skip to Main Content

স্বাদশেকড় I চা

উৎপত্তি চীনে। বিশ্বব্যাপী এটা ছড়িয়ে পড়তে সময় নিয়েছিল প্রায় ৫ হাজার বছর

চায়ের শিকড় খুঁজলে প্রথমেই চলে আসে চৈনিক সম্রাট ‘শেন নাং’-এর নাম। সময়টা খ্রিস্টজন্মের ২ হাজার ৭৩৭ বছর আগে। ভৃত্যদের নিয়ে সম্রাট বেরিয়েছিলেন জঙ্গলে। আনন্দ করতে। সেখানে ভৃত্যরা বিভিন্ন কাজে লেগে গেল। কেউ ব্যস্ত হলো সম্রাটের খাবার তৈরিতে। আগুনের ওপর পানি ফোটাতে দেওয়া হলো। হঠাৎ কোথা থেকে যেন সেই পানিতে উড়ে এসে পড়ল অচেনা কয়েকটি পাতা। সম্রাটকে পরে সেই পানীয় পান করতে দেওয়া হলো। মুখে দিতেই তিনি তাতে সেই পাতার স্বাদ ও গন্ধ পেলেন। তবে চটে যাননি, বরং মোহিত হয়ে পড়েছিলেন।
কিছুটা ভিন্ন কথা প্রচলিত আছে। সেটিও শেন নাং-কে নিয়েই। তিনি নাকি রাজ্যে ডিক্রি জারি করেছিলেন। সবাইকে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। শেন নাং নিজেও ফোটানো পানি পান শুরু করেন। একদিন রাজকার্যের ক্লান্তি দূর করতে সম্রাট পান করার জন্য পানি ফোটাচ্ছিলেন। কোথা থেকে যেন একটি পাতা উড়ে এসে পড়ে পাত্রে। তরলের রংও বদলে যায়। কৌতূহলবশে তা পান করলেন স¤্রাট। সেই দিন তার বেশ চনমনে লাগল; কেটে গেল ক্লান্তি।
সম্রাট শেনং নাং সেই অচেনা পাতার উৎস বের করতে সেনাদের নির্দেশ দিলেন। আবিষ্কৃত হলো ‘ক্যামেলিয়া সিনেনসিস’। এটাই চা-গাছ। গ্রিক দেবী থিয়ারের নামানুসারে সেই গাছের পাতার নির্যাসযুক্ত তরলের নাম রাখা হয়। ইংরেজিতে একে বলে টি, চীনারা ‘টি’ এর উচ্চারণ করে ‘চি’। এই চি-ই আমাদের কাছে চা। চীনে পানীয়টির নাম সরকারিভাবে চা করা হয় ৭২৫ সালে। যদিও ফার্সি, উর্দু, বসনিয়ান, কুর্দি, আজারবাইজান, তুর্কিসহ আরও কিছু ভাষায় একে বলে ‘চায়ে’। আবার আরবি বর্ণমালায় ‘চ’ নেই বলে তারা বলে ‘শায়ে’। জাপানিরা বলে ‘অচ্চা’।
৪০০ খ্রিস্টাব্দে চীনা অভিধানে চা ‘কুয়াং ইয়াং’ নামে পরিচিত ছিল। সেখানে এই পানীয়র প্রস্তুত প্রণালির বর্ণনাও মেলে। তারপরের ২০০ বছরে চা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে সে দেশে। এই পানীয়ে যুক্ত হয়েছে কমলার রস, আদা এবং অন্যান্য মসলা। রোগের পথ্য হিসেবে চৈনিকরা এটি পান করত।
চীন ছেড়ে চায়ের খ্যাতি তুরস্কে ছড়ায় ৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে। জাপানে পৌঁছায় ৫৩৯ সালে। সে দেশের ভিক্ষুরা চায়ে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ভ্রমণকালেও তারা সঙ্গে চায়ের বীজ নিয়ে ঘুরতেন। ৬৪৮ থেকে ৭৪৯ সালের মধ্যে গোয়োকি নামের একজন জাপানি ভিক্ষু বৌদ্ধমন্দিরগুলোতে চা-বাগান করার সিদ্ধান্ত নেন। কথামতো ৪৮টি মন্দিরে তা করেও ফেলেন। তখন জাপানের সাধারণ মানুষ চা সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ। তবে উচ্চস্তরের ভিক্ষু কিংবা সম্ভ্রান্ত নাগরিকেরা তা সম্পর্কে জানতেন এবং পান করতেন।
গুঁড়া চা তৈরি হয় ৭২৯ সালে, জাপানে। সেই দেশে একে বলে ‘হিকি অচ্চা’। এটি জাপান সরকার ও দেশটির ভিক্ষুদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে ৭৮০ সালে চা চীনে এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে দেশটির সম্রাট জনগণের ওপর ‘চা কর’ আরোপ করেছিলেন।
চীনে চায়ের পাতা গুঁড়া করা শুরু হয় পরিবহনের সুবিধার্থে। ৭৮০ সালে দেশটির তাং রাজবংশের কবি ‘লু ইউ’ চা নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেটির সুবাদে চৈনিক কৃষকেরা তাদের সম্রাটকে প্রতি বসন্তে চা উপহার দেওয়া শুরু করে। তখন চা পরিবহনের জন্য তারা চা-পাতাকে দুটি ইটের মধ্যে রেখে টুকরা করত। তারপর গুঁড়া তৈরি করা হতো। রাশিয়া চায়ের সঙ্গে পরিচিত হয় ১৬১৮ সালে। চীনের রাষ্ট্রদূত তা উপহারস্বরূপ রাশিয়ায় নিয়ে যান। পশ্চিমা বিশ্বে চা পৌঁছায় ওই শতকেই। ১৬৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ রাজা ও রানিকে চা উপহার দেয়।
চায়ের ঘন লিকার তৈরি শুরু হয় চীনের সিচুয়ানে। ইউরোপে এটি প্রবেশ করে পর্তুগিজদের হাত ধরে, ১৬১০ সালে। ১৮০০ সালের মাঝামাঝি চীনের সঙ্গে চা-সংক্রান্ত বাণিজ্য চুক্তি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরে ব্রিটিশরা রবার্ট ফরচুন নামের একজনকে চীনা পোশাক পরিয়ে চীনের নিষিদ্ধ চা অঞ্চলে পাঠায়। তিনি গোপনে চা উৎপাদন পর্যবেক্ষণ করেন। ফিরে আসার সময় যথেষ্ট চায়ের বীজ নিয়ে ব্রিটিশ ভারতে আসেন। ভারতের আসাম অঞ্চলে চা রোপণ ও উৎপাদন শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

১৮৩৫ সালে। দিনে দিনে তারা ভারতে চায়ের আরও উন্নতি সাধন করে। ব্রিটিশরা ছোট ছোট দোকান খোলার উদ্দেশ্যে অল্প দামে, বাকিতে এমনকি বিনা মূল্যে এটি সরবরাহ করতে থাকে এই অঞ্চলে। ভারতে তাদের প্রথম চা কোম্পানি হলো ‘আসাম চা কোম্পানী’। প্রতিষ্ঠার পরই ইংরেজরা এর প্রচার-প্রসারে জোর দেয়। প্রথমে তারা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চায়ের বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা বের করা। ব্রিটিশরা বাংলাদেশে প্রথম চা-গাছ খুঁজে পায় সিলেটে। ১৯ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। ১৮৪৯ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়।
ওটাই বাংলাদেশের প্রথম চা-বাগান। লর্ড হারসন এর প্রতিষ্ঠাতা।

 ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top