সেলুলয়েড I অন্তর্যাত্রা
চিত্রনাট্য : তারেক মাসুদ
পরিচালনা : তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ
চিত্রগ্রাহক : গায়েতেইন রওসিয়াউ
অভিনয় : সারা জাকের, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আব্দুল মমিন চৌধুরী, নাসরিন করিম, রোকেয়া প্রাচী, হ্যারল্ড রশিদ, রিফাকাত রশিদ তিয়াস।
দৈর্ঘ্য : ৮৬ মিনিট
মুক্তি : ২০০৫ [যুক্তরাজ্য], ২০০৬ [বাংলাদেশ]
এ ছবির গল্পের পটভূমি চা-বাগান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নতুন প্রজন্মের অভিবাসীরা নিজের দেশ কীভাবে আবিষ্কার করে— শিকড় খোঁজার সেই কাহিনি নিয়ে সিনেমাটি নির্মিত।
বাবার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সোহেল মায়ের সঙ্গে লন্ডনে চলে গিয়েছিল, একেবারে শৈশবে। সেখানকার নাগরিকও হয়ে যায় তারা। হঠাৎ একদিন খবর আসে, তার বাবা মারা গেছে। কিশোর সোহেল মা শিরিনের সঙ্গে বাংলাদেশে আসে। এত দিন দেশ এবং আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে সে কিছুই জানত না। শিরিন তার কাছে সবই গোপন রেখেছিল। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী সালমা এবং তাদের মেয়ে রিনির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এই প্রথম সে দেখে দাদা, ফুফু, ফুফা এবং মৃত বাবাকে। এই সূত্রে সে অনুভব করতে থাকে জনককে। জন্মভূমির প্রতি তার টান তৈরি হয়। সে বুঝতে পারে, বাবার মৃত্যু শুধু তাকেই নয়, তার মাকেও ফিরিয়ে এনেছে দেশ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কাছে। সে আরও অনুভব করে, এখানে তাকে বারবার ফিরে আসতে হবে। তার মনে পড়ে, ক্লাসের বন্ধুরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সব সময় বিব্রত বোধ করেছে সে। দেশটি তার কাছে পোস্টকার্ডের বেশি কিছু ছিল নয়। ‘অনেকটা বাবার মতো, যিনি আমার কাছে একটা ফ্রেমে বাঁধা ছবিমাত্র’। এখন সেই পোস্টকার্ড জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সবুজ দিগন্ত নিয়ত বদলে যাচ্ছে…।’
সিলেটের বিস্তীর্ণ চা-বাগানে গড়ে উঠেছে অন্তর্যাত্রার কাহিনি। যদিও পরিচালকের ক্যামেরা ঘুরে গেছে পুরান ঢাকার ব্যস্ততম গলি-উপগলির মধ্যে লুকানো ইতিহাসে। সোহেলের মা শিরিনের শৈশবের দিকে আলো ফেলতে। এর মধ্য দিয়ে তারেক মাসুদ দেশ ও সংস্কৃতি নির্মাণের নতুন এক যোগসূত্র ফ্রেমবন্দি করেন। হয়তো সে কারণেই সোহেলের দাদাকে উপস্থাপন করেন বিশ্বজনীন চিন্তার কেন্দ্রে রেখে।
দাদা সোহেলকে চা-বাগানে ব্রিটিশদের কবরস্থান দেখাতে নিয়ে যান। তিনি জানান, ইংরেজরা ভাগ্যান্বেষণে এ দেশে এসেছিল। ভাগ্যবানেরা দেশে ফিরতে পেরেছে, অন্যরা রয়ে গেছে এ দেশের মাটিতে। সাত মাস বয়সী একটা শিশুর কবর দেখান তিনি। এ যেন যারা এখন ভাগ্যের সন্ধানে ব্রিটেন বা অন্য দেশে পড়ে আছে, তাদেরকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাগ্যান্বেষণের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা।
এই চলচ্চিত্রে চা-বাগানের ঘটনা ও টুকরা টুকরা সংলাপের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক বঞ্চনার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। দাদা ও মামার কথায় পাশ্চাত্যের নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য দেখা যায়। কোনো দেশ হাওয়ার ওপর ভর করে দাঁড়ায় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। এটির দীর্ঘ একটি ইতিহাস আছে, যা এই সিনেমায় উঠে এসেছে। দেশ বিভাগের ফলে দেশান্তরি হওয়া ছাড়া আর কোনো ইতিহাস দৃশ্যমান নয়। বাদ থাকে কেবল ব্রিটিশদের ভূমিকা। এসব ঐতিহাসিক ভেদচিহ্ন দিয়ে সংস্কৃতির নানা অবয়ব তৈরি করেছেন তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ।
তারেক নিজেই যেন একজন অভিযাত্রী। তার অন্য চলচ্চিত্র— বিশেষত মাটির ময়না ও রানওয়ে থেকে অন্তর্যাত্রা আলাদা হলেও ভাবগত মিল রয়েছে। এখানে সোহেল তার দাদার সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপে জড়িয়ে পড়ে। দেশ কী? কেন দেশকে ঘিরে মানুষের এত আবেগ— এসব বলতে গিয়ে তিনি বিহারিদের কথা বলেন, যাদের আদি বাড়ি ভারতের বিহারে। চা-শ্রমিকদের কথাও বলেন। ভারতের নানান অঞ্চল থেকে যাদের ধরে এনে ব্রিটিশরা দাসে পরিণত করেছিল। এখন এটাই তাদের দেশ। এই ছবিতে চা-শিল্পকে প্রতীক হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ফরমেটের এই সিনেমা পুরস্কৃত হয় এশিয়ান এবং আরব চলচ্চিত্র উৎসবে। তারেক এবং ক্যাথরিন মাসুদ এর জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার অর্জন করেন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব বাংলাদেশে।
প্রিয়ঙ্কর অর্ঘ
কুইজ
১. সোহেলের কাছে বাংলাদেশ কেমন ছিল?
[ক] রূপকথার মতো
[খ] একটি পোস্টকার্ড
[গ] গানের সুরে ভরা
[ঘ] কোনোটিই না
২. সোহেলের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ের নাম কী?
[ক] সালমা
[খ] টুম্পা
[গ] রিনি
[ঘ] আনুশেহ
৩. দাদা তাকে কত বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিকের কবর দেখিয়েছিলেন?
[ক] সাত মাস
[খ] ১ বছর
[গ] তিন মাস
[ঘ] দেড় বছর
গত পর্বের বিজয়ী
১ রাব্বি খান, ঈশ্বরদী। ২ আকাশ, ফেনী। ৩ জিনিয়া, খুলনা