skip to Main Content

কাভারস্টোরি I চা-চক্র: চাঙা বাঙালি

ডাচদের পর ব্রিটিশ, তাদের মাধ্যমেই পানীয়টির সঙ্গে বাঙালির পরিচয়। যদিও এই অঞ্চলের আদিবাসীরা অনেক আগে থেকেই চায়ের ভিন্ন এক স্বাদ গ্রহণে অভ্যস্ত ছিল। বিনা মূল্যে পান করিয়ে বাঙালিদের মধ্যে চায়ের অভ্যাস গড়ে তুলেছিল ইংরেজরা। শিক্ষিত বাঙালিদের একাংশ এর বিরোধিতা করেছিল। আবার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তা উপভোগও করেছেন

ভারতবর্ষে চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন ব্রিটিশরা শুরু করেছিল বটে, কিন্তু ডাচরাই প্রথম এই পানীয় এখানে নিয়ে আসে। চীনাদের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তবে ডাচদের সঙ্গে ছিল দহরম-মহরম। তাই চীনারা তাদের কাছেই চা বিক্রি করত। ফলে ইংরেজরা এক প্রকার চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমেই চা এনেছিল এই উপমহাদেশে। তারা ২০ হাজার চারা এবং ৮ জন টি-মাস্টারকে চুরি করে আফিমের জাহাজে লুকিয়ে এনেছিল বলে জানা যায়।
বাঙালিদের কাছে চা পরিচিত কিছু ছিল না। তবে এই অঞ্চলে আগেই এ গাছ ছিল। বাঙালি-অধ্যুষিত অঞ্চলে একজন স্কটিশ ব্যবসায়ী ও এক্সপ্লোরার এর প্রচলন ঘটান। নাম রবার্ট ব্রুস। ১৮৮৩ সালে তিনি শিংপো আদিবাসীদের কাছে চায়ের কাঁচা পাতা দেখতে পেয়েছিলেন। তারা তেল ও রসুন মেখে তা খেত। শিংপোদের থেকে বীজ সংগ্রহ করে রবার্ট ব্রুস চা চাষের উদ্যোগ নেন। কিন্তু কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। তার ছোট ভাই ছিলেন চার্লস আলেকজান্ডার। ভাইয়ের কাছে ভারতবর্ষে চা প্রাপ্তির খবর শুনেছিলেন তিনি। চার্লস ভাবলেন, ভারতবর্ষে চা ফলানো গেলে তা ব্রিটিশদের জন্য দারুণ ব্যাপার হবে। তখন আর চীনের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। পরে কলকাতার শিবপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে এটি পাঠানো হয় পরীক্ষামূলক চাষের উদ্দেশ্যে।


চাষের সম্ভাবনা নিশ্চিত হওয়ার পর ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশে ১৮৩৯ সালে আসামে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু করে। চৈনিক শ্রমিক আমদানি করে এ উদ্যোগ নিয়েছিল তারা। কিন্তু পোষাতে না পেরে স্থানীয় ও আদিবাসীদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল ব্রিটিশদের। তারা চেয়েছিল চৈনিক মডেল মেনে চা-বাগান করতে। ১৮৪০ সালের দিকে চীন থেকে যন্ত্র ও অভিজ্ঞ শ্রমিক আনা শুরু করে। সিঙ্গাপুর থেকেও আনে ৩০০ শ্রমিক। আসামে চা-চাষে তাদের নিযুক্ত করা হয়। সেই বছর এক ইংরেজ রাজকর্মচারী ঢাকা ভ্রমণ করেছিলেন। পরে তার স্মৃতিকথা থেকে জানা গেছে, ঘোড়ায় চড়ে ঢাকা ভ্রমণকালে তিনি পথে প্রায় ১২ জন চীনা ব্যক্তিকে দেখতে পেয়েছিলেন। জানতে পারেন, সবাই চা উৎপাদক; আসামে যাচ্ছে। তারা সেই অঞ্চলের স্থানীয়দের চা উৎপাদন শেখাবেন। যদিও প্রতিশ্রুত বেতন ইংরেজরা তাদের দিতে পারেনি। পারিশ্রমিক বিতর্কে কলকাতা ও পাবনা অঞ্চলে একটি দাঙ্গাও হয়েছিল তখন। ফলে ইংরেজরা সেসব উৎপাদককে চীনে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয়। এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ইংরেজরা চীনা উৎপাদকদের পরিবর্তে স্থানীয় বাঙালি ও আদিবাসী শ্রমিকদের দিয়ে চা চাষ করে। ১৮৪০ সালেই তারা চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় চা-বাগান তৈরির উদ্যোগ নেয়। সিলেটে চায়ের কারখানা চালু হয় এরও ১৫ বছর পর। চাঁদখানি পাহাড়ে। মূলত বাংলাদেশে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণন শুরু হয় ব্রিটিশদের মাধ্যমেই।
১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চায়ের আবাদের জন্য যারা চেষ্টা চালিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন স্কন্স নামের এক ব্রিটিশ ব্যক্তি। তিনি ডিসট্রিক্ট কালেক্টর ছিলেন। সেই অঞ্চলে স্কন্স অসমীয়া ও চীন থেকে আনা বীজ বুনে চা ফলানোর চেষ্টা করেন। প্রায় একই সময়ে কর্ণফুলী নদীর তীরে কোদালা অঞ্চলে চা চাষের উদ্যোগ নেন হুগো নামের এক ইংরেজ। উভয়ে সফল হওয়ার পর ১৮৪৩ সালে চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। পরবর্তী ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশে চা চাষের প্রসার ঘটে। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের বিভিন্ন পাহাড়ি জায়গায় ব্রিটিশরা ফলানোর উপযোগী জায়গা খুঁজে পায়। এরপর সেসব স্থানে চা উৎপাদন শুরু হয়। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাটি এটি চাষের জন্য উৎকৃষ্ট। তাই ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছাড়ার আগে এই দুই অঞ্চলে ১৩৩টি চা-বাগান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
বাংলায় পানীয় হিসেবে চা-কে প্রতিষ্ঠা করতে ইংরেজদের কিছু কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। চটকদার বিজ্ঞাপনের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। প্রথমে কলকাতার বৌবাজার ও ঠনঠনিয়ায় ইংরেজরা বিনা মূল্যে চা পানের ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে লোকে নিজেদের বাড়িতে চা নিয়ে যেতে পারত। তারা বাঙালিকে চায়ের নেশা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। এর পেছনে ছিল তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ। পুরো বাংলাদেশে ব্রিটিশরা ৩০ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ১ দশমিক ৮৮ কেজি চা উৎপাদন করত। বিপুল পরিমাণ বিক্রির জন্যই বাঙালিদের চায়ে আসক্ত করার প্রয়োজন ছিল ইংরেজদের। এ জন্য তারা নৌ ও রেলপথকেও তাদের বিপণন কৌশলের আওতায় এনেছিল। নৌপথে বিনা মূল্যে চা পানের ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশ টি অ্যাসোসিয়েশন। উনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝিতে বাংলার যোগাযোগ রেলনির্ভর হয়ে পড়লে ইংরেজরা রেলস্টেশন ও জংশনে চা পানের উপকারিতাবিষয়ক বিজ্ঞাপন বোর্ড স্থাপন করেছিল। তবে শুধু বিজ্ঞাপন দিয়েই তারা থেমে যায়নি। বিনা মূল্যে চা পান করাতে যাত্রীদেরকে কাউনিয়া, পোড়াদহ, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন জংশনে নিয়ে যাওয়া হতো। চা পান করিয়ে আবার যাত্রীদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দিত ইংরেজরা। এভাবেই গ্রামবাংলার মানুষেরা চা-পানে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।


বিনা মূল্যে চা পানকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি বাঙালিদের একাংশ। ব্রাহ্মসমাজ ইংরেজদের এই কর্মকা-ের বিরোধিতা করেছে। তা ছাড়া চা-শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে দাবিদাওয়া তুলেছিল। কেননা, ইংরেজরা ভূমির লোভ দেখিয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাঁওতাল, ওঁরাও ও অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর অনেককেই চা চাষ করতে নিয়ে এসেছিল। ব্রাহ্মসমাজের সদস্য রামকুমার বিদ্যারত্ন আসামে নিজ ধর্মের প্রচার করতে গিয়ে চা-শ্রমিকদের দুর্দশা দেখতে পেয়েছিলেন। পরে তিনি সেই বিষয়ে ‘কুলি কাহিনী’ নামের একটি উপন্যাস লেখেন। ব্রাহ্মসমাজের ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকাতেও চা-শ্রমিকদের দুর্দশা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এই সমাজের আরেক সংগঠক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী আসামের বাগানে ঘুরে এসে চা-শ্রমিকদের ওপর চলা নিপীড়নের বিবরণ নিয়ে কিছু নিবন্ধ লিখেছিলেন। ফলে ১৯০১ সালে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ চা-শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় শ্রম আইন সংশোধন করে। চা-শ্রমিকদের ওপর ব্রিটিশদের নির্যাতনের কারণে অনেক বাঙালিই এই শিল্পকে গ্রহণ করেনি। কেউ কেউ ইংরেজদের তৈরি এই পানীয় গ্রহণকে গর্হিত অপরাধ গণ্য করত। এমনকি তারা চা ছুঁতেও চাইত না।
স্বাস্থ্য ও মানসিক দিক বিবেচনা করে বিজ্ঞানী প্রফুল্ল রায় চা পানের বিরোধিতা করেছিলেন। জনমতও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ‘চায়ের প্রচার ও দেশের সর্বনাশ’ শিরোনামে দেশ পত্রিকায় একটি লিখিত বক্তব্যও দিয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী। চা চাষের কারণে বাঙালির অর্থনৈতিক ক্ষতির কথাও ছিল তার বয়ানে। চা পানের পক্ষে লর্ড কার্জনের প্রচার দেখে তিনি পানীয়টির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের নতুন কূটকৌশল আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বাঙালিকে অলস ও নেশাতুর করার পথে ইংরেজের সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন চা পানের অভ্যাসকে। যদিও শেষমেশ তাদের চটুল বুদ্ধির কাছে প্রফুল্ল রায় টিকতে পারেননি। তবে তিনি ব্রিটিশদের এই বাণিজ্যে কিছুকাল বাধা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার চা-বিরোধী এই সব সক্রিয়তা ছিল ১৯ শতকের অন্তিম থেকে ২০ শতকের চতুর্থ দশক পর্যন্ত।
উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুতে চা পান বাঙালির কাছে আভিজাত্যের বিষয় হয়ে ওঠে। পরে তা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নিত্যনৈমিত্তিক পানাভ্যাসের রূপ নেয়। বিশ শতকে তা ব্যাপক আকার গ্রহণ করে। তখন চা পানের উপকারিতাবিষয়ক পুস্তিকাও বেরিয়েছিল। সংবাদপত্রগুলো চায়ের গুণাগুণ প্রচারিত হতো। প্রকাশ পেত চটকদার বিজ্ঞাপন। এমনকি ১৯০০ সালে চায়ের ফুড বেনিফিট-বিষয়ক একটি পুস্তিকাও রচনা করেছিলেন গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নাম ‘চা প্রস্তুতপ্রণালী শিক্ষা’। সেটি কলকাতার শিক্ষিত সমাজে আলোড়ন ফেলেছিল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি ইংরেজদের অনুকূলে আসে। চা হয়ে ওঠে বাঙালির পছন্দের পানীয়।
ব্রিটিশদের চা চাষ প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন কিছু বাঙালি শিল্পপতি। কথিত আছে, নবাব আব্দুল গনি ঢাকার বেগুনবাড়ি এলাকায় ৩০ বিঘা জমি কিনে চা আবাদের চেষ্টা করেছিলেন। উনিশ শতকের ঢাকায় ইংরেজদের পাশাপাশি আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরাও পানীয়টির প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল। ১৮৭০ সালে শাঁখারীবাজারে তারা তৎকালীন ঢাকার সবচেয়ে আধুনিক ও অভিজাত চায়ের দোকান চালু করেছিল।


চা পানে মজেছিলেন অনেক কীর্তিমান বাঙালিও। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত ছোটবেলার ওষুধ হিসেবে চা পান করতেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চা পানে আগ্রহী ছিলেন। শান্তিনিকেতনে চায়ের আড্ডার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘চাক্র’, মানে ‘চা-চক্র’। কাজী নজরুল ইসলামও চা-পায়ী ছিলেন। কিছুক্ষণ পর পর চা পান না করলে তার চলতই না। প্রচলিত আছে, যথেষ্ট পরিমাণ চা ও পান দিয়ে তাকে একটা ঘরে আটকে রেখে গ্রামোফোন কোম্পানির কর্মকর্তারা তার কাছ থেকে অনেক গান লিখিয়ে ও সুর করে নিয়েছিলেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে চায়ের চাহিদা এতই বেড়েছে যে তা সামাল দিতে হিমশিম পোহাতে হচ্ছে। দেশে চায়ের বার্ষিক চাহিদা ১০ কোটি কেজি। কিন্তু প্রতিবছর ২ কোটি কেজি ঘাটতি থেকেই যায়। এই সমস্যা নিরসনে পাহাড় ছেড়ে সমতলেও চা চাষ হচ্ছে। ১৯৯৬ সাল থেকে পঞ্চগড় জেলায় চা চাষের গবেষণা চালু হয়। ২০০৭ সাল থেকে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারীতে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়েছে। ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় চা চাষের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে এখন ১৬৭টি নিবন্ধিত চা-বাগান ও টি এস্টেট আছে।

 ফুড ডেস্ক
মডেল: তানিয়া
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: বাটারফ্লাই বাই সাগুফতা (ব্লাউজ)
ছবি: ইভান সরদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top