ফিচার I মুল্লুক চলো
নীলচাষিদের মতোই চা-শ্রমিকেরা অত্যাচারিত হয়েছিলেন ব্রিটিশদের হাতে। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহও সংঘটিত হয়। তা দমন করতে গিয়ে হাজার হাজার কুলির প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। লিখেছেন কনক বিশ্বাস
‘মনে করি আসাম যাব
আসাম গেলে তোমায় পাব
বাবু বলে কাম কাম, সাহেব বলে ধরে আন
আর ওই সর্দার বলে লিবো পিঠের চাম
হে যদুরাম, ফাঁকি দিয়া চলাইলি আসাম।’
আসাম অঞ্চলের এই লোকগানে চা-বাগানের শ্রমিকদের শোষণের কথা বলা হয়েছে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর অত্যাচার ও নিপীড়নের বেদনাময় ছবি ফুটে উঠেছে এতে। আসামে চা-চাষ শুরু হয় ১৮৩৯ সালে। চট্টগ্রামে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা-বাগান গড়ে তোলা হয় ১৮৪০-এ। তবে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে তা প্রতিষ্ঠা পায়। ওই অঞ্চলের বনভূমি উজাড় করে শুরু হয়েছিল চা-বাগান গড়ে তোলার কাজ। সেটি ছিল বেশ কঠিন। স্থানীয়রা এ কাজ করতে চাইত না। তাই বিহার, মাদ্রাজ, উড়িষ্যা (বর্তমানে ওডিশা), মধ্যপ্রদেশের নৃগোষ্ঠী ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো চা-বাগানে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে। ব্রিটিশ লেখক ড্যান জোনসের টি অ্যান্ড জাস্টিস বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ক্লান্তিকর যাত্রা এবং কঠিন কাজ ও খারাপ কর্মপরিবেশের কারণে এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। বাগানে আসার পর তাদের পরিচয় কুলি এবং তারা কোম্পানির সম্পত্তিতে পরিণত হয়। অথচ তাদের আনার সময় বলা হয়েছিল, পাহাড়ঘেরা একটা দেশের চমৎকার বাগানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাজের জন্য। যেখানে গাছের পাতা যেন খাঁটি সোনা। কেউ সে গাছে ঝাঁকুনি দিলে ঝরে পড়বে সোনার পাতা।
কিন্তু যদুরামের মতো শ্রমিকদের সোনার পাতা আর পাওয়া হয়নি। প্রাচীন দাসপ্রথার আদলে সবুজে ঘেরা চা-বাগানের লেবার লাইনে [চা-শ্রমিকদের থাকার জায়গা] তাদের বন্দি করে ফেলা হয়। বাগান কর্তৃপক্ষ স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে শ্রমিকদের শ্রমদাস করার জন্য একটি চুক্তি বা ‘অ্যাগ্রিমেন্ট’ করে। অশিক্ষিত শ্রমিকের কাছে তা বহুল প্রচলিত ‘গিরমেন্ট’। এই চুক্তিতে তাদের অর্থনৈতিকভাবে এমন নিয়মে বাঁধা হয়, তাতে তারা যেন বাগানে কাজের বাইরে কিছু করতে না পারে। তা ছাড়া তৈরি করা হয়েছিল প্রতিটি বাগানের জন্য আলাদা প্রতীকী মুদ্রা। গার্ডেনের বাইরে সেগুলো ছিল মূল্যহীন। এসবের বিরুদ্ধে কথা বললেই শ্রমদাসদের ওপর চলত অমানুষিক নির্যাতন। ১৯১১ সালে আসাম সরকার সে অঞ্চলের প্রধান বাগানগুলোর শ্রমিকের ওপর অত্যাচারের বিষয়টি উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন দেয়।
তারপর ১৯২১ সাল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে তখন চা-চাষের প্রায় ৭০ বছর। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অর্থাৎ আসাম ও সুরমা উপত্যকা বা সিলেটের বাগানগুলোতে সে সময় শ্রমিকদের তীব্র অসন্তোষ শুরু হয়। তারা চৌকিদারের চোখরাঙানি, পুলিশের ভয়, ব্রিটিশ সাহেবের চাবুক অগ্রাহ্য করে। শ্রমিকেরা তাদের জন্মস্থান ‘মুল্লুক’ চলে যেতে চান। সে বছরের ২০ মে সেই ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকারের সেপাইরা গুলি আর বেয়নেট চার্জ করে। এখনকার চাঁদপুর জেলার মূল হেড বড় স্টেশন-সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। অসংগঠিত অথচ স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনে সিলেট ও আসামের হাজার হাজার শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন। চাঁদপুর ঘাটে স্টিমারে ওঠার জন্য অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে ঘটনাস্থলেই অসংখ্য শ্রমদাস নিহত হন, আহত হন এক হাজারের বেশি।
ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এই বিদ্রোহের ঘটনা অনেকটা অগোচরেই রয়ে গেছে। তবে তারা পূর্বপুরুষের রক্তমাখা এই দিনকে প্রতিবছর ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন।
দুই
‘প্ল্যান্টেশন লেবার ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে রজনীকান্ত দাস জানিয়েছেন, চা-শ্রমিকদের ওপর ইউরোপীয় অফিসারদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ফলে প্রায়ই সেখানে সংঘর্ষ বাধত। ১৮৯১ সালে আসামের চা-বাগানে ১০৬টি দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটে। ১৯২১ সালে তা বিস্ফোরিত হয়, দুই উপত্যকার বাগানে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ। এর পেছনে অবশ্য চা-শ্রমিকদের মজুরি কমানোর বিষয়টি মুখ্য ছিল। দেওয়ান চমনলাল তার ‘কুলি: দ্য স্টোরি অব লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে এর উল্লেখ করেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চা-শিল্পের মালিকেরা বেশি মুনাফা অর্জন করে, যা ৪৫০ শতাংশে পৌঁছায়। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি এক আনাও না বাড়িয়ে বরং বাজার মন্দা হলে তা কমিয়ে দৈনিক তিন পয়সা হিসেবে ধার্য করা হয়। তাতে শ্রমিকেরা সংসার চালাতে পারতেন না। অন্যদিকে মালিকের নির্যাতন তো ছিলই। ফলে তারা নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বাগানমালিকেরা তা মেনে নেয়নি। তারা নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। সুকোমল সেন ‘ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন সেসব ইতিবৃত্ত। তিনি জানিয়েছেন, ইউরোপীয় অফিসারের নির্দেশ ছিল, কুলিদের কাছে যেন রেলের টিকিট বিক্রি না করা হয়। শ্রমিকেরা তখন হেঁটে মুল্লুকের দিকে যাত্রা করেন। আসাম থেকে তারা চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে যোগ দেন সিলেটের বিভিন্ন বাগানের শ্রমদাস। তাদের লক্ষ্য ছিল স্টিমারে চেপে গোয়ালন্দ যাবেন, তারপর ট্রেনে করে নিজ নিজ জন্মস্থানে। কিন্তু ২০ মে ভয়ংকর হামলা চালানো হয় ঘরে ফেরার জন্য উদ্গ্রীব মানুষগুলোর ওপর।
সুকোমল সেন লিখেছেন, ‘…কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপকসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ আমদানি করে স্টেশন ছেয়ে ফেলল। তারপর রাত্রে ৩০০০ কুলি যখন প্ল্যাটফর্মে নিদ্রামগ্ন ছিল, তখন ডিভিশনাল কমিশনারের আদেশে গোর্খা সৈন্যরা উন্মুক্ত বেয়নেট নিয়ে স্ত্রী, পুরুষ, শিশুনির্বিশেষে নিদ্রিত কুলিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাতৃক্রোড়ে শিশু থেকে শুরু করে স্ত্রী, পুরুষ, বৃদ্ধ— কাউকেই বেয়নেটের আঘাত থেকে রেহাই দেওয়া হলো না। অনেককে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।’
সেদিন কতজন শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন, তার কোনো হিসাব কেউ বলতে পারে না। চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কাছেও তার কোনো নথি নেই। তবে এই ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। কুলিদের ওপর এই অন্যায় হত্যাকা-ের প্রতিবাদে আসাম ও বাংলার রেলওয়ে শ্রমিকেরা ১০ দিনের ধর্মঘট পালন করেন।
তিন
বাংলাদেশে চা-শ্রমিকেরা ক্ষেতল্যান্ডের ওপর তাদের অধিকার রক্ষা এবং ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছেন। হবিগঞ্জের কুলিরা তাদের ক্ষেতল্যান্ড থেকে প্রস্তাবিত বিশেষ ইকোনমিক জোন অথরিটি ‘বেজা’ প্রকৃত অকৃষিজমিতে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। উল্লেখ্য, সরকারি খাস খতিয়ান হিসেবে যে অকৃষিজমি ডানকানকে ১৮৯০ সালে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেটিকে ফসলি ভূমিতে রূপান্তর করেছেন কুলিদের পূর্বসূরিরা। ১২৫ বছর ধরে ফসল ফলানো, প্রতিবছর বিঘাপ্রতি সাড়ে তিন মণ চাল অথবা আটার সমপরিমাণ রেশনের মূল্যে এই জমির দাম পরিশোধ করা হয়েছে বহু বছর আগে। তা ছাড়া ১৯৯৭ সালের খাসজমি বন্দোবস্ত আইন অনুযায়ী এই জমির স্থায়ী মালিকানা পাওয়ার অগ্রাধিকার রয়েছে চা-শ্রমিকদের। কোনো যুক্তিতেই বেজা এই জমি বরাদ্দ পাওয়ার অধিকারী নয়।
কৃষিজমিতে ইকোনমিক জোন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ রকম একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাজার হাজার চা-শ্রমিককে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরও এর কোনো মীমাংসা হয়নি।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে চা-শিল্প হলো ঔপনিবেশিকতার ফল। একে বরাবরই বলা হয়েছে টি এস্টেট। কাজেই বাগানমালিকেরা ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই শোষণ-নিপীড়ন চালু রেখেছে। স্বাধীনতার আগে ও পরে সব সময়ই মজুরি সবচেয়ে কম রাখার চেষ্টা হয়ে আসছে। ফলে চা-বাগানে মালিকপক্ষ শুরু থেকেই এমন পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে, যা হলো সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নই বলা যায়।
ছবি: ইন্টারনেট