ইভেন্ট I কিউরিয়াসের তাঁতবস্ত্র প্রদর্শনী
নববর্ষ উপলক্ষে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ড পোশাকের নতুন কালেকশন নিয়ে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে ফ্যাশন পরিমন্ডলের নবীন সদস্য কিউরিয়াস পরিধেয়র ভিন্ন সংগ্রহের পাশাপাশি আয়োজন করেছে তাঁতের শাড়ির প্রদর্শনী।
এ দেশের প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী শিল্প হলো বয়নশিল্প। যদিও বিদেশি কাপড় আর শাড়ির আগ্রাসনে তাঁতবস্ত্র আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এই শঙ্কার কথা ভেবেই ‘অলংকৃত তাঁতের শাড়ির প্রদর্শনী’ আয়োজিত হয়। এ শিল্প সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানানো এবং একে টিকিয়ে রাখতে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই আয়োজন। শাড়ি কেনার মাধ্যমে এ শিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এতে বয়নশিল্পীদের জীবনমান উন্নয়নের পথ সুগম হবে। তারা বাঁচলে টিকে থাকবে এ শিল্প।
কিউরিয়াসের বনানী আউটলেটের চতুর্থ তলার গ্যালারি সাজানো হয় তাঁতের শাড়ি এবং সেগুলো তৈরির নানা অনুষঙ্গ দিয়ে। এখানে ঢুকতেই চোখে পড়ে ভিন্ন আঙ্গিকের একটি ফটোবুথ। সেটাকে সাজানো হয়েছে নানা নকশায় বোনা বাঁশের জাফরি এবং তালপাতার পাখা দিয়ে। এর সামনেই আর্টিজান অ্যাট ওয়ার্কের আদলে বসানো হয়েছে তাঁত, যেখানে তাঁতিকে তা বুনতে দেখা যায়। বয়নশিল্পীর পেছনে রাখা স্বচ্ছ সাদা মসলিন কাপড়ে সাদা অক্ষরে মুদ্রিত হয়েছে তাঁতসম্পর্কিত একটি পরিসংখ্যান। বাংলাদেশের বিভাগভিত্তিক কোন জেলায় কতগুলো তাঁত আছে, সেই হিসাব সেখানে উপস্থাপিত হয়েছে। সংখ্যাটি খুব বেশি নয়। মাত্র ২০১৮টি। সেসব বয়ন এলাকার নামাঙ্কিত মসলিন চাঁদোয়া দিয়ে সাজানো হয়েছে গ্যালারির সিলিং। এসব তথ্য নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড থেকে।
প্রদর্শনীতে রয়েছে সুতা কাটার একটি চরকা। এ সম্পর্কে নানান কাহিনি শোনা গেলেও জিনিসটি দেখার সুযোগ অনেকেরই হয়নি। এখানে এসে সেটা পাওয়া গেছে। সবকিছুর শুরু এই যন্ত্র থেকেই। তুলায় কীভাবে সুতা তৈরি হয়, তার একটি ধারণা এখানে পান দর্শকেরা। পেছনের দেয়ালকে সাজানো হয়েছে সুতা টানা ও সানার বিভিন্ন পর্যায়ের স্থিরচিত্র দিয়ে।
এবারের সব তাঁতের শাড়ির মোটিফ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে জমিদারবাড়ি, প্রত্নতাত্ত্বিক ডিজাইন, পুঁথির অলংকরণ এবং বাংলাদেশের সবজির ফুল। শাড়ির নকশায় এর আগে কখনো কোথাও সবজির ফুলের ব্যবহার হয়নি। এই চিন্তা এসেছে কিউরিয়াসের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন কিরণের মাথা থেকে। তিনি চান, ক্রেতারা দেশে বসে যেন আন্তর্জাতিক মানের পণ্য কিনতে পারেন।
ফুলের তালিকায় ছিল করলা, মিষ্টিকুমড়া, শিম, পটোল, বেগুন। দেয়ালে ফুলের ছবি টানানো, কারণ শহরবাসীর পক্ষে এগুলো দেখার সুযোগ হয় না। এর পাশাপাশি আছে জমিদারবাড়ির বাইরের নকশার ছবি। নিচেই বাঁশের স্ট্যান্ডে রাখা রুপার টিপট সেট, প্রাচীন স্থাপনার টেরাকোটা আর সবজির ফুলের নিচে তাজা সবজি। অন্যদিকে প্রদর্শিত শাড়ির নিচে রাখা ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ফুল এবং অন্যান্য মোটিফের বিবর্তিত অলংকরণ। সেখানে দেখা যায় কীভাবে ফুল বা জমিদারবাড়ির সিঁড়ির রেলিং নকশা উপাদান হয়ে শাড়ির জমিনকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। উল্লেখ্য, শাড়িগুলো তৈরি করেছে শাহজাদপুরের তাঁতিরা।
গ্যালারির একদম মাঝে রাখা কাপড়ের বোঁচকা আর লালসালুতে বাঁধা খাতা। শহরে শপিং মল বা ফ্যাশন হাউস আসার আগে তাঁতিরা নিজেদের হাতে বোনা শাড়ি এমন বোঁচকায় বেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করত। বাকিতেও বিক্রির চল ছিল। সে হিসাব রাখা হতো লালসালু বাঁধা খাতায়।
এর ঠিক সামনে রয়েছে অন্য রকম একটি ইনস্টলেশন। সেখানে স্থিরচিত্রে দেখা যায় জ্যাকার্ড তাঁতে শাড়ি বয়নরত শিল্পী। নিচে রাখা পাঞ্চকার্ড। জ্যাকার্ড আর ডবির নকশা তুলতে এটি ব্যবহার করা হয়। পাঞ্চকার্ডটি একদিক দিয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং আস্তে আস্তে তা পুরোটাই একদিন বিলীন হয়ে যাবে। সেটাই যেন বোঝানো হয়েছে এই ইনস্টলেশনে।
এর পাশে দেখা যায় অনেক পুরোনো কাঁথা। তাঁতিবউরা নিজেদের বহু ব্যবহৃত শাড়ির পাড় দিয়ে এসব বানাত। দামি চাদর, কমফোর্টারের ভিড়ে আজ এই শিল্পও হারিয়ে যাচ্ছে।
পুরো প্রদর্শনীর কিউরেটর কিউরিয়াসের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ও ডিজাইন কনসালট্যান্ট চন্দ্র শেখর সাহা। এর আগেও বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনীতে তার কিউরেশন প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ আয়োজনের পেছনে কাজ করেছে তার সৃজনভাবনা।
ছবি: কিউরিয়াস