি সকালে পান্তা ভাতে টান পড়লে তাতেও মুচমুচে মুড়ি দেওয়ার চল রয়েছে কিছু এলাকায়। চায়ের কাপেও মুড়ি ফেলে খান অনেকে। আর মোয়া তো রয়েছেই। কিছুই যদি না থাকে, তা-ও পরোয়া নেই, শুধুই খেয়ে ফেলা যায়, মাঝেমধ্যে থাকতে পারে পাটালি গুড় বা যেকোনো ধরনের তেলে-ভাজা। আবহাওয়ার ওলটপালট হলে- যেমন একটু ঠান্ডা বাতাস বা বৃষ্টিতে মুড়ি-মাখা বেশ জমে ওঠে। স্কুলের টিফিন ব্রেকে ঘুগনি, মসলার মিশ্রণে যে ঝালমুড়ি খেয়ে এই অঞ্চলের শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠা, তা-ও কি ভোলা যায়?
মুড়ির ইতিহাস জানা কঠিন। যাযাবর মানুষ কৃষিজীবী হওয়ার আগ পর্যন্ত এর সন্ধান পায়নি, সেটা নিশ্চিত। বৈদিক যুগে দেবতাদের নৈবেদ্যেও নাকি দেওয়া হতো খাবারটি। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৩০০ অব্দেও ভারতীয় উপমহাদেশে মুড়ি তৈরি হতো, তার বিস্তর প্রমাণ মেলে। সে সময়ে একে বলা হতো মিসিতা বা ধানিধাকা। ষষ্ঠ শতাব্দীর দশকুমারচরিতে পোরি তৈরি আর তা দুধে ভিজিয়ে খাওয়ার উল্লেখ রয়েছে। পোরি হলো দাক্ষিণাত্যে মুড়ির প্রচলিত নাম। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে আরব দেশগুলোতেও এই পদ খাওয়া হতো, তার প্রমাণ মেলে ইহুদিদের পুরোনো হিব্রু ভাষার গ্রন্থগুলো থেকে। যাযাবর জাতি হওয়ার কল্যাণেই তারা এটিকে গুরুত্ব দিতে শিখেছিল। গ্রিক এলাকাগুলোতেও যিশুর মর্ত্যে আগমনের আগে থেকেই এর প্রচলন ছিল। যুদ্ধের ও আপৎকালীন খাবার হিসেবে ছত্রপতি শিবাজিও তার যোদ্ধাদের পাটালি গুড় আর মুড়ি দিতেন।
চালভাজা ও মুড়িভাজা- দুটো কাছাকাছি হলেও যে এক নয়, তা বাঙালিমাত্রই জানেন। ধান ভেজে খই হয়, চাল ভাজলে চালভাজা এবং গরম বালিতে চাল ভাজলেই সেটা মুড়ি। তবে সেই চাল তৈরির কৌশল রয়েছে। বিশেষ ধরনের ধান থেকে যে চাল পাওয়া যায়, তা বালির খোলায় ভেজে তৈরি হয় মুড়ি। চালভাজা যেখানে শক্ত, নিরেট সেখানেই মুড়ির পার্থক্য। এই খাদ্য হয় ফাঁপা, হালকা আর মুচমুচে। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে লেখা জলখাবার নামে কিরণলেখা রায়ের বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ‘ইহার নিমিত্ত বিশেষ প্রকারের ধান্য লাগে এবং বিশেষ প্রক্রিয়া দ্বারা তাহা তৈয়ার করিয়া লইয়া তকে ভাজিতে হয়। হিদে, কেঁকে, ভোজন-কর্পূর, মেটে-গরল প্রভৃতি আমন এবং ঢেঁকি-শালি, হরিদাজাওন, পানেকী প্রভৃতি শালি (রোয়া) ধান্যের মুড়ি উত্তম হইয়া থাকে।’ এই সব ধানের মধ্যে কেবল ঢেঁকি-শালি ধানটাই টিকে আছে।
বিশেষ অভিজ্ঞতা ছাড়া ধান থেকে মুড়িতে রূপান্তরের কাজ করাটা কেবল কষ্টকরই নয়, অসম্ভবও। মুড়ির ধান মাড়াইয়ের পর তা পরিষ্কার করে রোদে শুকানোর নিয়ম। রোদে ধানের রস টানার পর তা ভাপ দিয়ে হালকা সেদ্ধ করা হয়। এরপর তিন থেকে পাঁচ দিন পানিতে ভিজিয়ে আরেক দফা ভাপে সেদ্ধ করতে হবে। বড় হাঁড়িতে ফুটন্ত পানির ওপরে ছিদ্রযুক্ত পাত্রে ধান রেখে ঢেকে দেওয়া হয়। পানির ভাপে ধান সেদ্ধ হতে থাকে। এ সময় ধানের মুখ ফাটলে তা তুলে ফেলা হয়। সেদ্ধ ধান একটু আঠালো হলে তাতে মুড়ি ভালো হয়। বেশি সেদ্ধ হয়ে ধান ভাতের মতো গলে গেলে তাতে মুড়ি হবে না। এরপর সেদ্ধ করা ধান আবার রোদে শুকানো হয়। চাল শক্ত হয়ে এলেই চলে। পরে কলে বা ঢেঁকিতে ভানাতে হবে। তুষ-কুঁড়া পরিষ্কার করে নিলেই মুড়ির চাল পাওয়া যাবে। ভাজার আগে একটি মাটির পাতিলে চালে লবণপানি ছিটিয়ে এমনভাবে মাখাতে হবে, যেন তা ভালোমতো চালের সঙ্গে মিশে যায়। ৫০ কেজি চালে প্রয়োজন ১ কেজি লবণ। মাটির পাত্রে তাপ দিয়ে এসব চাল একটা কাঠির সাহায্যে অনবরত নাড়তে হয়। তাপে চালগুলো যখন লাল হয়ে ওঠে, তখন পাশে আর একটি চুলায় রাখা পাত্রের গরম বালির মধ্যে ঢেলে দিলে মুড়ি হয়ে যায়। পাশে ছিদ্রযুক্ত আরেকটি পাত্রে ঢেলে শলা দিয়ে নেড়ে মুড়ি থেকে বালি আলাদা করা হয়। সে বালি আবার চুলায় বসিয়ে তাতে একইভাবে ভাজা চলতে থাকে। সাধারণত ৫০ কেজি চালে ৪৪ কেজি মুড়ি পাওয়া যায়। বেশির ভাগ স্থানেই রাত দুইটা-তিনটার দিকে শুরু হয় ভাজা, আর কর্মযজ্ঞ চলে প্রায় সকাল পর্যন্ত।
বাণিজ্যিকভাবে মুড়ির বিপুল উৎপাদনের কারণে দীর্ঘ এই প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত হয়েছে। ইউরিয়া দিয়ে ধানকে দ্রুত মুড়ির চাল তৈরির উপযুক্ত করা হয়, এতে খাবারটির রংও হয় সাদা। প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত হওয়া এবং মেশিনে ভাজার কারণে কায়িক শ্রম কমে যাওয়ায় এই মুড়ির দামও ভাজাগুলোর অর্ধেক। তাই দিনে দিনে কমছে হাতে ভাজা মুড়ির চল। তারপরও যারা একটু আয়েশ করে এটি খান, তারা বরিশালের মুড়ি পছন্দ করেন। সেখানে হাতে ভাজে, ব্যবহৃত হয় শালি-ধান। কয়েকটি কারণে এখানে হাইব্রিড আধুনিক ধানের চাষ করা যায় না- প্রাকৃতিকভাবেই ঢালু এলাকা হওয়ায় খুব সহজেই জলাবদ্ধতা আর জোয়ার-ভাটা হয়, ফলে হাইব্রিড ধানের জন্য সেখানকার জমিতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার আর কীটনাশক দেওয়া সম্ভব হয় না। অগত্যা সেখানে আদি ধানের চাষবাস চলে। এতে ফসল হয় কৃত্রিম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মুক্ত। সেই সঙ্গে মুড়ি ভাজার আদিকালের কৌশল তো রয়েছেই। তবে সে মুড়ি সেরা না হয়ে উপায় কী।

 আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top