আড্ডা I রেডি-টু-ওয়্যারের সম্ভাবনায়
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির আরেকটি ধারা রেডি-টু-ওয়্যার। দ্বিধাবিভক্ত- স্ট্রিট ওয়্যার আর ফরমালে। বেশির ভাগ পোশাকই ওয়েস্টার্ন ওয়্যার। বাংলাদেশে এই ধারার উদ্যোক্তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে চার দশকের বেশি আগে। তবে গত দশ বছরের পরিবর্তন লক্ষ করার মতো। এখানেও রয়েছে একটা বড় সংখ্যার উদ্যোক্তা। করোনাকালে তারা কেবল ক্ষতির মুখে পড়েনি, যেতে হয়েছে নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। সেসব নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেছেন তারা
ক্যানভাস: বাংলাদেশের ফ্যাশন হাউস ট্রেন্ডটিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উৎসব এবং দিবসভিত্তিক ফ্যাশনের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে যেসব রেডি-টু-ওয়্যার ব্র্যান্ড আছে, সেগুলো চেষ্টা করেছে সেই ট্র্যাডিশন থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু করার। সেখানে আপনারা কতটা সফল? আপনাদের দশ বছরের পরিবর্তনকে কীভাবে দেখছেন?
মিথের মো. সাব্বির নেওয়াজ জিতু বলেন, আমরা নিজেদের বলি বাংলাদেশি ব্র্যান্ড। তাই এখানকার ঐতিহ্য নিয়েই কাজ করি। তবে ঐতিহ্যের সঙ্গে ট্রেন্ডকে কীভাবে একই পোশাকে তুলে ধরা যায়, সেই চেষ্টা থাকে আমাদের।
গ্রামীণ ইউনিক্লোর মো. শরিফুল ইসলাম যোগ করেন, বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাশনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মাধ্যমে। তবে আমাদের দেশের মানুষ এখনো পুরোপুরি ফ্যাশনসচেতন নয়। তাদের একধরনের মাইন্ড সেট রয়ে গেছে; তারা শুধু উৎসবের সময় নতুন পোশাক কিনবে। এখন সময় এসেছে এর থেকে বেরিয়ে আসার। আমরা চাই মানুষের প্রতিদিনের পোশাকটি আমার ব্র্যান্ডের হোক। আমরা সেভাবেই পোশাক তৈরি করি। গ্রামীণ ইউনিক্লো চায় মানুষের এভরিডে ক্লদিং নিয়ে কাজ করতে। কারণ, এখানে বিজনেসটাও প্রতিদিনের। আর একটি কারণ রয়েছে। যেমন এ বছর ঈদ ও বৈশাখ কাছাকাছি চলে এসেছে। সুতরাং একটি উৎসবের ব্যবসা একেবারেই হবে না। তাই উৎসবকেন্দ্রিক চিন্তা করলে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। এমনকি মানুষও এখন পরিবর্তনের দিকে হাঁটছে। তারা উৎসবে এমন পোশাক চান, যেগুলো বছরের অন্য সময়ও ব্যবহার করা যায়।
ক্যানভাস: শুরুতে ট্র্যাডিশনাল ফ্যাশন হাউসগুলো মধ্যবিত্তের পোশাক নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু আপনারা যখন রেডি-টু-ওয়্যার নিয়ে বাজারে আসেন, তখন টার্গেট কাস্টমার কারা ছিল?
এ প্রসঙ্গে রাইজের সৈয়দ হেলাল হোসেন সজীব বলেন, রেডি-টু-ওয়্যারের ক্ষেত্রে টার্গেট থাকে ১৮ থেকে ৩৫ বা ৪৫ বছরের ভোক্তা। তবে ব্র্র্যান্ডগুলো চায় সবার জন্যই পোশাক তৈরি করতে। হয়তো করেও। কিন্তু তরুণদের আকৃষ্ট করাই সবার মূল লক্ষ্য। কারণ, রেডি-টু-ওয়্যার এরাই বেশি ব্যবহার করে। ফলে সিনিয়রদের কথা তেমন ভাবা হয় না। তার মানে এই নয় যে তাদের জন্য কোনো কিছু থাকে না।
ক্লাবহাউসের রিদওয়ানা হক যোগ করেন, তাদের ব্র্যান্ড অবশ্য এই জায়গায় একটু আলাদা। কারণ, ক্লাবহাউস ব্র্যান্ড হিসেবে সব সময় খোঁজার চেষ্টা করে ক্রেতার কী প্রয়োজন। সেটাকে প্রাধান্য দিয়েই আমরা পণ্য তৈরি করি। এই যেমন কিছুদিন আগে কুকিং অ্যাপ্রন তৈরি করেছিলাম। কারণ, লকডাউনে সবাই রান্নাঘরমুখী হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেল, আমাদের সব অ্যাপ্রন বিক্রি হয়ে গেছে।
জিতু এই প্রসঙ্গের রেশ ধরে বলেন, সব ব্র্যান্ডেরই নির্দিষ্ট বিপণন কৌশল আছে। তারা সেভাবেই চিন্তা করে থাকেন। তবে যখন বলব, আমার ট্যাগলাইন ‘ফ্যাশন ফর অল’, তখন সবার কথা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে।
শরিফুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে নতুন কিছু বিষয় সংযোজন করেন। বলেন, কমিউনিকেশনে একটা বড় বিষয় ফটোশুট। সেখানে দেখা যায়, একই মডেল নিয়ে অনেকেই কাজ করছে। এটা আসলে আমাদেরই সমস্যা। তবে আগে এই ইন্ডাস্ট্রির যথাযথ অবকাঠামো ছিল না। আস্তে আস্তে সেটা হচ্ছে। বিশেষত বড় বড় প্রতিষ্ঠান এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসছে।
তবে মূল প্রশ্নটা ছিল ক্রয়সাধ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে টার্গেট গ্রুপ। এই প্রসঙ্গে রেড অরিজিনের এস এম সাইফুল কবির বলেন, আসলে কৌশল নির্ধারণে দুটো বিষয়কে তিনি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তা হলো, ক্রয়ক্ষমতা আর বয়স। আবার ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকেও আমরা চারটা সেগমেন্ট করতে পারি: লোয়ার মিড লেভেল, মিড লেভেল, হায়ার মিড লেভেল এবং হায়ার লেভেল। একদম ওপরের তলায় যারা, তারা ব্র্যান্ড-সচেতন। ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের খোঁজখবর রাখেন। আর অর্থের অভাব না থাকায় তারা দেশের বাইরেই শপিং করেন। বাংলাদেশে আসলে মিড ও হায়ার মিড লেভেলই মূল ভোক্তা। আর এদের মধ্যে কোন বয়সের ক্রেতা বেশি, সেটা মাথায় রেখেই কৌশল নির্ধারণ করা হয়।
এই প্রসঙ্গে সজীব আরও বলেন, আসলে ক্যাশ ফ্লো আসে ১৮-৪৫ বয়সীদের কাছ থেকে। সংগত কারণেই তাদেরকে মাথায় রাখা হয়।
তবে র নেশনের হাসিবুর রহমান বলেন, এখন বিজ্ঞাপনের জন্য বিলবোর্ড দেওয়া যায় না। ফলে মূল জায়গা হয়ে উঠেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। সেটা দেখার ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন সবচেয়ে ভালো ডিভাইস। এ ক্ষেত্রে তরুণেরাই তো সেটা দেখে থাকেন। সিনিয়ররা এখনো এই জায়গায় পিছিয়ে আছেন। ফলে তরুণদের বিষয়টা মাথায় রাখতেই হয়।
ক্যানভাস: পৃথিবীজুড়ে সব ক্ষেত্রেই নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে। প্রচারমাধ্যমেও নানা বদল ঘটেছে। প্রিন্টের পাশাপাশি এখন ডিজিটাল মিডিয়াও রয়েছে। সেই জায়গা থেকে আপনারা বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন মিডিয়ার প্রতি বেশি আস্থা রাখেন?
র নেশনের রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমার জায়গা থেকে এটি অবশ্যই ডিজিটাল মিডিয়া। কারণ, এটি দিয়ে সহজে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়।
সাইফুল কবির যোগ করেন, আমি একটু আগের থেকে আসতে চাই। যদি আশির দশকের দিকে তাকাই, তখন মানুষ প্রিন্ট এবং সাউন্ডের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হতো। এরপর বিলবোর্ড। আর এখন যোগ হয়েছে ডিজিটাল মিডিয়া। আসলে মানুষ যেখানে বেশি সময় কাটায়, সেটিই বেশি জনপ্রিয় হয়। তবে প্রিন্টের আলাদা একটি গুরুত্ব রয়েছে। সব বয়সী বা সব শ্রেণির মানুষ শুধু ডিজিটাল থেকে আকৃষ্ট হয় না। আর আমাদের বেইজ কিন্তু প্রিন্ট থেকে তৈরি। তাই এটিকে ভুলে গেলে চলবে না। তবে অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকেও কিন্তু কমিউনিকেশনের ধরনের পরিবর্তনও হয়।
টুয়েলভের সামিয়া আহমেদ বলেন, এই জায়গায় আমি একটু বলতে চাই। প্রিন্ট মিডিয়া কিন্তু বর্তমানে ডিজিটালের চেয়ে ব্যয়বহুল। সংবাদপত্রে যে টাকায় আমরা একটি বিজ্ঞাপন দিতে পারছি, ডিজিটালে সেই টাকায় পুরো কাম্পেইন হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে অনেকের প্রিন্টে উপস্থিতি কম। তবে আমরা মুখে মুখে প্রচারে বেশি বিশ্বাস করি। যাতে সবার কাছে বার্তাটা পৌঁছে যায়।
রাইজের সজীব বলেন, আমার কাছে মনে হয় মানুষের উপস্থিতি যেখানে বেশি, প্রচারের জন্য সেই মাধ্যমটিই ভালো। আগে মানুষ প্রিন্টে বেশি সময় ব্যয় করত। দেখা গেছে, একটি সংবাদপত্র পরিবারের সবাই পড়ে। এখন সেই সময় নেই। হয়তো পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা পত্রিকা পড়ছেন, বাকিরা ডিজিটালি নিউজ পড়ছেন। এখন কেউ সংবাদপত্রের জন্য অপেক্ষা করে না। তবে হাতের কাছে পেলে কিংবা বিশেষ কিছুর জন্য এখনো সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা অনেকেই ওল্টান। আর একটা বিষয় আমার মনে হয়। সংবাদপত্রে কোনো ব্র্যান্ডের উপস্থিতি তার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়। পত্রিকায় বা ম্যাগাজিনে একটি ব্র্যান্ড সম্পর্কে কিছু থাকলে মানুষ ভাবে, এটি একটি বড় কিংবা ভালো ব্র্যান্ড। আর ডিজিটালের বিশেষ একটি সুবিধা হচ্ছে, এখানে সরাসরি অডিয়েন্স টার্গেট করা যায়। আমি একটি টি-শার্টের প্রচার চালাতে চাচ্ছি, ডিজিটালে যারা এর ক্রেতা, শুধু তাদের কাছেই পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু প্রিন্টে তা নয়, এটি সবার জন্য। এখানে টার্গেটের ৪০ শতাংশ কভার করে। বলা যায়, বাকি ৬০ শতাংশ অপচয়।
ক্যানভাস: এবার ডিজিটাল মিডিয়ার অন্য একটি অংশ নিয়ে জানতে চাই। এখন আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রচারের আরও একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে ইনফ্লুয়েন্সার। আপনারা এটায় বিশ্বাস করেন কি না বা এ ধরনের প্রচার করতে চান কি না অথবা বাংলাদেশে এমন কেউ কি আছে, যাকে দিয়ে আপনাদের ব্র্যান্ডের এ ধরনের প্রচার করা সম্ভব?
গ্রামীণ ইউনিক্লোর শরিফুল এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের ক্ষেত্রে সেলিব্রিটি ইনফ্লুয়েন্সারের বেশি প্রভাব রয়েছে। একটি উদাহরণ দিতে চাই। একটি ক্যাম্পেইনের জন্য তাহসানকে আমাদের একটি আউটলেট ভিজিট করাব। তার আসার কথা চারটায়, আমি শপে গিয়েছি একটায়। দেখলাম, তখন থেকেই কিছু লোক শপের বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। অনেকেই জানতে চাচ্ছে, তাহসান কখন আসবেন। তাদের অধিকাংশই এসেছে ঢাকার বাইরে থেকে। আবার একজন বলেছে, তাহসান যে পোশাকগুলো পরেছে, সে-ও সেই সব পোশাকই কিনতে চায়।
ক্যানভাস: আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। আমি সেলিব্রিটি ইনফ্লুয়েন্সরদের কথা বলছি না। বলছি ডিজিটাল ইনফ্লুয়েন্সরদের কথা।
ক্লাবহাউসের রিদওয়ানা বলেন, আমরা একবার চিন্তা করলাম, এ ধরনের ইনফ্লুয়েন্সর নিয়ে কাজ করার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, তারা নিজেদের যেভাবে তুলে ধরে, তাতে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়ে। কারণ, তারা নিজেদের যেভাবে প্রজেক্ট করেন সেটা ব্র্যান্ডের সঙ্গে যায় না।
সাইফুল কবির যোগ করেন, আমার মতে আমাদের দেশে এখনো কোনো ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সর গড়ে ওঠেনি। অনেকে সেলিব্রিটিদের দিয়ে কাজটি করিয়ে নিচ্ছেন। কারণ, আমাদের দেশে কোনো ফ্যাশন আইকন এখনো তৈরি হয়নি। আর যাদের ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সর বলা হচ্ছে, তারা তো ওই অর্থে তা নয়। কেউ কেউ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পোশাক বিক্রি করছে। তাদেরই ইনফ্লুয়েন্সর বলা হচ্ছে। আসলে ইনফ্লুয়েন্সর হতে হলে ফ্যাশন আইকন হওয়া উচিত বলে মনে করি।
মিথের জিতু এ প্রসঙ্গে বলেন, যারা অনলাইনে লাইভ করে পোশাক বিক্রি করছে, তাদের ইনফ্লুয়েন্সর বললে ভুল হবে। আন্তর্জাতিকভাবে ইনফ্লুয়েন্সরদের উপস্থিতি ইনস্টাগ্রামেই দেখা যায়। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের মানুষ তেমন অভ্যস্ত নয়। তবে কেউ কেউ আছে, যারা নিজেদের ইনফ্লুয়েন্সর হিসেবে তৈরি করছে। ভবিষ্যতে হয়তো তারা ভালো করবে।
র নেশনের হাসিবুর রহমান বলেন, আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, আমাদের এখানে যারা তথাকথিত ইনফ্লুয়েন্সর হিসেবে আছে, তারা ব্যক্তিগত জীবন ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। তাই ব্র্যান্ডগুলো তাদের নিয়ে কাজ করতে একরকমের ভয়ই পায়। নিরাপত্তার অভাবে ব্র্যান্ডগুলো তাদের নিয়ে কাজ করে না।
জিতু আরও যোগ করেন, এখানে ব্র্যান্ডগুলোর নিজ নিজ পরিচয়ের বিষয় রয়েছে। কেউ হয়তো কানের দুল নিয়ে কাজ করছে। অন্য একটি ব্র্যান্ড হয়তো বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবে দেখছে। সুতরাং কোন ব্র্যান্ড কীভাবে নিজেদের মার্কেটিং করবে, এটাই বড় বিষয়।
ক্যানভাস: এখনকার নতুন ট্রেন্ড এফ-কমার্স। এখানেও কিছু অসামঞ্জস্য দেখা যায়। এগুলো আপনাদের ব্যবসায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে কি না। কিংবা আপনারা এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন কি না।
সাইফুল কবির বলেন, ভাবতে হয় অবশ্যই। কারণ, প্রতিযোগিতার বাজার। পিছিয়ে থাকা যাবে না। নইলে অন্য কেউ জায়গা দখল করে নেবে। এফ-কমার্স আমাদের দেশে একেবারেই নতুন। কিন্তু ই-কমার্সের কথা যদি বলি, এই করোনাকালে এটি একটা জায়গা করে নিয়েছে। এবং ভালো ব্যবসা হচ্ছে বলে আমার ধারণা। আর এফ-কমার্সের ব্যপক প্রভাব তৈরি হয়েছে বাজারে। কিন্তু পুরো বিষয়টি এখনো সংজ্ঞায়িত নয়। তা ছাড়া সব ব্র্যান্ড এখনো এটি নিয়ে কাজ করছে না। সবাই এখানে কাজ করলে এর মূল বিষয়গুলো বোঝা যাবে। এখনো যে এফ-কমার্স আমাদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলছে না, তা নয়।
শরিফুল বলেন, এফ-কমার্সের সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, এটি একক উদ্যোক্তার দখলে। বলা যায় ৬০ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। এর একটি কারণ হচ্ছে, এফ-কমার্সের এখনো কোনো মানদন্ড তৈরি হয়নি। ফলে বাজারে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ জন্য ব্র্যান্ডগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
রাইজের সজীব বলেন, এফ-কমার্সে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা, যা এখনো তৈরি হয়নি। যদিও এত অল্প সময়ে তা সম্ভবও নয়।
শরিফুল এই প্রসঙ্গে বলেন, ছবি নিয়েও ঝামেলা হয়। কারণ, আমাদের এখানে ফটোগ্রাফিতে টেকনোলজির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। ছবির সঙ্গে মূল পোশাক মেলে না। অনেক বেশি এডিট করাও হয়। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান রঙের বিষয়টি উল্লেখ করে।
ক্যানভাস: ই-কমার্স নিয়ে আপনাদের ভাবনা শুরু কবে থেকে। মহামারির সময় থেকে, নাকি আরও আগে থেকে? মহামারির সময় ই-কমার্স কতটা কাজে লেগেছে?
মিথের জিতু বলেন, মহামারির আগে আমাদের ফোকাস ছিল শপ নিয়ে। ভার্চ্যুয়ালি কিন্তু আমরা এতটা চিন্তা করিনি। মহামারি আমাদের এ বিষয়ে পুরোপুরি ভাবতে শিখিয়েছে। আমাদের মূল প্রস্তুতিটাও শুরু হয়েছে এই সময়। আজ অথবা কাল সবাইকে ই-কমার্সে আসতে হতো। কিন্তু করোনা চলে আসায় কাজটি করতে হয়েছে অনেকটাই চটজলদি।
রাইজের সজীব বলেন, মহামারির সময়ে ই-কমার্স তৈরি করা ছিল নিজেদের পরিচয় বাঁচিয়ে রাখার মতো। তা না হলে মানুষ হয়তো অনেক ব্র্র্যান্ডের নাম ভুলে যেত। তাই মানুষের কাছাকাছি থাকতেই নতুনভাবে ই-কমার্সের কথা চিন্তা করে।
টুয়েলভের সামিয়া জানান, আমাদের বিষয়টা ছিল একটু অন্য রকম। আমরা ২০১৯ সাল থেকেই ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত। করোনার শুরুতে এটি নিয়ে আরও ভালোভাবে কাজ শুরু করি। যার দরুন মহামারির সময় ক্রেতারা আমাদেরকে কাছে পেয়েছে।
ইউনিক্লোর শরিফুল উল্লেখ করেন, বাস্তবতাটা হচ্ছে, সবাই ই-কমার্সের কথা ভাবছিল বা প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছিল অনেকেই। এর মাঝে মহামারি শুরু হয়ে গেল। তখন সবাই জরুরি ভিত্তিতে ই-কমার্সের কাজ করে ফেলতে চাইল। কিন্তু এর পেছনেও বেশ কিছু কাজ করতে হয়। ই-কমার্স পরিচালনা বা তৈরির জন্য যথেষ্ট দক্ষ লোক বাজারে নেই। অনেকে এটি ব্যবহার করতে চাইলেও লোকবলের কারণে তাদের কাজ পিছিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত বাজারে যোগ্য লোকবলের অভাব আছে।
সাইফুল কবির জানান, সবারই এটি পরিকল্পনায় ছিল। কিন্তু পুরোপুরি প্রস্তুতি ছিল না। কেউ হয়তো একজিকিউশনে গেছে, কেউ যাওয়ার পথে ছিল। কারণ, এখানে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। কিন্তু হঠাৎ লকডাউন হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে।
ক্লাবহাউসের রিদওয়ানা বলেন, আমাদের ই-কমার্স সাইট প্রস্তুত ছিল। সেখান থেকে আমরা অনেকটাই ভাগ্যবান। কিন্তু এরপরও আমাদের নানা বাধার সামনে পড়তে হয়েছে। যেমন ডেলিভারির ক্ষেত্রে অনেক ঝামেলা হয়েছে। এমনকি অনেক ক্রেতাও আমরা হারিয়েছি। আবার ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। এই সময় আমরা আরও একটি কৌশল গ্রহণ করি। তা হচ্ছে থার্ড পার্টি ই-কমার্স সাইটগুলোর সঙ্গে কোলাবোরেশন। এখান থেকে আমরা ভালো সাড়া পেয়েছি।
হাসিবুর রহমান জানান, আমাদের আগে থেকে প্রস্তুতি থাকায় ঘরে বসে চেষ্টা করেছি ক্লায়েন্টদের চাহিদা মেটাতে। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি।
ক্যানভাস: করোনায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে ব্র্যান্ডগুলোর কত দিন লাগবে বলে আপনারা মনে করেন? এখানে যোগ করতে চাই, বিদেশে থেকে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে যেসব পোশাক আসে, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা আসলে কতটা অসম বলে আপনারা মনে করেন?
এ বিষয়ে শরিফুল বলেন, আমাদের ক্ষেত্রটা আলাদা। কারণ, ইউনিক্লো এখান থেকে কোনো লাভ নেবে না। ফলে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা পুষিয়ে নিয়ে তবেই এক্সপানশনে যেতে হবে।
জিতু জানান, আমাদের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে প্রডাকশন। দেশের ব্র্যান্ডগুলো টিকে থাকে মূলত ঈদের কেনাবেচার ওপর নির্ভর করে। করোনার জন্য গত বছর ঈদে আমাদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে। আর বিদেশে অনেকেই শপিং করতে যায়। তবে একটি বড় অংশ যায় পাশের দেশ ভারতে। এ বিষয়ে বলতে গেলে আমাদের দেশেও যদি সেই ক্যাটাগরি বা কোয়ালিটির পোশাক তৈরি হয়, তবে তারা বিদেশে যাওয়া কমিয়ে দেবে।
হাসিবুর রহমান জানান, আমার অবজারভেশন একটু অন্য রকম। আমি মনে করি, যারা কেনাকাটা করতে ভারতে যায়, তারা রেডি-টু-ওয়্যার কিনতে যায় না। সেখান থেকে এথনিক ওয়্যারই কিনে থাকে। আমার ব্র্যান্ডের কথা বলতে পারি, বছরজুড়ে পাঞ্জাবির চেয়ে শার্টের বিক্রি বেশি। এই ক্ষেত্রে যেসব ব্র্যান্ড এথনিক ওয়্যার নিয়ে কাজ করে, তাদের ক্ষতিটা বেশি হয় বলে আমি মনে করি।
ক্যানভাস: করোনা আপনাদের চিন্তার কোন জায়গাগুলোতে প্রভাব ফেলেছে বা কতটা নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে?
রেড অরিজিনের সাইফুল কবির এ বিষয়ে জানান, করোনা আমাদের কমফোর্ট নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। পাশাপাশি দামটাও বড় একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার সময় যেহেতু মানুষকে ঘরেই বেশি সময় কাটাতে হয়, তাই তারা খোঁজেন স্বস্তিদায়ক পোশাক। যার পোশাকের দাম যত কম, মানুষের চাহিদা সেখানেই বেশি।
গ্রামীণ ইউনিক্লোর শরিফুল বলেন, পুরো মার্কেটের কথা যদি বলি, একটি জরিপে ক্রেতার নতুন চাহিদা উঠে এসেছে। তার মধ্যে রয়েছে প্রতিদিনের পোশাক, কম দাম, টেকসই পোশাক। এ বছর মানুষ সাধারণ পোশাকই বেশি পছন্দ করে।
ক্লাবহাউসের রিদওয়ানা উল্লেখ করেন, আমরা মহামারির সময় আরামদায়ক পোশাকে গুরুত্ব দিই। ওই সময়ে দুটি কালেকশন বাজারে নিয়ে আসি। একটি স্লিপওয়্যার আর একটি অফিস ওয়্যার। এই দুটিতেই ক্রেতাদের সাড়া ভালো ছিল।
হাসিবুর রহমান বলেন, আমরা টেকসই ধারণাটিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। রেডি টু ওয়্যার এবং ক্যাজুয়াল কালেকশন যাতে আরও বেশি টেকসই হয়, সে বিষয়টিই এখন আমাদের কাছে মুখ্য।
টুয়েলভের সামিয়া জানান, আমরা চাচ্ছি কোয়ালিটি দিয়ে মানুষের মাঝে টিকে থাকতে। এ ছাড়া একটি বিষয় আমরা খেয়াল করেছি। মানুষের কাছে যেহেতু টাকা নেই, আমরা ইএমআইতে পোশাক বিক্রি শুরু করি। এতেও ভালো সাড়া মিলেছে।
শরিফুল ও জিতু বলেন, ইএমআই নিয়ে আগে কাজ শুরু করলেও সেভাবে সাড়া মেলেনি।
জমে ওঠা আড্ডার শেষ দিকে যোগ দেন ওটুর আসিফ ইকবাল। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, অতিমারিকালে তার ব্র্যান্ড কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের ওই সময়ে পরিকল্পনায় ছিল বৈশাখ ও ঈদ। অন্য ব্র্যান্ডও সেভাবেই এগোচ্ছিল। তবে অতিমারিতে সবাই ক্ষতির মুখে পড়েছে। এটা অবশ্য নির্ভর করেছে কোন ব্র্যান্ড কত বড় তার ওপর। আমরা ভেবেছি আমাদের ব্র্যান্ডকে সাসটেইন করতে গেলে কী করতে হবে। তখন আমরা মাস্ক ও পিপিই তৈরি শুরু করি। সেগুলো বিক্রিও করেছি। ফলে আমাদের লোকজনকে ছুটি দিয়েও তাদের আবার ঢাকায় নিয়ে আসতে হয়েছে। এর বাইরে বলতে গেলে আমরা অনলাইন নিয়ে ভেবেছি। সেদিকে ফোকাস করেছি এবং মে মাসে ই-কমার্স শুরু করে ফল পেয়েছি। আমার প্রতিষ্ঠান এভাবেই টিকে থাকতে পেরেছে। এখন আমাদের নতুন কৌশল হলো অনলাইন। আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি। তবে আরও কিছুটা সময় হয়তো লাগবে।
আড্ডায় অংশগ্রহণ করেন মিথের ব্র্যান্ড ম্যানেজার মো. সাব্বির নেওয়াজ জিতু, গ্রামীণ ইউনিক্লোর ম্যানেজার মার্কেটিং মো. শরিফুল ইসলাম, রাইজের সিনিয়র মার্কেটিং অফিসার সৈয়দ হেলাল হোসেন সজীব, ক্লাবহাউসের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিজিটাল মার্কেটিং অফিসার রিদওয়ানা হক, র নেশনের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হাসিবুর রহমান ও ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার রাকিবুল ইসলাম, টুয়েলভের মার্কেটিং অ্যান্ড ক্যাটাগরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান সামিয়া আহমেদ, রেড অরিজিনের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং এস এম সাইফুল কবির, ওটুর ওনার আসিফ ইকবাল। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান।
ছবি: মাল্টিপ্লাই
লোকেশন: মিরাজ