skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I ক্রাবির পান্না সবুজ সমুদ্রসৈকতে

সেই সৈকতে যুগলেরা নতুন জীবনের আস্বাদ উপভোগের জন্য যায়। যেন সমুদ্রের সবুজ তরঙ্গরাশি তাদের জাদুমন্ত্রবলে ডেকে এনেছে। পাহাড় আর বনভূমির ঐশ্বর্য সেখানে প্রশান্তিকর। লিখেছেন ফাতিমা জাহান

পায়ে চলার পথের এক পাশে জমজমাট বাজার; আরেক পাশে শান্ত, পান্না সবুজ জল মেখে সাদা বালিতে আছড়ে পড়ছে সমুদ্র, আও নাং বিচ এই সৈকতের নাম। আও নাং থাইল্যান্ডের ক্রাবি শহরের অন্যতম জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত। একে তো মনোমুগ্ধকর এই অখন্ড সবুজ জলরাশি, তার ওপর উদার আতিথেয়তা।
থাইল্যান্ডের প্রতিটি শহর মানেই সমুদ্রসৈকত। ক্রাবি আমার খুব প্রিয় স্থান; কারণ, এখানে দর্শনার্থী অন্যান্য জায়গার চেয়ে কম।
ক্রাবির ভুবনমোহিনী রূপ আর অসামান্য খাবার টেনে নিয়ে আসে যেকোনো ভ্রমণার্থীকে পথের ক্লান্তি দূর করতে।
আমি সবে ক্রাবি এয়ারপোর্ট থেকে রিসোর্টে এলাম। এসেই সমুদ্রসৈকত ধরে খানিকক্ষণ হেঁটেছি।
এই অপার সৌন্দর্য আমার খুব পরিচিত। আগেও থাইল্যান্ডে এসেছি, গিয়েছি সব বিখ্যাত সমুদ্রসৈকতে কিন্তু এবার ঠিক হইহই করে ঘুরে বেড়ানো নয়, অলস সময় কাটানো, পা ভিজিয়ে জলকেলি খেলা বা সাগরে সূর্যের ঢলে পড়া দেখব। এসবের জন্য আও নাং দ্বীপ সবচেয়ে উপযোগী। বেলা পড়ে আসছে। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে একটা রেস্তোরাঁয় বসলাম সাগরের মুখোমুখি। সব সময় কি লাফিয়ে-দাপিয়ে বেড়ানো যায় সাগরের বুকে?
শান্ত আর পান্না সবুজ ছড়িয়ে পড়েছে। রং চারদিকে।
হাতে জুসের গ্লাস নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই দ্বীপের কোণে কোণে, নারকেলগাছের শিরশিরানি শুনি, দূরের সবুজ পাহাড়ের গা ভরতি গয়না দেখি। সাদা মসৃণ বালির বুকে হাঁটতে থাকি।
আমি যদি বাঙালি না হতাম, তাহলে নিশ্চয়ই থাই হতাম। কারণ, থাইল্যান্ডের খাবার আমার এত পছন্দ যে সারা জীবন খেতে পারব। থাইল্যান্ডের প্রধান খাবার ভাত, সঙ্গে আমি নিয়েছি চিংড়ির কারি। কাঁচা পেঁপের সালাদ আর সামুদ্রিক মাছ আস্ত ভেজে সামনে পরিবেশন করা হলো, আমার স্বাদেন্দ্রিয় ব্যাকুল হয়ে উঠল। মনে হলো, আমি নই, সাগরই আমাকে দেখছে।
বিকেল শুরু হয়েছে খোলা রেস্তোরাঁয় লাইভ সংগীত দিয়ে। যেকোনো সমুদ্রসৈকতের রেস্তোরাঁয় খোলা আকাশের নিচে চেয়ার টেবিল পেতে বিকেল আর সন্ধ্যা পার করা একটি সুন্দর অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। যিনি গিটার বাজিয়ে মূল রেস্তোরাঁর সামনে বসে ইংরেজি গান গাইছেন, তার নিনো। থাই মেয়ে। এখানকার ছেলেমেয়েদের কোনো সংকোচ নেই যেকোনো কাজ করতে, আমাদের দেশের মতো লোকলজ্জা নেই। আমি হাততালি দিচ্ছি আর নিনো মহা উৎসাহে মাথা নেড়ে নেড়ে দুলে দুলে গান গাইছে। দু-একটা গান আমার অনুরোধে গাইল। এসব দেখে আমাদের প্রিয় পান্না সবুজ সাগর ধীরে ধীরে ধূসর হতে চাইল। সূর্য হেলে পড়ছে সাগরের গায়ে একে অন্যকে জড়িয়ে নিদ্রাযাপন করার আগে লালিমা ছড়িয়ে, রাঙা হয়ে হাসতে হাসতে এক মুঠো সন্ধ্যা এনে দিল। নিনো তখন আরও আনন্দে গাইছে, ‘এনিটাইম শি গোওস অ্যাওয়ে…।’
এখন আসলে তার ব্যস্ত সময়। সারা দিন ঘুরেফিরে ট্যুরিস্টরা এখন আসবে, বসবে ভেতরের রেস্তোরাঁয় বা বাইরের খোলা জায়গায়, গান শুনবে, খাবার খাবে, সাগরের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মাখবে।
আমি চলে গেলাম ক্রাবির মূল নাইট মার্কেটে। রাতের বেলায় বাজার বসে। হস্তশিল্প, জামাকাপড়, আর্টিফিশিয়াল গয়না, ব্যাগ, ল্যাম্প, চিত্রকর্ম, স্যুভেনির আরও কত কী যে পাওয়া যায়। আমি অবশ্য এই বাজারের স্ট্রিট ফুড খাওয়ার জন্য এসেছি।
খোলা আকাশের নিচে লোকজন পণ্য কেনার জন্য ভিড় জমিয়েছে। আমি কয়েকটা হাতে বোনা ব্যাগ আর ওয়াল হ্যাংগিং কিনলাম। শপিং করা আমার মূল উদ্দেশ্য নয়।
ক্রাবিতে অনেক থাই মুসলমানের বসবাস। স্ট্রিট মার্কেট জুড়ে বেশির ভাগ দোকানিই মুসলমান। বেশ পথের ধারে অস্থায়ী চুলায় রান্না করে টাটকা খাবার পরিবেশন করছে। আমাদের দেশে থাই স্যুপ নামে যে বস্তু রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়, তা এখানকার টম ইয়াম স্যুপের ছোটখাটো ভার্সন। এক বাটি টম ইয়াম স্যুপ প্রথমে চোখ খুলে বা বন্ধ করে টক ঝাল মিষ্টি স্বাদ নিতে নিতে খেয়ে ফেললাম। এরপর মেইন কোর্সে নিলাম প্যাদ থাই বা থাই নুডলস। কোথাও কোনো খাবার পছন্দ না হলে এটি আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। এরপর বেশ আয়েশ করে ডেজার্ট হিসেবে নিলাম ক্রাবি স্পেশাল বানানা প্যান কেক। এর ভেতরে কলা ছোট ছোট করে কেটে পাটিসাপটা পিঠার মতো বানিয়ে দিয়েছে। প্যান কেক আমি অনেক দেশে খেয়েছি, নিজেও বানাই মাঝে মাঝে কিন্তু এর ধারেকাছে কেউ ভিড়তে পারবে না।
খাওয়া হলে আরেকটু ঘুরেফিরে চললাম সাগরপাড়ে আমার রিসোর্টের দিকে। সেখানকার বারান্দায় বসে সাগর দেখা যায়।
সৈকতে এখন বেশ উৎসব উৎসবের আমেজ। কারোর বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। এ রিসোর্টের অতিথি হবে। অনেক দেশ থেকে যুগল থাইল্যান্ডে আসেন বিবাহ সম্পন্ন করতে। ভারতে তো একটা ট্রেন্ড চালু হয়েই গেছে থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার বিচে গিয়ে বিয়ে করার। আমাদের দেশেও শুরু হচ্ছে ধীরে ধীরে। আর হানিমুন উদযাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি যুগল আসে এই থাইল্যান্ডে।
এই সমুদ্রতীর যেন নতুন জীবন প্রবেশের উন্মুক্ত দরজা। এই ঘন নীল রাতের আবেশে ছোট ছোট রঙিন বাল্ব জ্বালিয়ে বিয়ের অতিথিরা খোলা আকাশের নিচে গানের তালে তালে নেচে বেড়াচ্ছে। পাশে একটা টেবিলে খাবার রাখা, যে যার মতো তুলে নিয়ে খাচ্ছে। সদ্য বিবাহিতরাও হাত ধরাধরি করে নাচছে।
পরদিন আমি চলে গেলাম আইল্যান্ড হপিংয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেকোনো দেশে আইল্যান্ড হপিং একটা জনপ্রিয় ভ্রমণ। সাধারণত ট্রাভেল এজেন্টদের কাছ থেকে এই ট্যুর বুক করা যায়। একটা ইঞ্জিনচালিত বোট বা নৌকা কিংবা বড় আকারের স্পিডবোটে ১০/১২ জন যাত্রী নিয়ে সারা দিন এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে নিয়ে যায় এই ট্যুর।
যারা আমার সহযাত্রী, তাদের অর্ধেকই হানিমুন কাপল। বোটে বেশির ভাগই ইউরোপীয়। থাইল্যান্ডে এ ধরনের নৌকাকে বলা হয় লং টেইল বোট।
প্রথম গন্তব্য ফি ফি আইল্যান্ড। অনেকের কাছে এটি সম্ভব থাইল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপ। স্বচ্ছ সবুজ জল, দুধ-সাদা তট আর অনেক দূরে চুনাপাথরের সারি সারি পাহাড়কে আবৃত করা বড় বড় গাছ— সবই রহস্যময়।
গভীর সমুদ্রের বুকে বোট চলে। কিছুই চোখে পড়ে না অত্যাশ্চর্য সবুজ জল ছাড়া, একেকটা ঢেউ, বিদ্যুতের মতো খেলা করে সাগরের শরীরে, জড়িয়ে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে।
ফি ফি আইল্যান্ডে সবাইকে বোট থেকে নামতে হলো কোমরসমান জলে। কেউ হেঁটে, কেউ সাঁতরে চলে গেল তীরে। এই দ্বীপে স্নানের জন্য ঝপাৎ করে জলে নেমে পড়া যায়, বালির তটে বসে বিশ্রাম নেওয়া যায় বা বুকসমান জলে ডুবে রঙিন মাছদের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা যায়। আমি ডুবে ভেসে দ্বীপের কোনায় কোনায় পড়ে থাকা, অবহেলায় লুটিয়ে থাকা ঐশ্বর্য দেখি, পান্না জলের নিচের জগতের দিকে তাকিয়ে থাকি।
অন্যান্য সৈকতের মতো দীর্ঘ নয়। আশপাশে গাছপালা বেশ একটা গুঞ্জন করছে। বোটের সহযাত্রীরা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়েছে আর আমি তটের প্রেমে গভীর থেকে আরও গভীরে চলে গিয়েছি।
সাদা বালিতে পায়ের আঁকিবুঁকি করছি আর সবুজের ছড়াছড়ি দেখছি। সমুদ্র বরাবরের মতো শান্ত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই তরঙ্গরাশি আমার ভেতরের কোলাহলকে নীরবতায় ভরিয়ে তুলল।
পরের ভূখন্ডটির নাম হং আইল্যান্ড। সেখানে আবার বোটে চড়ে আনন্দের সঙ্গে সমুদ্রের নীরবতা উপভোগ করি।
হং আইল্যান্ডও সমুদ্রের দিকে মুখ ঘোরানো গোলাকার সৈকত। এখানে বোট কিছুক্ষণ থামবে। আমি স্নর্ক্লিংয়ের গিয়ার পরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি সৈকতের অগভীর জলে ডুব দিলাম রঙিন মাছের জগৎ দেখার জন্য। নিমো, এঞ্জেল ফিশ, বাটারফ্লাই ফিশ, ক্লাউন ফিশ আরও কত যে নাম না জানা রঙিন মাছের রাজত্ব এখানে! স্নর্ক্লিং এতটা দেখাও যায় না, শুধু ওপরের দিকের মাছের সাক্ষাৎ মেলে। সঙ্গে ছোট ছোট প্রবালও। সবচেয়ে আনন্দদায়ক বিনোদন মাথা উঁচু করে শরীর ভাসিয়ে অল্প জলে ভেসে থাকা।
এরই মাঝে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। সবাই জলকেলি ছেড়ে ডাঙায় এসে টেবিলে সাজানো খাবারে মনোযোগ দিল। যেকোনো ট্যুরিস্টেরই থাই খাবার খুব পছন্দের। ভাতের সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ ভাজা, চিকেন ফ্রাই, ঝিনুক, স্কুইড, সবজি, স্যালাড, কয়েক রকমের ফল, ডেজার্ট আর হরেক জুস দিয়ে সাজিয়েছে টেবিল আমাদের বোটের গাইড। দুপুরের খাবার ট্যুরের প্যাকেজের মধ্যে ছিল।
মধ্যাহ্নভোজের পর আমাদের শেষ আইল্যান্ডে নামিয়ে দেওয়া হবে আরও কিছুক্ষণের জন্য। দ্বীপের নাম মায়া আইল্যান্ড। নাম শুনেই কেমন যেন মায়া মায়া লাগছে। কাছে গেলে না জানি কেমন হয়!
মায়া দ্বীপ আসলেই এক বিস্ময়। চারদিকে ঘিরে রয়েছে পাহাড় আর তার মাঝখানে চোখের মণি হয়ে গোলাকার এক অসামান্য সুন্দর সবুজ জলের সৈকত। যেন পাহাড়ের বুকের মাঝে এক টুকরো চাঁদ। আমি মুগ্ধ, অভিভূত, বাকরুদ্ধ। এই তটের এক তীর ধরে হাঁটতে থাকলে একসময় আবার একই জায়গায় এসে পৌঁছানো যাবে। এক অদ্ভুত ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে তীর ধরে হাঁটতে থাকি। পেছনে পড়ে রইল বোট। যেহেতু এই দ্বীপ আমাদের আজকের শেষ গন্তব্য আর সবাই সূর্যাস্ত দেখে ফিরবে, তাই এই মুহূর্তে হারিয়ে গেলেই-বা ক্ষতি কী!
আমার এক পাশে পান্না জলের ফিসফিস, অন্য পাশে পাহাড়ের ছায়া। একজন বলে জলে ঝাঁপ দিতে তো অন্যজন বলে খানিক পাহাড় চড়ে দেখিয়ে দিতে। কার কথা ছেড়ে কার কথা যে শুনি।
আর এর মাঝখানে পায়রার ডানার সবচেয়ে সাদা পালকের মতো মসৃণ আর দোলনচাঁপা ফুলের সুবাস মেখে সৈকত আমাকে পথ দেখায়। পাহাড়ের পায়ের নিচে ঝুঁকে মাথা নিচু করে গাছগুলো আলগোছে একটু একটু তট ছুঁতে চায়, ছুটে যেতে চায় হাওয়ার বেগে। এ রকমই একটা গাছের ডালে দেখি দোলনা বাঁধা। দোলনায় বসে আমি সূর্যাস্তের অপেক্ষায় থাকি। অপেক্ষাও মাঝে মাঝে মধুর হয়। সে মধুরতা বাড়িয়ে দেয় এই উদাস করা হাওয়া, গোধূলির কমলা থেকে লাল হতে চাওয়া দিগন্ত। এই সাগর, এই তট আর শেষ বেলার সূর্যস্নান প্রকৃতিকে উপভোগ্য পূর্ণতা দিয়ে যায়।

ছবি: লেখক

This Post Has One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top