বিশেষ ফিচার I গয়নানামা
দেখতে দারুণ, চমৎকার সব নামের এই অলঙ্কারগুলো যেন একেকটি আখ্যান। পরম্পরার অংশ আর স্মৃতি উসকে দেওয়ার অনুষঙ্গ নিয়ে লিখেছেন জাহেরা শিরীন
বাঙালি, বিয়ে আর গয়না— বরাবরই এক সূত্রে গাঁথা। পুরাণ থেকে পুঁথি, এমনকি ইতিহাসের পাতাতেও মেলে তার প্রমাণ। গবেষকদের গ্রন্থ থেকে কবি-সাহিত্যিকদের লেখনীতেও মনোহর সব গয়নার নাম আর বয়ান উঠে এসেছে বারবার। ‘আমার গহনা পিতা ঠাকুর দেন। হাতে চালদানা, পলাকাটি, মাদুলি, পঁইছা, বাউটি, তাবিজ, বাজুদানা, কণ্ঠমালা। পায়ে ছয়গাছা মল, পাঁইজোর, গকরি, পথম ও চুটকি। কানে বোঁদা ও মাছ। কোমরে চন্দ্রহার, গোট, চাবি ও শিকলি। মুশকিল হলো, এই সমস্ত গয়না শাশুড়ি নিয়ে তার ভিক্ষা পুত্রের বউকে দিয়ে দিলেন। বদলে তিনি তাঁর নিজের বউমাকে দিলেন আশী ভরির ঝুমুর দেওয়া ছয়গাছা মল, আশী ভরির পাঁয়জোর, বালা, ডামনকাটা, পাড়িখাড়–, হাতহার, চালদানা, নবংগকলি, চল্লিশ ভরির বাউটি, চৌদ্দ ভরির গোরমালা, বারো ভরির তাবিজ, পাঁচ ভরির বিল্বপত্র বাজু, গোপহার, মুকুতার কণ্ঠি, পানহার, সিঁথি, দো-নর মুকুতা, আঠাশ ভরির চন্দ্রহার, কানবালা, কানফুল, ঝুমকা, চৌদানি, মুকুতার গোছা, দুটি ছোট ঝুমকা, দুটি ছোট ফুল আর পিপুলপাত।’ এটি কিশোরীচাঁদ মিত্রের স্ত্রী কৈলাসবাসিনী দেবীর ‘গহনার ফর্দ’র অংশবিশেষ। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস: আদি পর্ব’তেও মেলে বিয়ের গয়নার যৎসামান্য বিবরণ। ‘উচ্চকোটিস্তরে বিবাহোপলক্ষে কন্যাকে কীভাবে সজ্জিত ও অলংকৃত করা হইতে তাহার কিছু বর্ণনা আছে নৈষধচরিতে। প্রসঙ্গত উৎসব সজ্জার কিছু বিবরণও পাওয়া যায়। প্রথমেই কুলাচার অনুসারে সধবা ও পুত্রবতী গৃহিণীর মঙ্গলগীত গাহিতে গাহিতে কন্যাকে স্নান করাইতেন এবং পরে শুভ্র পট্টবস্ত্র পরাইতেন। তারপর সখীরা দময়ন্তীকে কপালে পরাইলেন মনঃশিলার তিলক, সোনার টিপ, কর্ণযুগলে পরাইলেন দুটি মনিকুন্ডল, কণ্ঠে সাতলহর মুক্তার মালা, দুই হাতে শঙ্খ ও স্বর্ণবলয়, চরণে আলতা।’ স্বয়ং বেগম রোকেয়ার লেখনীতে পাওয়া গেছে গয়না পরিহিত বউয়ের বিবরণ। ‘মাথায় সিঁথির অলঙ্কার ৪০ ভরি, কর্ণে ২৫ ভরি, কণ্ঠে ১২০ তোলা, সুকোমল বাহুলতায় প্রায় দুই সের, কটিদেশে ৬৫ ভরি, চরণযুগলে ২৪০ ভরি স্বর্ণের বোঝা!’ সে সময় একটু সম্পন্ন গৃহস্থের বউ মানেই প্রচুর গয়নাগাটি। সেগুলো তারা পরতেন, জমাতেন, বাক্স খুলে দেখতেন। অন্দরমহলে এই গয়নাগুলোই ছিল তাঁদের প্রাণ।
শুরুটা করা যাক মাথার গয়না দিয়ে। মুসলিমরা বাংলায় আসার আগে মেয়েদের মাথার গয়না বলে কিছু ছিল না। মানে টায়রা বা টিকলি ছিল অজানা বস্তু। পরবর্তীকালে মেয়েরা মাথায় পরতেন চেঙ্কি, শিষফুল, ছোটি, কলগা, কীরিট টোপর, শেখর, সিঁথিমোর ও মৌলি। কপালে পরতেন দমনি, কুটবি, তাওয়াইট, চাঁদটিকা, ঝুমর, গুছই, বারোয়াট আর বিন্দলি। চুলে জড়ানো হতো কুরীর, কাঁটা, গুঁজি, বাগান, বেলকুঁড়ি, ফাটা আর চিরুনী নামের গয়না।
কানে পরার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল বীরবৌল আর মদনকড়ি নামের অলঙ্কার। কানবালা, কানপাশা আর কান— এই তিনটি মোগলদের দান। এ ছাড়া কর্ণিকা, কর্ণপুর, কর্ণবেস্ট, কর্ণবেস্টন, কর্ণপালি, কর্ণদর্পণ, কর্ণকুনত্দল, কর্ণমালা, কানপাশা, কানবালা, টাব, চৌদানী, ঝুমকা, দুল, পাশা, বারবৌরি, মকরকুন্ডল, মাকড়ি, গোসওয়াড়া, বাহাদুরি, ঝমকা, বালা, ঘুরিংদার, পতংয়ের মতো চমৎকার সব নামের গয়নার প্রচলন ছিল কানে পরার জন্য।
নাকে নথ ও নোলক ছিল এয়োতির চিহ্ন। মুসলিম সমাজে প্রচলিত এ প্রথা থেকে অনুপ্রাণিত হন সে সময়কার হিন্দুরাও। ফাঁদি নথ এত বড় হতো যে তার ভেতর দিয়ে অনায়াসে ভাত খাওয়া যেত। সে সময় নাকের মাঝে সেপ্টামের মতো গয়না পরার চল ছিল। দুই দিক চাপা বোতামের মতো। এর নাম ছিল নাকঠাসা। এটি পরার পেছনের কারণটাও ছিল চমৎকার। স্ত্রীর নিশ্বাস স্বামীর গায়ে সরাসরি পড়া অশুভ বলে মনে করা হতো সে সময়। সোনা শুদ্ধ ধাতু। নাকের অশুভ বাতাস পিউরিফায়েড হয়ে স্বামীর গায়ে পড়বে ভেবেই পূর্ব বাংলায় নাকঠাসা পরার প্রচলন ছিল। নবাবি আমলে স্বামীর সম্মান অনুযায়ী স্ত্রী নথ পরতে পারতেন। সে সময় মেয়েরা বাপের বাড়ি এলেই পুরোনো গয়না ভেঙে নতুন ডিজাইনের নাকের গয়না গড়ে নিতেন। স্বর্ণকার বাড়িতে হাজির হতেন নতুন নতুন নকশা নিয়ে। অদ্ভুত সব ডিজাইন, কী দারুণ সব নাম! মাক্কি, কেশর, ডালবোলাক, চানবোলাক, হীরাকাট বোলাক। নাকছাবিরও কত কায়দা— ডালিমফুল, লবঙ্গ, বরইফুল, চালতাফুল, দামালকাট। নকশাভেদে নানা নামের অলঙ্করণ। গলার হারে মুক্তার মালার চল সবচেয়ে প্রাচীন। বৈদিক যুগের। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে চম্পাকলি, হাঁসুলি, ইতরাবদন, গুলবন্ধ, কান্দি, মোহরণ, হাউলদিল নামে নানা রকম গলার হার পরত মেয়েরা। তারপর যুগে যুগে নারীরা গলায় জড়িয়েছেন অর্ধহার, ইন্দ্রচ্ছদ, একাবলী, কত্তী, গোটহার, গোসত্দন, গুজ্ঞার, চন্দ্রহার, চারনরী, পাটিহারা, পাঁচনরী, প্রনিশ্চ, প্রালম্বক, পুঁতিমালা, প্রেমফাঁস, ফুলোহার, বকুলমালা, মধ্যমণি, মতিহার, দমাহার, রশ্মিমালা, শেলি, সাতনরী, সীতাহার, হেসোঁহার নামের নয়নাভিরাম সব গয়না।
হাতের গয়নার মধ্যে বাজুবন্ধ, তাবিজ, অনন্ত, বাউটি, মানতাসা, কঙ্কন আর রতনচূড়ের নাম অনেকেরই জানা। তবে পঁইছা, প্রতিশর, নোয়া, ভাওটা, জসমবাক, কুলুপিয়ার নাম হয়তো এ যুগের মেয়েদের শোনাও হয়নি। হাতের গয়না বললে আংটি তাতে থাকবেই। শকুন্তলার সময় থেকে আংটির চল আছে বলে শোনা যায়। আরশি আর ছল্লা নামে দুই রকমের আংটি ছিল সে সময়। কোমরে পরা হতো পাহজেব, বঞ্জর, জিঞ্জির। ক্রমেই সে তালিকায় যুক্ত হয় কিঞ্চিন, গোট ঘুনসি, চন্দ্রহার মেঘলা, টোরা, সপ্তকি। যাদের পয়সাকড়ি কম, তারা বউদের কিনে দিতেন গোটাহার আর নিমফল। আর পায়ের জন্যও ছিল সুন্দর সব নামের অলঙ্কার। কিঙ্কিনি, গুড়বাঁধ, গোড়পলা, গুজারি, সাগর, ঘুঙুর, টুচকি, তোড়া, পাদঙ্গদ, পায়েজোর, পাশুলি, পাষক, পাদকটক, বাঁকমল, মল, মজির আর নুপূর।
অনেক গয়নার নাম তো আজকাল শোনাই যায় না। পাওয়া যায় বইয়ের পাতায়। প্রফুল্লময়ী দেবীর স্মৃতিকথায় তার গয়নার যে বিবরণ মেলে, তা জানলে এ যুগের মেয়েদের হিংসাই হবে। আর গোড়ে, ছালনা, পিন খাড়–, চাটদানি এয়ারিন, দমদম গোখরি বা ঝাঁপার মতো গয়নার নাম শুনলে চোখ কপালে উঠবেই।
শুধু সাজসজ্জা থেকে স্ত্রী ধনে পরিণত হওয়া এই গয়নাগুলো সংরক্ষণও করা হতো বিশেষ উপায়ে। বিশেষ বাক্সে। আর হবেই না বা কেন? বিয়ের গয়নাগুলো তো এতেই পুরে রাখা হতো সযত্নে, বছরের পর বছর। শ্রুতি রয়েছে ‘বিদ্দান’ নামের সে বাক্সটি তৈরি হতো খাঁটি রুপায় মুড়িয়ে। সে বাক্সে পুরে রাখা হতো সোনার সব গয়না, সঙ্গে পুরোনো দিনের পরম্পরা আর সুখ-দুঃখের সব স্মৃতি।
মডেল: পিউলি
ছবি: ক্যানভাস ও সংগ্রহ