ফিচার I পিপীলিকার শহর
তাদেরও রয়েছে আবাসস্থল এবং বিস্ময়কর স্থাপত্য। আছে নিজস্ব নগরকাঠামো। লিখেছেন কনক বিশ্বাস
পিঁপড়াদেরও ঘরবাড়ি আর শহর আছে। কিছু যাযাবর প্রজাতি ছাড়া অন্য সবার রয়েছে আবাসস্থল। মাটির নিচে বাড়ি বানানো এদের প্রাচীন স্বভাব। তবে অনেকেই মাটির ওপরে, গাছের ফাঁপা কান্ড, শিলার গর্ত, পাতাও বেছে নেয়। অধিকাংশ প্রজাতি পিপীলিকা কমবেশি স্থায়ী বাসা বানায়। এর আকার-আকৃতি নির্ভর করে নির্মাণসামগ্রীর ওপর।
যাযাবর পিঁপড়ারা দিনের বেলা ঘোরাফেরা করে রাতে বিশ্রামের জন্য রানির কাছে ফিরে আসে। এদের বাসা গাছের ডালে বা পাতায় ঝুলে থাকে। কখনো ফাঁপা কান্ড বা গুঁড়ি বেছে নেয়। সেনাছাউনির মতো এসব অস্থায়ী বাসা বেলুনাকার, কোণাকার অথবা তাঁবুর মতো হতে পারে। বেশির ভাগ প্রজাতি নিজেরাই গর্ত করে বাসা বানায়, তাতে ব্যবহৃত হয় নানা উপকরণ। নরম ভেজা মাটি পাওয়ার লক্ষ্যে তারা গর্তের অনেক গভীরে প্রবেশ করে। প্রজাতিভেদে বাসা নির্মাণের ধরনও আলাদা।
মাটিতে গর্ত করার প্রধান হাতিয়ার পিঁপড়ার ম্যান্ডিবল। এর সাহায্যে মাটি টুকরো টুকরো করে কেটে পা দিয়ে ওপরের দিকে ঠেলে দেয়। এই কাজে সামনের পায়ের ভূমিকাই মুখ্য। ভেতরের সুড়ঙ্গগুলো মসৃণ ও মজবুত করার জন্য ব্যবহার করে লালা বা অন্য কোনো গ্রন্থির নিঃসৃত রস। এসব প্লাস্টারের মতো কাজ করে।
কোনো প্রজাতির বাসা মাটির মাত্র ২-৫ সেন্টিমিটার গভীরে বিস্তৃত। আবার Pogonomyrmex পিঁপড়াদের বাসা দুই মিটার পর্যন্ত নিচে। Lasins প্রজাতির বাড়িতে এত বেশি সরু সুড়ঙ্গ থাকে যে তা দেখতে অনেকটা স্পঞ্জের মতো। কোনো কোনো পিঁপড়ার বাসা বহু বছর টেকে। অনেক সময় বন-জঙ্গল, ঝোপঝাড়ের মেঝেতে উইয়ের ঢিবির মতো এদের বড় বাড়িও দেখা যায়। সেখানে ঢোকার জন্য থাকে অনেক পথ, আর ভেতরে অসংখ্য কুঠুরি। এমন একটি বড় বাসায় থাকতে পারে লাখের বেশি পিঁপড়া। মাটির নিচে এদের বাসস্থান হয় কখনো অনুভূমিকভাবে বিস্তৃত, আবার কখনো নিচের দিকে খাড়া। এভাবে প্রসারিত হলেও মূল সুড়ঙ্গের দুপাশে থাকে ছোট-বড় নানা আকৃতির পাশর্^ সুড়ঙ্গ। যেখানে ডিম আর বাচ্চাদের থাকার জায়গা। সুড়ঙ্গগুলো লম্বায় কয়েক সেন্টিমিটার ও ব্যাসে এক সেন্টিমিটার হতে পারে। বাসা থেকে বাইরে যাবার পথ থাকে এক বা একাধিক। নানা আকৃতির প্রকোষ্ঠগুলোর মেঝে সাধারণত মসৃণ ও সমতল। বীজভুক পিঁপড়াদের মধ্যে এ ধরনের বাসা তৈরির প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
গর্তের মুখে বাটি বা চাঁদ আকৃতির উঁচু আইলের মতো গঠন চোখে পড়ে। অনেক সময় তা আগ্নেয়গিরির জ¦ালামুখের মতো হয়। বাসার আয়তন অনুযায়ী এগুলোর আকার ছোট-বড় হতে পারে। মাটির নিচে এরা আশ্চর্য পদ্ধতিতে তৈরি করে বহুতলাবিশিষ্ট কুঠুরি। মেঝে, দেয়াল আর ছাদ থাকে অনন্য কারুকাজে ভরা। প্রকোষ্ঠগুলোর সিলিং যেন ধসে না যায়, সে জন্য তৈরি হয় স্তম্ভ ও ছোট দেয়াল। মাটির সূক্ষ্ম কণার সঙ্গে লালা মিশিয়ে শ্রমিক পিঁপড়ারা দেয়াল তৈরি করে। কখনো কখনো এগুলো মজবুত করতে ঘাসের পুরু কান্ড বা পাতা ব্যবহৃত হয়। Attini উপজাতির পিঁপড়ারা বাসার ভেতরে খাদ্যের জন্য ছত্রাক চাষ করে বলে সেগুলোর গঠনও ছত্রাক আকৃতির। এই খাবার জন্মাতে বিশেষ আবহাওয়ার দরকার হয়, এমন প্রজাতির দেখা মেলে পূর্ব গোলার্ধে। বাইরের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে ভেতরের আর্দ্রতা ঠিক রাখতে হয়। তবে এই পিঁপড়ার ছোট প্রজাতিগুলোর বাড়ি তুলনামূলক সরল ধরনের।
আবার Atta পিপীলিকাদের কলোনি বা শহর অনেক বড় এবং গভীর। এতে বাস করে কয়েক লাখ সদস্য। প্রথমে রানি সাধারণ একটি গর্ত তৈরি করে। পরে তার দুহিতা শ্রমিক পিঁপড়ার সংখ্যা বাড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে বাসাও বড় হতে থাকে। একসময় তা মাটির তলায় ৫ থেকে ৪৭ বর্গমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এদেরও থাকে একাধিক ছিদ্রপথ। বাসার গঠন এত জটিল যে, বাইরে থেকে কীটনাশক স্প্রে করলেও অধিকাংশ সদস্য থাকে নিরাপদ।
মাটির ধরন ও ঢালের অবস্থার জন্য পিঁপড়ার বাসার গঠন পরিকল্পনা বদলে যেতে পারে। Atta sexdens প্রজাতির ঘরবাড়ির নকশা ও আকার সব সময় প্রায় একই রকম। এদের বড় বাসাগুলোর দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২০ মিটার এবং গড় ব্যাস ৩ সেন্টিমিটার। গবেষকেরা বলছেন, Atta প্রজাতির বড় বাসার খননকাজে প্রায় ৪০ টন মাটি কাটার প্রয়োজন হয়। এতে থাকতে পারে ১০০টি পর্যন্ত ছত্রাক বাগান। বাসায় ঢোকার পথগুলো খানিকটা নিচে নেমে বৃত্তাকার এক সুড়ঙ্গের সঙ্গে মেশে। বাইরে থেকে বয়ে আনা পাতা এই সুড়ঙ্গে কিছু সময় জমা রেখে পরে সেগুলো ছত্রাকের বাগানে সরবরাহ করে। গাছ থেকে পাতা বা ফুলের পাপড়ি কেটে বড় শ্রমিকেরা যখন বয়ে নিয়ে যায়, তখন মনে হয় মাথায় ছাতা দিয়ে এরা মিছিল করে চলেছে।
পিপীলিকার বাসার ভেতরের তাপমাত্রা ও বাইরের তাপমাত্রায় পার্থক্য থাকে কি না, থাকলে তা কতটুকু, সেসব তথ্যে জানা যায়নি। Atta cephalotes নামের পিঁপড়াদের বাসার ভেতরের তাপ বাইরের চেয়ে কয়েক ডিগ্রি বেশি হতে দেখা গেছে এবং ছত্রাক বাগানে তা আরও একটু বেশি। এদের বাসার আর্দ্রতা প্রায় সব সময়ই ৯০% কখনো আরও বেশি।
গবেষণায় জানা যায়, যদিও পিঁপড়াদের প্রথম জীবন শুরু হয়েছিল মাটিতে আবাস নির্মাণের মাধ্যমে, তবে খাদ্য সংগ্রহের জন্য উদ্ভিদ বা উঁচু গাছের ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। তাই তারা একসময় যাতায়াতের সুবিধার জন্য গাছেই বাসা বানাতে শুরু করে। অনেক প্রজাতির পিঁপড়া নানা আকৃতির বাড়ি তৈরি করে গাছের বিভিন্ন অংশে। সেখানেও তারা গড়ে তোলে তাদের শহর। বৃক্ষে নগর গড়ে তুলতে গিয়ে পরিবেশের শুষ্কতার বিরুদ্ধে তাদের হয়ে উঠতে হয়েছে প্রতিরোধী। এ জন্য তারা বেছে নেয় অপেক্ষাকৃত ঘন ছায়াযুক্ত স্থান—ফাঁপা কান্ড বা ফোকর। আবার পাতার চারদিকে নিজেদের লালা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে বাসা বানায়। তাতে তারা যথেষ্ট কারিগরি কৌশল ব্যবহার করে। প্রথমে কাছাকাছি দুটি পাতাকে একদল পিঁপড়া কামড়ে টেনে ধরে থাকে। তারপর শুরু হয় মিলেমিশে কাজ করার এক অনবদ্য তৎপরতা। সেখানেও বাস করে অসংখ্য পরিবার। তাদের খাবার সংরক্ষণের ঘর থেকে শুরু করে থাকে নিরাপত্তা কুঠুরি, রানি ও শ্রমিকদের জন্য পৃথক বাসস্থান। বাসার নিরাপত্তা, উষ্ণতা ও আর্দ্রতা ঠিক রাখার জন্য বাইরে যাতায়াতের পথ বড় মাথাবিশিষ্ট শ্রমিকেরা বন্ধ করে রাখে। এদের মাথায় থাকে ফ্রাগমোটিক ডিস্ক নামে এক বিশেষ গঠন। এটি প্রসারিত করে তা দরজার কপাটের মতো কাজে লাগায়।
মাটির নিচে বা গাছের ফাঁপা কান্ডে অথবা পাতা জোড়া লাগিয়ে—যেভাবেই বাসা বানানো হোক না কেন, পিঁপড়াদের এই পরিকল্পনায় মানুষ বিস্মিত না হয়ে পারেনি।
এমনকি উন্নত রাষ্ট্রের বড় শহরগুলোতে যানজট এড়ানোর জন্য পিপীলিকার চলাচলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে গবেষণা চলছে। এই বিষয়ে জার্মানির এক গবেষক মিথাইল শ্রেকেনব্যার্গ মানুষ ও পিঁপড়ার মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে ক্ষুদ্র প্রাণীটির কাছে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে পিপীলিকার আচরণও নকল করতে পারবে। সেটাই আশার আলো দেখাচ্ছে। এতে পরিবহনে ধারণক্ষমতা আরও অনেক বেড়ে যাবে, ফলে শহর হয়ে উঠবে আরেও বাসোপযোগী।
ছবি: ইন্টারনেট