skip to Main Content

স্মরণ I স্মৃতির রোদ্দুরে

কবি ফরিদা মজিদ আর আমাদের মাঝে নেই। জন্মেছিলেন কলকাতায়, ১৯৪২ সালে। মৃত্যু ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১। আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ২০১৪ সালে ক্যানভাসের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেটি পুনর্মুদ্রিত হলো

তাঁর স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার নানা অভিজ্ঞতা। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন দীর্ঘদিন। এর আগে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে বাংলা শিখিয়েছেন আমেরিকানদের। কমপারেটিভ লিটারেচারে এমফিল করেছেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে। ষাটের দশকে ব্যাংকক ও লন্ডনে জড়িত ছিলেন ফ্যাশন মডেলিংয়ের সঙ্গে। তাঁকে পরিব্রাজকও বলা যায়, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ ঘুরেছেন। ইংরেজি, ফরাসি, ইতালিয়ান ও আরবি ভাষার ওপর দক্ষতা ছাড়াও সংগীতের ভুবনে রয়েছে অবাধ বিচরণ। ফেলে আসা সময়ের কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বাংলা শেখানো

আশির দশকে নিউইয়র্কে বাংলা শেখার মানুষ কই? তারপরও আমার ক্লাসে তিন-চারজন ছাত্রছাত্রী হতো। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে তখন মাত্র বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। আমার আগে আরও একজন শেখাতেন বাংলা। আমি তখনো ছাত্রী। পার্টটাইম প্রফেশন ছিল এটি। এর আগে একজন খুব হেলাফেলা করে পড়াতেন। আমি সিরিয়াসলি পড়াতে শুরু করার পর অবস্থার উন্নতি হয়। পরে ফুল কোর্স হিসেবে সেখানে যুক্ত হয় বাংলা।
বিখ্যাত সব নানা-নাতনি
কবি গোলাম মোস্তফার নাতনি হিসেবে আমি অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। নানার বন্ধু হিসেবে জসীমউদ্দীন ও আব্বাসউদ্দীন ছিলেন আমার অতি প্রিয় মুরব্বি। আব্বাসউদ্দীন নানা আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। মাকে বলতেন, ও বড় গায়িকা হবে। শুধু তাঁর একার জেদে ম্যাট্রিকে বিষয় হিসেবে সঙ্গীত নিতে হয়েছিল। কত ভালোবাসলে একজন মানুষ এমন একটা জেদ ধরতে পারেন! ‘৫৭-৫৮ তে ম্যাট্রিকে সঙ্গীত নেওয়ার মানে আমাকে শিখতে হয়েছে ক্ল্যাসিক্যাল, থিওরি। সাবিনা ইয়াসমীনের বড় বোন ফরিদা ইয়াসমীন এবং ফেরদৌসী রহমানেরও অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট ছিল সঙ্গীত। এখন তো এ পদ্ধতি উঠেই গেছে। প্রথমে ক্লাসিক্যাল তারপর রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতিতে প্র্যাকটিক্যাল হতো ৭০ নম্বরের জন্য। বাকি ৩০ নম্বরের থিওরি হতো। যেখানে রাগ, ঠাট, রাগ-রাগিণী, সরগম ইত্যাদি সম্পর্কে রিটেন পরীক্ষা হতো। সেসব অনেক কঠিন ছিল।
প্রথম কবিতা এবং প্রকাশনা
তখনকার দিনে তো খেলনা বা টেলিভিশন ছিল না। বাচ্চাদের বেস্ট এন্টারটেইনমেন্ট ছিল পড়া। আমি পাঁচ বছর বয়সেই নানা ধরনের গল্প পড়তাম। সাত বছর বয়সেই কলকাতার সত্যযুগ পত্রিকার ছোটদের পাতায় আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। তবে আমি খুব কম লিখি। একটিমাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে। লন্ডনে থাকার সময় আমার একটা প্রকাশনা হাউস ছিল। যেখান থেকে শুধু কবিতার বই প্রকাশিত হতো। ভিক্টর ওয়েস্ট নামে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একজন ভেটরেনের যুদ্ধবিষয়ক নানা কবিতা নিয়ে ছাপা হয়েছিল প্রথম বইটি। নাম ‘সালাম্যানডারিন ইমপ্রিন্ট’। জিম বার্নস নামে ল্যাংকাশায়ারের একজন কবির দ্বিতীয় কবিতার বই ছাপা হয়। লন্ডনের কবিরা খুব নাক উঁচু। তারা জিম বার্নসকে কবি হিসেবেই মনে করতেন না। তাঁর রচনাকে ওয়ার্কিং ক্লাস বা শ্রমিকদের কবিতা বলে মনে করতেন। কিন্তু তার বই প্রকাশ করে আমি একটা ব্রেক থ্রু করেছি বলা যায়। শ্রেণি-পার্থক্যের পাঁচিল ভাঙার মতো। পরে তিনি কবি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
নোবেল বিজয়ীদের সঙ্গে
যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। যেমন আইরিশ কবি শেমাস হিনি। অনেক বড় কবি। তিনি নোবেল পেয়েছেন। আমি বেশ ক’টি আইরিশ ফোক সং বাংলায় অনুবাদ করেছি। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য ছিল। পাবলো নেরুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। আলাপও। বিখ্যাত সার্বিয়ান কবি ভাসকো পোপার সঙ্গেও আলাপ হয়েছে আমার। এ ছাড়া চেসোয়াভ মিউশ, জোসেফ ব্রডস্কির কবিতা অনুবাদ করেছি। ‘শব্দগুচ্ছ’ বলে নিউইয়র্কের একটা ম্যাগাজিনে জোসেফ ব্রডস্কির কবিতার সিরিজ অনুবাদ ছাপা হয়েছিল। আমার অনূদিত রবীন্দ্রনাথের খুব বিখ্যাত কবিতা ‘দুঃসময়’ নিউ ভিশন ইন ইংলিশ ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি বইয়ের প্রবন্ধে ইনক্লুড হয়েছে।
নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ
নজরুল ইসলামের গানগুলো একেকটা কাব্য। সেগুলো কতভাবে যে অ্যানালাইসিস করা যায়, যে কেউ অবাক হয়ে যাবে। মনে হবে এই গানটা সারা জীবন শুনেছি, কিন্তু এভাবে তো ভাবিনি। নজরুলের ভাষার প্রয়োগ অসাধারণ। মাত্র চার-পাঁচটা শব্দে তিনি যে কী সুন্দর ছবি আঁকতে পারেন, উদাহরণ দিই। ‘কালো হয়ে আসে সুদূর নদী— নাগরিকা-সাজে সাজে নগরী’। আমি আর্চান নদীর তীরে থাকতাম। প্রতি সানসেটে আমার এই দুটি লাইন মনে পড়ত। নাগরিকা শব্দটি এখানে নাগরের ফিমেল হিসেবে এসেছে। রাতের আলোয় সাজা শহরকে প্রেমিকের জন্য সাজা অর্থে বোঝানো হয়েছে।
আমি মনে করি, নজরুলের এক নম্বর ভক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দু-একজন স্কলার ছাড়া যদিও এটা কেউ স্বীকার করেননি। রবীন্দ্রনাথ যে সম্মানটা নজরুলকে দিয়েছেন, তা কেউ দেননি। ওই সময় হিন্দু লেখকেরা তো তাচ্ছিল্য করেছেনই, মুসলমানরাও তাঁর ওপর বিরূপ ছিলেন। এই অ্যাটমোসফিয়ারের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ঠিকই চিনেছিলেন। ১৯২২ সালে বিদ্রোহী কবিতা বের হলো। নজরুল তখন জেলে। মাত্র দুটো বই বের হয়েছে। ওই জেলে থাকাকালে রচিত ‘বসন্ত গীতিনাট্য’ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসর্গ করলেন, বলা যায় তাঁকে নিয়েই লেখা বই ওটি।
ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা
১৯৯২ তে ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা যখন অনুবাদ করেছি, তখন আমারই এক ছাত্রী ভারতে যাচ্ছে। তার হাত দিয়ে কলকাতার জিজ্ঞাসা পত্রিকার সম্পাদক শিবনারায়ণ রায়ের কাছে পান্ডুলিপি পাঠালাম। তাঁর এতে পছন্দ হলে তিনি অক্টোবর সংখ্যায় সেটি ছাপাবেন বলে মনস্থির করলেন। কী অবাক কান্ড! সে বছরেই অক্টোবরে নোবেল পান ডেরেক ওয়ালকট। শিবনারায়ণ তখন ভূমিকায় লিখলেন, ‘ডেরেক ওয়ালকটের নাম আমরা কেউ শুনিনি। ফরিদা যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনুবাদ না করত, তাহলে আমি তার কবিতাও ছাপতাম না।’ তখন সবাই বলতে শুরু করল, খুব সময়-উপযোগী লেখা হয়েছে। তবে আমি তো আর ইচ্ছে করে করিনি। কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে। যদিও ঘটনাটি খুব স্মরণীয় হয়ে আছে আমার জন্য।
যশুরে!
বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলের ১৯৩৯ সালে নানা হেডমাস্টার ছিলেন। সেখানে পড়তেন সত্যজিৎ রায়, রবিশঙ্কর। রবিশঙ্কর নিজেও আমাদের মতো যশোরে ছিলেন। তাই উনি যেখানেই আমাকে দেখতেন, বলতেন যশুরে কই, যশুরে কই? একটা ঘটনা বলি। জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কনসার্টে আমি লিফলেট বিতরণ করছি। সেটি ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানের নৃশংসতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তোলার জন্য। অনুষ্ঠান হয়েছিল বিকেলে। হঠাৎ মি. মুখার্জি এসে বললেন, ‘ফরিদা, তোমাকে খুঁজছি। রবিশঙ্কর নিজে তোমার জন্য এই টিকিট পাঠিয়েছেন।’ দেখি, একেবারে সামনের সিটে দু শ ডলারের টিকিট! আমি তো অবাক! রবি মামার কারণেই জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তারপর তিনি একটা গান লিখেছেন, যেটা ইন্টারভ্যালের সময় আমাকে পড়ে শোনান। পরে গানটা পারফর্ম করেন। কী অসাধারণ একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। পরদিন নিউইয়র্ক টাইমসে হেডলাইন হলো, রক মিউজিক কামস এন এজ। অর্থাৎ রক মিউজিক আর ছেলেমানুষ নেই।
প্রথম স্বাধীনতা লবিস্ট
বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিতে ইউনাইটেড স্টেটস সিনেট এবং কংগ্রেসে আমিই কিন্তু প্রথম লবিস্ট। এটা আমি নিজেও জানতাম না। পরে সিনেটররা বলেছেন বলেই আমি জানতে পেরেছি। ২৫ মার্চের কালরাতের পর পয়লা এপ্রিলে করা আবেদন আমার স্বাক্ষর দিয়ে শুরু হয়। মতিয়া চৌধুরী কিন্তু আমার ক্লাসমেট ছিল। মতিয়া চৌধুরী, আমি আর ফাহমিদা খাতুন একসঙ্গে ইডেন কলেজের মাঠে বসে একত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতাম। মজার একটা কথা বলি, মতিয়া আমাকে ঈর্ষা করত। আমার বড় চুল আর মোটা বেণি ছিল, এ জন্য!
রবার্ট বুই
আমার স্বামী রবার্ট বুই ছিলেন কমলাপুর রেলস্টেশনের ডিজাইনার। সে সময় মুসলমান হয়ে কোনো খ্রিস্টানকে বিয়ে করা বেশ সাহসের ব্যাপার। আমাদের মধ্যে ঠিক প্রেম নয়, তবে পরিচয় ছিল। ১৯৬২ সালে বিয়ে। পাত্রের জাতপাত নিয়ে পরিবারও অত মাথা ঘামায়নি। আমাদের সেপারেশন হয়েছে অনেক বছর। তবে এখনো তাকে আমি ভুলিনি।
তখন আর এখন
পঞ্চাশের দশকেও আমরা খুবই ফ্যাশনেবল ছিলাম। মা-খালারা শৌখিন ছিলেন। তবে সালোয়ার-কামিজ নয়, ক্লাস নাইন-টেন থেকেই আমাদের শাড়ি পরতে হতো। শাড়ি পরেই গাছে চড়েছি, হকি খেলেছি। টিপ দিতাম, হালকা গয়না পরতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। মুক্তার গয়না ভালো লাগে। এখনো সেভাবেই সাজি। ইদানীং পারিবারিক কিছু অসমাপ্ত কাজ করছি। লেখালেখি করি ব্লগে। আমি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আমি অনেক লেখা লিখেছি। কনফারেন্স পেপার দিয়েছি। দেখে ভালো লাগছে যে আমাদের চেষ্টা একেবারে বৃথা যাচ্ছে না।

 রত্না রহিমা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top