ফুড ট্রাভেল I নবাবি খাবারের শহর
মূলত খাদ্য-সংস্কৃতিই শহরটির প্রধান আকর্ষণ। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মোগল আভিজাত্য আর উদ্ভাবনী রন্ধনপ্রণালির বৈচিত্র্য। ঘুরে এসে জানিয়েছেন মোহাম্মদ মাহবুবুর নূর
ভোর পাঁচটায় অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙল। ডিসেম্বর। দিল্লির শীতকাল, তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস; সঙ্গে প্রচন্ড কুয়াশা। ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। রাজস্থান থেকে দিল্লি এসেছি, উঠেছি নয়াদিল্লি রেলস্টেশনের পাশে, পাহাড়গঞ্জে। দিল্লি ভ্রমণ শেষে এবার লক্ষ্ণৌ যাত্রা। সব প্রস্তুতি সেরে স্টেশনের উদ্দেশে বের হলাম। হোটেলের সামনে থেকে একটি অটো নিলাম। পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেলাম স্টেশনে। তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। রাস্তায় তেমন লোকজন না থাকলেও স্টেশনে প্রচন্ড ব্যস্ততা। লক্ষ্ণৌ যাচ্ছি স্বর্ণ শতাব্দী এক্সপ্রেসে।
ট্রেন নির্ধারিত সময় ভোর ছয়টা দশ মিনিটে যাত্রা শুরু করল। দিল্লিকে পেছনে ফেলে লক্ষ্ণৌর পানে ছুটছে। ধীরে ধীরে সূর্য লাল আভা ছড়িয়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে ছুটছি লক্ষ্ণৌর দিকে। ট্রেনে কোনো ফেরিওয়ালা বা উটকো লোক নেই। কুয়াশার কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা দেরি হলো। গাজিয়াবাদ, আলীগড়, টান্ডুলা, এটোয়া এবং কানপুর সেন্ট্রাল হয়ে বেলা দুইটা দশে ট্রেন প্রবেশ করে লক্ষ্ণৌ জংশন স্টেশনে। মোগল স্থাপত্যরীতিতে ব্রিটিশের নির্মিত স্টেশন। লক্ষ্ণৌতে আধুনিক স্থাপত্যরীতির ছোঁয়া লাগলেও স্টেশনটির নকশায় সামান্য পরিবর্তন করা হয়নি। ব্রিটিশ স্থপতি জে এইচ হার্নিম্যানের ডিজাইনে লক্ষ্ণৌর কেন্দ্রীয় স্টেশনটি ‘চারবাগ স্টেশন’ নামেই পরিচিত। এর সামনে মোগল ঐতিহ্যে তৈরি বিশাল বাগান রয়েছে। মোগলদের কাছ থেকে ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তগত করলেও তারা মোগল ঐতিহ্যকে বজায় রেখেছে এবং ধারণ করেছে।
এ এন আর হোটেলে পৌঁছলাম। নাকা হিন্দোলা পুলিশ ফাঁড়ির উল্টো দিকে। হোটেলের সামনের রাস্তাটি বেশ প্রশস্ত এবং সোজা চলে গেছে চারবাগ রেলস্টেশনে। হোটেলের নিচতলায় মার্কেট, দোতলায় অভ্যর্থনা। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রুমে এলাম। বিকেলবেলা বের হলাম শহর ভ্রমণে। হেঁটে হেঁটে ঘুরছি। শহরের এই অঞ্চলটি পুরোনো। দুপাশে ভবনগুলো বেশ আগের, তবে নবাবি আমলের নয়। রাস্তার দুদিকে বিভিন্ন দোকান। ছোট ছোট রেস্টুরেন্টে কচুরি, জিলাপি, হালুয়া বিক্রি হচ্ছে। একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ডাকলাম চকে ‘টুন্ডে কাবাবী’তে যাওয়ার জন্য। ড্রাইভার জানাল, বৃহস্পতিবার টুন্ডে কাবাবী বন্ধ। সে নিয়ে এলো ক্যান্টনমেন্ট রোডে, বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট ‘দস্তরখান’-এ। অভিজাত। লক্ষ্ণৌর ঐতিহ্যবাহী সব খাবারই এখানে পাওয়া যায়।
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের সময় অযোধ্যা দিল্লির সালতানাতের অন্তর্গত ছিল। সম্রাট হুমায়ুনের শাসনামলে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সম্রাট আকবরের সময় গুরুত্বপূর্ণ সুবায় পরিণত হয়। মোগল সম্রাট মুহম্মদ শাহ ১৭২২ সালে সাদাত খানকে অযোধ্যার সুবাদার নিয়োগ করেন। তিনিই আউধে নবাবি বংশের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। অযোধ্যা সুবার পাঁচটি জেলার অন্যতম ছিল এই লক্ষ্ণৌ। অযোধ্যাকে স্থানীয় মুসলমানরা আউধ বা অওধ অথবা অবধ বলতেন।
লক্ষ্ণৌর রন্ধনশিল্প, মোগল-অনুপ্রাণিত। আউধের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শুরু চতুর্থ নবাব শুজাউদ্দৌল্লা এবং বাংলার নবাব মীর কাশিমের যৌথ শক্তি ইংরেজদের কাছে পরাজিত হবার পরে। বক্সারের যুদ্ধের পর শাসনব্যবস্থায় ইংরেজদের হস্তক্ষেপের কারণে নবাব শুজাউদ্দৌলা রাজধানী ফয়জাবাদ থেকে লক্ষ্ণৌ স্থানান্তর করেন এবং রাজনীতি অপেক্ষা সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে ভিন্নধারায় আউধী রন্ধনশিল্পের বিকাশ এবং সমৃদ্ধির দিকে যাত্রা শুরু হয়। লক্ষ্ণৌকে বলা হয় নবাব, কাবাব এবং চিকনকারির শহর। এখানকার খাবার মোগল-প্রভাবিত হলেও মোগলাইয়ের মতো গুরুপাক নয়। বিভিন্ন ধরনের মসলার পরিমিত ব্যবহার লক্ষ্ণৌর রন্ধনশৈলীকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। নবাবদের হেঁসেলে হেকিম নিযুক্ত করা হতো, যারা সুস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে রান্নায় ব্যবহৃত মসলার অনুপাত নির্ধারণ করে দিতেন। এ ছাড়া কোন মসলা শরীরকে গরম ও ঠান্ডা করে, তা চিহ্নিত করে সেসবের অনুপাত নির্ধারণ করতেন। খাদ্যের রং, স্বাদ এবং সুবাসের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। কেওড়া ও গোলাপজলের পরিমিত ব্যবহার ছাড়াও খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত প্রাণীটিকে জাফরানের ট্যাবলেট খাওয়ানোর চল ছিল। ফলে প্রাণীর মাংসে জাফরানের উপাদানসমূহের উপস্থিতি থাকত। মোগল ধারায় অনুপ্রাণিত লক্ষ্ণৌ খাদ্যশৈলীতে পারস্য, তুর্কি, মধ্য এশিয়ার প্রভাব ছাড়াও পরবর্তীকালে নবাব সাদত আলী খানের সময় ফরাসি, ইংরেজ এবং পর্তুগিজ ধারা যুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র ‘আউধী কুজিনের’ জন্ম হয়েছিল, যা আজও টিকে আছে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকেই দিল্লির পতনের সূচনা এবং লক্ষ্ণৌর উত্থান। অযোধ্যার রাজধানী এই অঞ্চলে স্থানান্তরের পরে নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ্ণৌকে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানীতে পরিণত করে। নবাব এবং অভিজাতদের বড় বড় বাবুর্চিখানা ছিল। ফলে ভারতবর্ষের প্রথম শ্রেণির বাবুর্চিদের এখানেই আবির্ভাব হয়েছিল। নতুন নতুন খানার উদ্ভাবন এবং রান্নায় বৈচিত্র্য তখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। দিল্লি এবং অন্যত্র থেকে আগত বাবুর্চিরা স্থানীয় প্রথা পদ্ধতির অংশীদার হয়ে নতুন নতুন স্বাদ সৃষ্টি করে তাদের কৃতিত্ব প্রদর্শন করত।
দস্তরখান রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম। ধ্রুপদি সাজে রেস্টুরেন্টটিতে মৃদুস্বরে ‘পাকিজাহ’ ছবির মিউজিক বাজছে। টেবিলে বসতেই ওয়েটার মেনুকার্ড দিয়ে গেল। লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত মাটন কোরমা, কাকোরি কাবাব, মোগলাই পরোটা, খামিরি রুটি, ফিরনি এবং শাহি টুকরা অর্ডার করলাম। পনেরো মিনিটের মধ্যেই খাবার চলে এলো। মাটন কোরমার স্বাদ অপূর্ব। কোনো মসলার স্বাদই পৃথক করে বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের মোগলাই পরোটা লক্ষ্ণৌর এই পদ হতে ভিন্ন। এখানে ময়দা দুধ এবং ডিম দিয়ে ময়ান করে বড় আকারে পরোটা বানিয়ে তা উল্টো কড়াইতে হালকা তেলে চেপে চেপে ভাজা হয়। ফলে মচমচে, নরম অপূর্ব পরোটা তৈরি হয়।
রেস্টুরেন্টে শাহি টুকরা খেতে এত মনোমুগ্ধকর যে বাবুর্চির কাছ থেকে রেসিপি নিতেই হলো। পাউরুটি প্রথমে ঘি-এর মধ্যে বাদামি করে ভাজা হয়। অতঃপর তা দুধের পরিবর্তে গোলাপজল, এলাচি ও দারুচিনি মিশ্রিত চিনির শিরায় ভেজানোর নিয়ম। রসালো রুটির ওপর ক্ষীর, মাওয়া, বাদাম দিয়ে তা পরিবেশন করা হয়। বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাবার শেষ করে হোটেলে ফিরলাম।
লক্ষ্ণৌ ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। ঘুম ভাঙল সকাল সাতটায়। রাতে খুব ভালো ঘুম হয়েছিল। রুমের সবকিছু ঝকঝকে, মনে হচ্ছে আমিই প্রথম গ্রাহক। ভাড়ার সঙ্গে সকালের নাশতা সংযুক্ত। লক্ষ্ণৌ এসেছি অথচ গতানুগতিক নাশতা খাব, সেটা তো হয় না, তাই দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চকের উদ্দেশে। নাশতা করব বিখ্যাত ‘রহিম নেহারী’তে। একটি অটো নিয়ে চলে এলাম চকে, গোল দরজার সামনে। অটো থেকে নামতেই নজর গেল, সারি সারি ফেরিওয়ালা বড় বড় পাত্রে হালকা জাফরান রঙের কী যেন বিক্রি করছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করাতে তারা জানাল, এটি ‘মালাইয়ো’। পরে বুঝতে পারলাম, আসলে ‘নামশ’। হাকিম হাবিবুর রহমান তার ‘ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে’ গ্রন্থে নামশের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, অভিজাতদের বাড়িতে এটি তৈরি হতো। লক্ষ্ণৌর বাজারে এটি পাওয়া যেত। সে ধারা আজও বজায় রয়েছে।
শীতকালে দুধ পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে সারা রাত কুয়াশার মধ্যে বাইরে রেখে দেওয়ার নিয়ম, সকালে তা ফেটিয়ে ফেনার মতো তৈরি হয়। তা সংগ্রহ করে জাফরান ও চিনি মিশিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু নামশ। এটি শুধু শীতকালেই তৈরি হয়। লক্ষ্ণৌতে সাধারণের মধ্যে মালাইয়ো নামে পরিচিত হলেও অভিজাতদের মধ্যে ‘নামশ’ নামটির প্রচলন রয়েছে। দিল্লি এবং বেনারসেও এটি তৈরি হয়- ‘দৌলত কি চাট’ ও ‘মালাই মাখ্ন’ নামে। নামশ খেলাম। পরিবেশনের সময় ওপরে বাদাম ও সিলভার ফয়েল দেওয়া হয়েছিল। চমৎকার স্বাদ, না খেলে অনুভব করা সম্ভব নয়। এবার রহিম নেহারি খুঁজতে শুরু করলাম। কেউই সন্ধান দিতে পারল না। এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘আপ রাহিম নেহারি ভুন্ড রাহা’। বুঝলাম ‘রাহিম’-এর জায়গায় রহিম বলায় তারা বুঝতে পারছিল না। এটি বিখ্যাত তার নেহারি এবং কুলচার জন্য। খাসির পায়া দিয়ে তৈরি নেহারি। ঝোলের ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য ছোলার ডালের বেসন ব্যবহার করা হয়েছে। কুলচা তৈরি হয়েছে দুটি ময়দার রুটি বানিয়ে তা একত্র করে তন্দুর চুলাতে সেঁকে। ফোলা কুলচাগুলোর ভেতরটা নরম এবং বাইরের অংশ বেশ মচমচে। আর সারা রাত ধরে রান্না করা নেহারি তো লা-জবাব।
নাশতা শেষ করে চলে এলাম লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত বড় ইমামবাড়া দেখতে। এখানে হুসেনাবাদ দিঘি-সংলগ্ন আরেকটি স্থাপনা ক্লক টাওয়ার দেখে অগ্রসর হলাম ছোট ইমামবাড়ার দিকে। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। খেতে হবে লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত পুলাও। তাই গন্তব্য আমিনাবাদে ওয়াহিদ বিরিয়ানি। গাইডকে ছেড়ে দিয়ে একটি অটো নিলাম সেখানে যাওয়ার জন্য।
আমিনাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা হওয়াতে রাস্তায় যানবাহনের ভিড়। ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্ণৌর খাবারের জন্য শহরে বিখ্যাত কিছু রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইদ্রিস বিরিয়ানি, ওয়াহিদ বিরিয়ানি, টুন্ডে কাবাবি, নওশীজান, দস্তরখান ইত্যাদি। রেস্টুরেন্টগুলো পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা ছিল। ওয়াহিদ বিরিয়ানিতে পৌঁছেও বিড়ম্বনায় পড়লাম। ভেতরে বসার জায়গা নেই। বাইরে অপেক্ষা করছি। ওয়াহিদ বিরিয়ানির পাশেই টুন্ডে কাবাবি, যেখানে রাতের খাবার খাব। এ ছাড়া আশপাশে চার-পাঁচটা রেস্টুরেন্ট রয়েছে, তবে লোকজন ‘ওয়াহিদ এবং ‘টুন্ডে’র বাইরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে।
ভারতীয় রন্ধনপ্রণালিগুলোর মধ্যে মূলত তিনটি ধারা বিশ্বব্যাপী বেশি পরিচিত- মোগল, হায়দরাবাদি এবং লক্ষ্ণৌর। মজার বিষয় হচ্ছে, কলকাতায় বিরিয়ানির আগমন ঘটেছিল নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর হাত ধরেই। ঢাকা চার শ বছরের পুরোনো শহর হলেও আমাদের নিজস্ব ধারার কোনো রন্ধনপ্রণালি সৃষ্টি হয়নি। হাকিম হাবিবুর রহমানের ‘ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে’ গ্রন্থে যেসব খাবারের বর্ণনা রয়েছে, তা এখন ইতিহাস। আমরা চর্চা করছি ভিন্ন শহরের রন্ধনপ্রণালি, বরং কলকাতায় ঢাকাই পুলাও-পরোটার প্রচলন রয়েছে।
ছবি: লেখক